আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কক্সবাজার ভ্রমন ০৪

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

আপাতত এই খুপড়ি বসে থাকা ছাড়া কোনো কাজ নেই। একটা ডাবলে বেডের দুই পাশে বেড সাইড টেবিল, সামনে একটু ১৪ ইঞ্চি টিভি, একটা ছোটো টেবিল, একটা চেয়ার। বাথরুমের পাশে ড্রয়ার। টেবিলের উপরে সাজানো ২টা পানির গ্লাস তবে কোনো পানির জগ নেই। বন্ধুদের ফোন দিয়ে জানলাম ওরা এখনও ৬৫ কিমি দুরে, সুতরাং আগামী ১ ঘন্টার আগে ওদের পৌঁছানোর কোনো সম্ভবনাও নেই।

যতটা আগ্রহ নিয়ে হোটেলের রুমে ঢুকেছিলাম ততটাই বিতৃষ্ণ এখন। দেয়ালে নাক ঠেকে যাওয়ার পরে ঘুম চটে গেছে। বেড সাইড টেবিল খুলে দেখলাম সেখানে একটা রাইটিং প্যাড রাখা। সাথে একটা ক্ষয়ে যাওয়া পেনসিল। তার উপর ফর্দ রাখা, টেবিলের কাঁচ ভাঙলে ১৫০০ টাকা , টেবিল ভাঙলে ২৫০০, বাথরুমের সাবান কেস ভাঙলে ৩০০০, হোটেলের প্রতিটা অংশই বহুব্যবহারে জীর্ণ, লিফটের চলতা উঠে গেছে।

রদ্দি হোটেল। শুধু সামনের জায়গাটা সুন্দর। বিশাল একটা লন আছে। লনের সামনে সামান্য উঁচু একটা মাটির ঢিবি, হোটেলের প্রবেশ পথের কাছে একটা শিউলির গাছ। শিউলি ঝড়ে আছে সবুজ লনে।

আর পার্কিংস্পটে লেখা, নিজ দায়িত্বে পার্কিং করুন। অদ্ভুত দায়বদ্ধতাহীনতা। প্রবেশ পথেই লেখা বীচ থেকে ফেরার পথে ভালো করে পা ধুঁয়ে নিন। আমি সমুদ্রে নামি নি তবে পায়ে সামান্য বালি লেগেই আছে। সময় কাটানোর জন্য কি করা যায়? সিগারেট ধরিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া পেনসিল হাতে নিয়ে কিছু লিখবো মনে করলাম।

বেশ আয়েশ করে জানালা দিয়ে আকাশ দেখি, সামনের ঝাউবন দেখি, সামনের দরজা দিয়ে কিছুই দেখবার নেই, সেদিকেও চোখ রাখি একটুক্ষণ। বেশ একটা গম্ভীর লেখক লেখক ভাব নিয়ে লেখা শুরু করতে হবে। অনেক কিছুই করি তবে লেখা হয় না। বন্ধু বললো কি রে তুই কি কবিতাউবিতা লিখবি? আমি সজোরে মাথা নাড়াই। কবিতা উবিতা লেখালেখির বিষয়টা যতটাসম্ভব গোপন রাখা উচিত।

তাহলে কি লিখবি? দেখি কি লেখা যায়। পেনসিল হাতে নিয়ে বসে থাকি। আমরা বন্ধুর প্রথম যেবার দার্জিলিং গেলাম তখন সদ্যবিবাহিত এক বন্ধুও আমাদের সাথে গিয়েছিলো দার্জিলিং। ৪ দিনের ট্যুরে তার প্রথম এবং প্রধান কাজ ছিলো হোটেলের রুমে বসে বসে নতুন বৌকে চিঠি লেখা। চিঠি লেখার অবসরে ফ্যাশন টিভি দেখা।

পৃথিবীবিযুক্ত হয়ে তার এই আত্মগত চিঠি লেখার কাজটাতে আমরা কেউ বাধা দেই নি। দার্জিলিং থেকে ফিরবার ১০ মাসের ভেতরেই আমরা সবাই চাচা হয়ে গেলাম। বৌকে চিঠি লেখা যায়? আমি গত দুই বছরে নিয়মিত ইমেইল লিখি নি, কাগজে চিঠি লিখেছি শেষবার কবে মনে নেই। অনভ্যাসে মানুষ সবকিছুই ভুলে যেতে পারে। এমন কি সাইকেল চালানোও মানুষ ভুলে যায় অনভ্যাসে।

