গতকাল ভোরে (০৯.১০.২০০৮) রাজশাহী থেকে সিল্কসিটি ট্রেনে চেপে মা-মেয়ে কে ঢাকা অব্দি এগিয়ে দিয়ে একই ট্রেনে ফিরে এলাম। ওদের গন্তব্য আরও দুরে, চট্টগ্রাম। কমসে কম ১৫-২০ দিনের সফর।
আমার পূণ্য'র মা চট্টগ্রামের মেয়ে; ওখানেই জন্ম, পড়ালেখা সব। ওখানে এখন কেউ নেই, শুধু মুরাদপুরে বড় বোন থাকেন।
গত পাঁচ বৎসর হল সে যায়না চট্টগ্রাম, কিন্তু মন সবসময় যাবার জন্য কাঁদে। কয়েক দফা প্রোগ্রাম করে ভেস্তে গেছে। হয় আমার অফিসের ব্যাস্ততা, নয় অন্য কোন কারণ। কিন্তু এবার সে নাছোড়বান্দা, যে করেই হোক, যাবেই। এদিকে আমার ব্যস্ততা; ডাকা হল বড় বোনের ছেলেকে ঢাকায়।
কাল বিকেলে সূবর্ণ ট্রেনে তারা পৌঁছেছে রাত ১২ টা নাগাদ। আর আমি সিল্কসিটিতে কাল রাত ১০টায় ফিরেছি।
বাসায় ফেরার পর থেকেই এক ধরনের শূন্যতা মনকে ছেয়ে আছে। মা-মেয়ে আমার কাছ থেকে বেশী দূরে সেভাবে থাকেনি, কারণ পূণ্যের নানা বাসা এখন রাজশাহীতেই। বাসাটা কেমন জানি খালি খালি লাগছে।
বিছানায় পূণ্যের বালিশ গুলো রাখা। সেলফে ওর বই, খেলনা। খালি মিষ্টি খিল খিল হাসি আর চঞ্চল পদচারনার শব্দ নেই। গোটা বাড়ী যেন মৃত্যুপুরী।
বাবার প্রতি সব মেয়েরই ভীষণ টান থাকে বলে জানি।
আমার মেয়েরটা যেন একটু বেশীই। আমার মা গত হয়েছেন আজ এক যুগ প্রায়। তখন মাত্র অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র আমি। তাই একটা মেয়ের জন্য খুব ব্যকুল ছিলাম। ওর জন্মের পরে (০৫.০৬.২০০৫) দীর্ঘ ৯ বৎসর পর মনপ্রাণ ভরে 'মা' ডাকতে পেরে কি যে আনন্দ লেগেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।
খুব অবাক হয়েছিলাম , মাত্র কয়েক ঘন্টার সেই ছোট্ট 'মা' তার সন্তানকে ঠিকই আলাদা করে চিনে নিয়েছিল। জন্মের কয়েক ঘন্টার মাথাতেই দেখা গেল, আমি যেদিক থেকেই 'মা' ডাকি, সে ঠিক সেদিকেই মাথা ফিরিয়ে আমাকে দেখে। সেই দৃষ্টিতে কোন অনিশ্চয়তা ছিলনা, ছিলনা লক্ষ্যভ্রষ্টতা যা নাকি সব বাচ্চার ক্ষেত্রেই প্রথম ১-২ সপ্তাহ পর্যন্ত থাকে।
(বাবার মুখ থেকে পান খাবে মেয়ে)
সেই শুরু। যত দিন গেছে, মা-ছেলের বাঁধন আরও মজবুত হয়েছে।
ও যখন মাত্র চার মাসের তখন কয়েক দিনের জন্য যাই লালমনিরহাট। কয়েকদিন বাবাকে না দেখে মেয়ে আমার সে কি বিষন্ন। ঘরে কেউ ঢুকলেই বাবা ঢুকল ভেবে আনন্দিত হয়। পরে বাবা না দেখে মন খারাপ। তার মা একবার তার কানে ফোন দেয়।
