আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে সেনাপ্রধানের পাঁচালিঃ কৃষির সামরিকীকরণ? (৩য় পর্ব)



পাম চাষঃ সামরিক বাহিনীর পামপ্রীতি? সেনাপ্রধান তার আলোচনায় ভোজ্যতেলের বিকল্প সন্ধানের আহবান জানিয়ে পাম চাষের পক্ষে কিছু যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তার ভাষায়, "...বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বার্ষিক ছয় লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণে আমদানি খাতে প্রতিবছর ব্যয় হয় ৪০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের এই ঘাটতি মেটাতে পাম চাষ এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ রাখতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। অন্যান্য উদ্ভিজ্জ তেলের মতো কোলেস্টেরলমুক্ত এই তেল পুষ্টি বিচারে ভিটামিন ‘এ’ এবং ‘ই’- এর ঘাটতি পূরণে অবদান রাখতে পারে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষের পাশাপাশি বসতবাড়ির আঙিনায় একটি বা দুটি পামগাছ পরিবারের ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে সহায়ক হবে"।

অনেকের কাছেই বাংলাদেশে পামচাষের এই পরামর্শটুকু নতুন মনে হতে পারে। কিন্তু এই প্রচেস্টা আসলে নতুন নয়, এর আগেও সামরিক সরকারের আমলে এখানে পাম চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এবং অবাক হলেও সত্য যে, সেনাবাহিনীর সাথে পাম চাষ বা পাম প্রজেক্টের এক অদ্ভুত সখ্যতা বিদ্যমান। ১৯৭৮-৭৯ সালে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের আমলে প্রথম মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া থেকে পাম বীজ ও চারা আমদানী করা হয় এবং ঢাকার বোটানিকল গার্ডেনে পলিব্যাগে পরীক্ষামূলক চাষ করা হয়। এরপরে ছয়মাস বয়সী গাছ সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বনাঞ্চলে লাগানোর জন্য পাঠানো হয়।

১৯৮১ এ এসে মোট ৭৮৪ একর জমি পাম চাষের আওতায় নিয়ে আসা হয়, যার ২৭৯ একর চট্টগ্রাম, ৩২৫ একর কক্সবাজারে এবং ১৮০ একর সিলেটে। পরবর্তীতে পামচাষের আওতাধীন জমির পরিমাণ হাজার একর পার হয়। কিন্তু সেসময়ের সেই প্রজেক্ট ব্যর্থ হয়ে যায়- কেননা এখানকার মাটি-জলবায়ু কোনটাই পামচাষের উপযোগী ছিল না(৪)। তাহলে, প্রশ্ন হচ্ছে ভোজ্যতেলের বিকল্প খুঁজতে কেন সেনাপ্রধান আবারো পামচাষের কথা বললেন? এখানকার রবিশস্য হিসাবে খ্যাত সরিষা-বাদাম কিংবা আমাদের মানুষ মূলত যেটাতে নির্ভরশীল সেই সয়াচাষের কথা বললেন না কেন? যে সরিষা আমাদের নাইট্রোজেন সাইকেল পূর্ণ করার মাধ্যমে আমাদের জমির উর্বরতা ধরে রাখতে ও বাড়াতে যে বিশেষ ভূমিকা রাখে সেটাকে কেন উপেক্ষা করা হবে? এর উত্তর খোজার আগে, আরেকটি খবর আমরা দেখে নিই। তা হলো, ৮০ এর দশকের সেই ব্যর্থ প্রজেক্টের পরে সম্প্রতি আবারো আমাদের বন বিভাগ পামচাষের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, বনবিভাগ ইতোমধ্যেই "সবুজ বলয়" নামে একটি নতুন প্রজেক্ট প্রস্তুত করেছে- যার কমপক্ষে ২০ ভাগ থাকবে পামগাছ(৫)।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, মঈন উ আহমদ যেটা এখানে পরামর্শ হিসাবে দিয়েছেন, কিছু যুক্তি তুলে ধরেছেন, তা আসলে ইতোমধ্যে সরকারের নেয়া পদক্ষেপ। এখন আসি আগের প্রশ্নটিতে, কেন পামচাষ? এর উত্তরে একটাই বলা যেতে পারে- তা হলো পামচাষকে কেন্দ্র করে মাল্টিন্যাশনালদের বিশাল বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক। পামচাষ মানেই বিশেষ ধরণের সার, বিশেষ বিশেষ কীটনাশক- বিশেষ সেচ পরিকল্পনা। এবং দুনিয়া জুড়ে এর বাজার। বিস্তারিত অন্যত্র আলোচনা করা যেতে পারে।