চিঠি লেখা রীতিমতো দুরহ একটা কাজ। ঠিক সামনে দাঁড়ানো বন্ধুর দিকে তাকাই। অন্য কোনো মানুষের উপস্থিতিতে এক লাইন লেখা রীতিমতো পাহাড় কেটে সমতল করবার মতো কঠিন আমার জন্য। অনেকেই দেখি ভীড়ের ভেতরে লিখে যেতে পারে দস্তা দস্তা কাগজ ভরে ফেলতে পারে। আমার কাছে লিখবার কাজটা রীতিমতো একাকীত্বের বিলাস, এমন কি সামনে কারো ছায়া পড়লেও লেখায় বাধা পড়ে যায়।

লিখবার সময় আমার আশে পাশে কেউ থাকলেই আমি অনেক বেশী আত্মসচেতন হয়ে উঠি, একেবারে নিজের ভেতরে ডুবে গিয়ে অনেক দিন লেখা হয় না। সব সময়ই কানে কিছু না কিছুর আওয়াজ আসে। বার বার মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হয়। বাইরে গিয়ে সিগারেট ধরাই, কিছুক্ষণ হাওয়া মেখে ফিরে আসি। বাসায় মাঝে মাঝেই ছেলে এসে কোলের উপরে বসে, বাবা আমিও কাজ করবো, সুতরাং লেখায় অনির্ধারিত সময়ের বিরতি।

এইসব নিয়ে খুব বেশী পরিশ্রম করে চিন্তা ভাবনা করে লেখা হয় নি অনেক দিন। এখানেও বন্ধু সিগারেট হাতে নিয়ে তাকিয়ে আছে। যাও কিছু ভাবনার বুদবুদ ছিলো মাথায় , সেইসব বুদবুদ ফেটে চৌচির। কক্সবাজার ঢুকবার সময়ে একটা জায়গায় হঠাৎ করেই সমুদ্রটা ছিটকে চোখের উপরে এসে পড়ে। সামনের চড়াই-উৎরাই, আশেপাশের কালচে সবুজ গাছের আড়াল থেকে হঠাৎ করেই দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতা।

অনেক দুরে ছোটো ছোটো কালো সম্পান। এবং বিশাল আকাশের পটভুমিতে সেগুলোকে স্থির দেখায়। অদ্ভুত একটা ভাব চলে আসে মনে। সাধারণত দিগন্তে সবুজ কালছে সবুজ, ধুসর ছায়া দেখে অভ্যস্ত আমি প্রথম বার যখন এমন বিস্তৃর্ণ সমুদ্র দেখলাম চমকে উঠেছিলাম। সমস্ত রাস্তাটাই এই দৃশ্যটা দেখবো বলে অপেক্ষার চোখ মেলে তাকিয়ে ছিলাম।

অবশেষে সেই দৃশ্য দেখে তেমন চমক আসলো না। সমুদ্রসৈকতে গিয়ে দেখলাম অনেক দুরে পানি হালকা সবুজ, তবে সৈকতে আছড়ে পড়ছে যে পানি সেটা পরিস্কার হলেও বালির জন্য সামান ঘোলা লাগে। যতদুরে গেলে সমুদ্র সবুজ সেখানে যাওয়ার কোনো অনুমতি নেই, উপদ্রুত সৈকতে শুধু মানুষের ভীড় , সমুদ্র অপসৃয়মান মানুষের পায়ের চাপে। এইসব ভাবের বুদ্বুদ উবে গেলে শুধু আমি আর শুন্য রাইটিং প্যাড পড়ে থাকে। সামনে নেভানো সিগারেট আর বন্ধুর উৎসুক চোখ, কি রে ব্যাটা লিখলি না? মনে মনে ভাবি, খাতা আর কলম নিয়ে আসলো ভালোই হতো, এইসব বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো লিখে রাখা যেতো।

সমস্যা নেই, বিকেলে গিয়ে কলম নিয়ে আসলো, এই ক্ষয়ে যাওয়া পেনসিলে তেমন কিছুই লেখা যাবে না। ওই ব্যাটা উরা এই রুমটা নিলো কি মনে কইরা? এইখানে তো মনে কর আমাদের সবার জায়গা হইবো না। এখন মনে কর যদি অন্য রুমডিও এমন হয় তাইলে মনে কর ধরা আমরা। এই রুমে তেমন কোনো আকর্ষণ নেই। এর চেয়ে সস্তা হোটেলে আমি ফ্রীজ দেখেছি।

ফ্রীজে অনেক কিছুই রাখা থাকে, তবে এখানে সে ব্যবস্থাই নেই। বিশেষ নিয়মের ভেতরে লেখা, সকলা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গরম পানি যাবে। তেমন ক্ষুধার্ত না। অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে আরও একটা সিগারেট ধরাই। এসি রুমে সিগারেট ধরানোর বোকামি করবো না বলেই দরজা খুলে রাখি।

