আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কক্সবাজার ভ্রমন ০১

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

অনেক মানুষের সাথেই আমার একবারের বেশী দুইবার দেখা হয় নি, তবে প্রথম দেখায়ই একটা ছাপ রেখে চলে যাওয়া মানুষগুলোর ভেতরে একজন আছে এস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনের সদস্য। কোথাও যাওয়ার কথা উঠলেই আমার তার কথা মনে হয়। তার নাম মনে নেই, লিটন, বিল্টু, মিল্টন, অনেক কিছুই হতে পারে তার নাম , তবে বিশিষ্ট চেহারার অধিকারী এই মানুষটিকে সময়ে অসময়ে মনে পড়ে। হয়তো এই মানুষটা এখনও আস্ট্রোনলিক্যাল এসোসিয়েশনের সদস্য - তার মাথার সামনে তেমন তেজী চুল না থাকলেও পেছনে বাবরি ছিলো, লম্বায় তেমন না, মাঝারী উচ্চতা, পরনে জিন্স এবং সেটা ক্ষয়ে যাওয়া। শরীর দেখে বুঝবার উপায় নেই তার আত্মবিশ্বাস এবং তার পরিশ্রম করবার ক্ষমতা কতটুকু, শীর্ণ শরীর নিয়ে তিনি হঠাৎ একদিন আড্ডায় উপস্থিত হলেন।

বাবারী চুলের ঝোকা নিয়ে উপস্থিত হওয়া মানুষটিকে নিয়ে আগ্রহী হওয়ার যথেষ্ট কারণ না থাকলেও তখন এস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন বর্ষবরণ নামক একটা সংস্কৃতির সূচনা করেছে। বর্ষবরণ উৎসব হবে, স্থান কেওক্রাডাং, হাইকিং হবে, হিলট্রাকস নিয়ে তার স্বপ্নময় বর্ণনার মিনিট পাঁচেক পরে যখন পাহাড়ে সুর্যোদয়ের বর্ণনা শুরু হলো তখন সবার জিভ দিয়েই পানি পড়ছে। ডিমের কুসুমের মতো উদীয়মান সূর্য্য, তার চারপাশে মেয়নিজের মতো মেঘ, সব মিলিয়ে চমৎকার ডেজার্ট সমেত একটা ফুলকোর্স ব্রেকফাস্ট সূর্যোদয়ের সাথে আড্ডায় উপস্থিত হলো। প্রবল উদ্দীপনায় জিজ্ঞাসা করালম পৌঁছানোর উপায়টা কি? পথের ধকল এবং তিন হাজার ফুট উঁচু চড়াই-উৎরাই পায়ে হেঁটে পাড়ি দেওয়ার প্রকল্প শুনে তেমন আগ্রহ ধরে রাখতে পারলাম না। পিঠে বোঝা নিয়ে এইসব পরিশ্রমে, ক্যাম্পিং নিয়ে আমার তেমন কোনো আগ্রহ নেই।

আমি সমতলের মানুষ। আজীবন ১০ ফিট উঁচু ঢিবিকেই পাহাড় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে অভ্যস্ত। এইসব পাহাড় ডিঙিয়েই আমার শৈশব কেটেছে। এমন অনেক পাহাড় ডিঙানোর পরে এখন ইদানিং এইসব পাহাড় জয়ের আগ্রহে ভাটা পড়েছে আমার। তবে মুখের উপরে না বলা সম্ভব হয় না অনেক সময়ই, তাই মৌন সমর্থন জানালাম।

অবশ্যই প্রস্তাবটা বিবেচনাযোগ্য। যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসলো, আমারও একটা কল্পিত কাজের ব্যগ্রতা তৈরি হলো। আমি পাহাড়ে রাত্রিযাপন এবং সূর্যউৎসবের লোভ খসিয়ে দিব্য মুক্ত মানুষ হয়ে আড্ডা দিলাম টিএসসির দেয়ালে বসে বসে। তবে সব সময়ই এমন এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই যখন কক্সবাজার যাওয়ার প্রস্তাব উত্থাপিত হলো আড্ডায় তখন স্বভাবের দোষেই আগ্রহী হয়ে রাজি হয়ে গেলাম।

অবশ্যই যাবো। রোজার সময়ে ইফতারের পরে এই নিয়ে বন্ধুদের আলোচনা চলে, আমি আলোচনার অগ্রগতি জানতে পারি টেলিফোনে। অবশেষে একদিন ফান্ডের অর্থের পরিমাণ জানলাম। জেনে ভিমড়ি খাওয়া অবস্থা আমার। অঙ্কটা প্রথমে শুনে মনে হয়েছিলো বিষয়টা নেহায়েত রসিকতা।

তবে ক'দিন পরে উপলব্ধি করলাম আদতে বিষয়টা রসিকতার নয় বরং নিরেট সত্য। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে অধম আমি ব্যতিত আমাদের সাথে থাকা বন্ধুরা অনেকেই নতুন একটি কর্পোরেট সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। আমার টংয়ের দোকানে চা খাওয়ার অভ্যাস এখনও অব্যহত থাকলেও আমার সাথের বন্ধুদের অনেকেই এই অভ্যাস ত্যাগ করে নতুন একটি সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। ছাত্রজীবনের পরিচিত জীবনযাপনের ধারা থেকে আমি বের হয়ে আসতে পারি নি, তবে অনেকেই পরিবর্তিত হয়েছে। নিজস্ব সীমাবদ্ধতায়, কিংবা আমার সামর্থ্য নেই বলেই এই সংস্কৃতি চর্চায় আমি অভ্যস্ত নই।