শুধু এক্ষণে মালয়েশিয়ার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার দিকে তাকাই। মালয়েশিয়া দুনিয়ার মধ্যে শীর্ষস্থানীয় পামতেল উৎপাদনকারী দেশ, তার মোট জিডিপির এক চতুর্থাংশই আসে ক্রুড ও পাম অয়েল থেকে। মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীন উৎপাদনের ১১ শতাংশ যেখানে সাধারণ কৃষিজাত, সেখানে ৭০ শতাংশই পামচাষ থেকে। আর এ করতে গিয়ে মালয়েশিয়া তার খাদ্যচাহিদার কেবল ৬৫ থেকে ৭০ ভাগই উৎপাদন করতে পারে, বাকিটা করতে আমদানী। সম্প্রতি দুনিয়া জুড়ে খাদ্য সংকটের প্রেক্ষাপটে মালয়েশিয়া হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে, কেবল জিডিপির পেছনে ছোটার ফল।

মালয়েশিয়ার প্রধান চাল আমদানীকারক দেশ থাইল্যাণ্ডও যখন পুরো চাল দিতে অস্বীকার করলো- তখন মরিয়া মালয়েশিয়া চারদিকে হন্যে হয়ে চাল খুঁজতে শুরু করে- "চালের বিনিময়ে পাম অয়েল" প্রাচীণ যুগের এমন বিনিময় প্রথার ঘোষণা দেয়(৬)। আমদের অবশ্য মনে পড়ে ইরাকের ফুড ফর অয়েলের কথা- কিন্তু ইরাক তো যুদ্ধ বিধ্বস্ত- অবরুদ্ধ। আর মালয়েশিয়া? আমাদের এখানে পামচাষের এলাকাও দেখা যায় মূলত বনাঞ্চলে। সে সম্পর্কিত ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতাটাও দেখি। ১০০ বছর আগেও ইন্দোনেশিয়ার মোট ভূমির ৯০% ছিল রেইন ফরেস্ট, ৫০ বছর আগেও তা ছিল ৭৭ শতাংশ- আর আজ এই রেইনফরেস্ট কমে হয়েছে অর্ধেকেরও কম- যার প্রধানতম কারণ পামচাষ(৭)।

এর জলবায়ুগত প্রভাব নিয়ে এর মধ্যেই পরিবেশবিদেরা নানা প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেছেন। প্রশ্ন হলো, আমাদের বর্তমানে বনভূমির পরিমাণ কতখানি? সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা আজকে মালয়েশিয়াকে নতুন করে ভাবাচ্ছে- কৃষি জমির পরিমাণ বৃদ্ধির দাবী উঠছে (যদিও কর্পোরেট বিনিয়োগ এত সহজেই পামকে ছাড়বে এমন কোন লক্ষণও নেই)। আর আমাদের এখানে নতুন করে পাম প্রজেক্ট নেয়া হচ্ছে! আমাদের সেনাপ্রধান তার খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রবন্ধটিতে পামচাষের পক্ষে প্রচারণা চালান! আলোচ্য প্রবন্ধটি শেষ হয় আশাবাদের কথা শুনিয়ে, "দেশের আপামর জনসাধারণের মতো আমিও অপেক্ষায় আছি সেই সোনালি দিনের"। সেনাপ্রধানের ন্যায় দেশের আপামর জনসাধারণ অবশ্যই সোনালি দিনের প্রত্যাশা করে, তবে নিশ্চিতভাবেই এটুকু বলতে পারি যে- সেনাপ্রধানের "সোনালি দিন" আর আপামর জনসাধারণের "সোনালি দিন" মোটেও এক নয়, বরং সম্পূর্ণ বিপরীত ও বিরোধাত্মক। প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তথ্যসূত্রঃ ১।

প্রথম আলো বিশেষ ক্রোড়পত্র, ডিসেম্বর ২০০৬ ২। ETV (একুশে টিভি) এ ১০ মার্চ, ২০০৮ তারিখে প্রচারিত টকশো ৩। ঐ ৪। Oil palm plantation plan comes under criticism- by Pinaki Roy Click This Link ৫। ঐ ৬।

"Malayasia's Rice Diplomacy" - by Abdul Ruff Click This Link এবং "The Price of Malayasia's Palm Oil Expansion" - Arun Bhattyacharya Click This Link ৭। "Palm Oil's Impact on Ecosystem" - Dawn M. Smith Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.