আমি এপাশে 'হ্যালো মা' বলছি। বিশ্বাস হবে কি না জানিনা, স্পষ্ট ওপার থেকে 'বাবা' ডাক ভেসে এল! আমি তো বিস্ময়ে হতবাক মাত্র চার মাসের শিশু সে ! তার মা ও আশা করেনি এটা। সেও বিমুঢ় হয়ে গেছিল। তার পরদিনই বাসায় ফিরি। ভুল শুনেছিলামনা সেদিন।
বাসায় এসে আবার একই ডাক শুনে নিশ্চত হই।
মেয়ে আমাকে আব্বু, বাবা, বাবি, বাবেই, বেবে, বাবুই নানা নামে ডাকে তবে তার প্রিয় ডাক হল 'ব্যাটা'। আর ভালবাসে ডালটন বলে ডাকতে।
(কযেক মিনিট আগে প্রথম হাঁটার আনন্দ চোখে মুখে, ১২.০৮.২০০৬)
কাল যখন এয়ারপোর্ট স্টেশনে ওরা আমাকে রেখে গাড়ী করে উত্তরাতে যাচ্ছিল (সিল্কসিটি পৌঁছে দুপুর ২ টায়, সূবর্ণ ছাড়ে বিকেল পৌনে পাঁচটায়ম আমার ট্রেন আবার আধা ঘন্টা পরেই, তাই বিদায় পর্ব ওখানেই সারা হল। ) পূণ্যের মায়ের এক কলেজ জীবনের বন্ধু, স্বামী সহ উত্তরায় থাকে তার বাসায় ফ্রেশ হবার জন্য, তখনও মা আমার জানেনা বাবা আর সাথে আসছেনা।
বাবা কেন গাড়ীতে তার সাথে উঠলনা, এক অদ্ভুত বিষন্ন প্রশ্নবোধক দৃষ্টি তার চোখেমুখে লক্ষ করলাম। গাড়ী থেকে যতক্ষন দেখা গেছে, পূণ্য মা আমার পেছন ফিরে বাবাকে দেখছে; বাবা দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। এর আগের পথে যতবার তাকে বলেছি, 'মা তুমি আমাকে রেখে চট্টগ্রাম যাচ্ছো?" তার উত্তর, "তুমিওতো যাচ্ছো"। তার এই নিশ্চিত ভঙ্গির কারনেই বিদায়ের সময় তাকে 'বাই' বলে বিদায় দিতে পারিনি। পরে শুনলাম, সে বাবাকে খুঁজেছে চট্টগ্রামের পথেও।
সারা পথ শুধু 'বাবা কেন সাথে আসছেনা', 'স্টেশনে থেকে গেল কেন', 'বাবা কি হেঁটে হেঁটে আসবে', 'কখন আসবে'- প্রশ্নের পর প্রশ্নবানে জর্জরিত করেছে মা'কে।
আজ একদিন হয়ে গেল। খালামনির বাসায় ভালই আছে, বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু থেকে থেকেই বাবার খোঁজ আর বাবার সাথে কথা হলেই, 'বাবা তুমি আস, আসছনা কেন?"
অনেকেই এমন চাকুরী করেন যে ট্যুরে বাইরে প্রায়ই যাওয়া পড়ে, অনেকের শ্বশুরবাড়ি দূরে তাই সন্তানেরা কয়েকদিনের জন্য নানাবাড়ী, দাদা বাড়ী যায়। আমার ক্ষেত্রে এ দু'টো কম ঘটে।
তাই মেয়ের বিরহে খুব কাতর লাগছে। কবে আমার মা কে আবার দেখব সেই দিন গুনছি।
আমার মেয়েকে অবশ্য তার মা আগেই সাইন ব্লগে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, তাই নতুন করে পরিচয় দিলাম না, ব্লগার রাত্রী আমার মেয়ের মা ।
Click This Link
আমার কয়েকটা প্রিয় ছবি।
'পূণ্য মা' তোমাকে খুব মিস করছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।