তবে দেশের পরিস্থিতি বুঝে বেশ বদলে ফেলতে হয়। যেমন সঙ্গ তেমন অনুসঙ্গ মেনে নিয়েই আমার নিজস্ব প্রচলিত সংস্কৃতিকে ব্যহত না করেই আমি আড্ডা দিয়ে যাচ্ছি। আমার প্রিয় বন্ধুদের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনটুকু আয়ত্ব করতে না পারলেও, সেটাতে অভ্যস্ত হতে না পারলেও, নিতান্ত আত্মপীড়ণে ভুগতে ভুগতে নতুন সংস্কৃতি চর্চার প্রচেষ্টা করি। প্রতি নিয়ত ভেতরে লজ্জা অনুভব করি। অর্থ যতটুকু স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিতে পারে তার সবটুকু ভোগ করা কোনো ভাবেই অপরাধ নয়।

এরপরও একটা চোরা অপরাধবোধ আমাকে তাড়া করে। অর্থ সংকুলান হবে কোথা থেকে এই নিয়ে একটু চিন্তিত ছিলাম। অবশ্য গত কয়েক মাস বই না কেনায় সামান্য অর্থ সঞ্চয় হয়েছিলো, কোনো মতেই সেটা ফান্ডের সমপরিমাণ নয়। এরপরেও নিজস্ব সামর্থ বিবেচনা করলে এই ভ্রমনে আনন্দের তুলনায় অপরাধবোধই থাকতো বেশী। যাত্রার দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসে, আমার নিস্তেজ অস্তিত্ব আদৌ সমর্থন করে না।

অনেক রকম ছুঁতা খুঁজতে চেষ্টা করি, অংশগ্রহন না করবার তেমন কার্যকর কোনো অজুহাত খুঁজে পাই না। অবশ্য এতে তেমন কোনো সমস্যা হয় নি। বন্ধুর কল্যানে আমার কোনো অর্থই খরচ হয় নি এই ভ্রমনে। ঈদের পরের দিন যাত্রা শুরু হবে, আমাদের যাত্রার সূচনা হবে নটরডেম কলেজের সামনে থেকে। গ্রীন লাইনের এসি বাসে চেপে আমরা যাবো কক্সবাজার।

বাস ছাড়বে রাত ১২টায়। বৌয়ের আপত্তি অগ্রাহ্য করেই ঠিক ১১টা ৩০এ বাসা থেকে বের হলাম। আমার এখান থেকে নটরডেম পৌঁছাতে লাগবে খুব বেশী হলে ১৫ মিনিট। এর ভেতরেই বন্ধুর ফোন। ঠিকমতো আসিস, আমি পৌঁছায়া গেছি, তুই ব্যাটা জলদি আয়া পর।

ঈদের পরদিনের ফাঁকা শহরে রাত ১১টা ৩০এ শুনসান রাস্তায় আমি রিকশার অপেক্ষায় থাকি। সবারই জমা দেওয়ার সময় হয়ে গেছে। উল্টো পথে কেউ যেতে আগ্রহী না। একটা রিকশাওয়ালা রাজী হওয়া মাত্রই কোনো রকম কথা না বলে চেপে বসলাম, কায়দা করে ফোন করলাম বন্ধুকে, একটু অপেক্ষা কর, ধর ২০ মিনিট আমি পৌঁছাচ্ছি। ২০ মিনিট পার হওয়ার আগেই বন্ধুর ফোন, আমি তখন গ্রীনলাইনের কাউন্টারের সামনে।

এমন সব সময়ে অস্থিরতা বেড়ে যায় আমার। বাসের অপেক্ষা করছি, বাসের দেখা নাই। আশে পাশে অনেক যাত্রীই অপেক্ষা করছে। চিটাগাং সিলেট, কক্সবাজার, উত্তর বঙ্গ, দক্ষিণ বঙ্গ সব এলাকার বাস ছাড়ে এখান থেকে। সময় কাটানোর উপায় উদ্ভাবন করতে হয়,চা সিগারেট শেষ করেও বাসের দেখা পাই না।

ঘড়িতে সময় দেখি ১২টা। অবশেষে বাসটা এসে থামলো- আমরাও উঠে পড়লাম বাসে। গন্তব্য কক্সবাজার। ৩ দিনের কর্মসূচি নিয়ে যাচ্ছি। বাসের ভেতরে ঢুকে মনে হলো ঈগলুর ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

এমন ঠান্ডা। পয়সা দিয়ে এমন শীতের অত্যাচার সহ্য করবার কোনো মানেই হয় না। আমার এই উপলব্ধি জানানো মাত্রই আশেপাশের লোকজন ট্যারা চোখে তাকালো। আমিও নার্ভাস একটা হাসি দিয়ে বললাম- এইটা পুরা শীত কাল বানায়া রাখছে ভাই। এত পয়সা খরচ করে কেউ এই শীতের ভেতরে বসে থাকে? বিবেচক বলেই হয়তো সীটের উপরে কম্বল রাখা।

কম্বল গায়ে জড়িয়ে বাসভ্রমনজাতীয় অভিজ্ঞতা পূর্বে হয় নি, তবে যেমন অবস্থা দেখছি তাতে এই যাত্রায় সেই অভিজ্ঞতা হয়ে যেতে পারে। ১২টা ০৫: বাসটা স্টেশন ছাড়লো কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।