একেবারে খাঁচার ভেতরে ঢুকে আছি। এর আগে একজন বলেছিলো আমাকে ভাই গিয়া দেখবেন সিগাল একেবারে মুরগির খাঁচা। তখন বিশ্বাস হয় নি, এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতেছি এইটা কি জিনিষ। বন্ধুরা যখন পৌঁছালো তখন ১২টা ১৫। আমার অনুমান ছিলো ওরা পৌঁছাবে ১২টা ১০এ।

এরপর অন্যরুম পাওয়া গেলো, সেটাও একই ফ্লোরে, একই মাপের রুম। অবশ্য কাউকেই কিছু বলা যাবে না। সবারই এটা প্রথম অভিজ্ঞতা। সবাই মোটামুটি হতাশ। ফ্রেশ হয়ে সৈকতে যাওয়া হবে না কি আমরা খেতে যাবো এই নিয়ে সামান্য আলোচনা হচ্ছে।

অবশেষে ঠিক হলো আমরা সামান্য একটু সময়ের জন্যই সমুদ্রে নামবো, বেশী লাফালাফি করবো না। যাস্ট একটু গা ভিজিয়ে নেওয়া। ফাইনালের আগে ওয়ার্মআপ ম্যাচ। আমাদের ভেতরে যাদের এখনও বিয়ে হয় নি কিন্তু বিয়ের অপেক্ষা করছে তারা দুজন নামলো না। সৈকতে গিয়ে দেখি ছাতার নীচে একটা আরামকেদারা খালি।

প্রতি ঘন্টা ৩৫ টাকা। অদ্ভুত এক জায়গা এইটা, এখানে রিকশায় পাছা ঠেকালেই ১৫টাকা। একটা ছাতার নীবে বসবো সেটাও ঘন্টা প্রতি ৩৫ টাকা। দরদাম করেও কোনো লাভ হয় না। কি আর করার।

আশেপাশে ৬ মাসের পোয়াতি পেট নিয়েও মাজা দুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পুরুষেরা, উর্ধাঙ্গ উদাম, বিশাল পেটের আশেপাশে শীর্ণ শীর্ণ হাত পা ঝুলছে। সেই সাথে বিভিন্ন ছাটের সালোয়ার কামিজ পড়া মেয়েরা। পানিতে নামবার আগেই ভালো করে শর্টসের ফিতা বাঁধলাম। এর আগের বার এক মেয়ে মোটামুটি কোমর উচ্চতায় দাঁড়িয়ে ছিলো। একটা স্রোতের ধাক্কায় তার পাজামার ফিতা ছিড়ে নিম্নাঙ্গ উদোম হয়ে গেলো, সেটা স্মরণে রেখেই যাতে এমন কেলেংকারী না হয় তাই যতটা সম্ভব শক্ত করেই গিট্টু দিয়ে সমুদ্র ঝাঁপানোর জন্য প্রস্তুত।

আমার শীর্ণ শরীর দেখানোর কোনো আগ্রহ নেই, স্যান্ডেল খুলে বালিতে পা দিতেই লাফিয়ে উঠলাম। সূর্য্যের চেয়ে বালি গরম কথাটা মিথ্যা না। পানিটে নেমে চুলে গেলাম তীরে দেখা লাল পতাকার কথা। মাঝের এইটুকু জায়গা বাদ দিলে সম্পূর্ণ সৈকতটাই মানুষে পরিপূর্ণ। ভাটার তীর্যক টানে পানি কাটছে।

সমুদ্রকে ফাঁকি দেওয়ার খেলা খেলছি আমরা ৫জন। সব সময়ই ফাঁকি দিতে পেরেছি এমনও না। মাঝে মাঝে স্রোতের থাপ্পড়ে উল্টে পড়েছি। এর ভেতরেই হাঁটু ছিলেছে। কয়েকবার লোনা পানি গিলেছি।

সমুদ্রের পানিতে লবনের পরিমাণ শতকরা ১ ভাগের সামান্য বেশী। এতেই এমন মারাত্মক অবস্থা। অনেক খাবি খেয়ে যখন ফিরে আসলাম তখন প্রচন্ড ক্ষুধার্ত। পিপাসার্ত এবং লোনা পানি লেগে শরীরের চামড়ায় টান পড়ছে। এর ভেতরেই হেঁটে হেঁটে হোটেলে ফিরতে হবে।

গেটের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, বীচ থেকে ফেরার সময় যে পা ধুঁতে হবে সেটা কোথায় ধুবো। গেটের পাশেই একটা শাওয়ার, পানির প্রচন্ড তোড়। সেখানে হাত পা ধুঁয়ে হোটেলে ফিরলাম। খেতে যাবো।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।