আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে সেনাপ্রধানের পাঁচালিঃ কৃষির সামরিকীকরণ? (২য় পর্ব)



প্রথম পর্ব বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তাঃ প্রথম আলোর নিবন্ধ আগেই জানিয়েছি প্রথম আলোর নিবন্ধটি তার শিরোনাম তথা বিষয়গত গুরুত্ব এবং নিবন্ধের লেখক উভয়ের কারণেই বিশেষ মনোযোগের দাবী রাখে। আমার কাছে নিবন্ধটি বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর কৃষি সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি বই কিছু নয়। সেখানে সাধারণভাবে কৃষি বিষয়ে- খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে আপাত ভালো ভালো কিছু বলার চেস্টা হয়েছে, একজন সচেতন নাগরিকের উদ্বেগ ফুটে তুলার চেস্টাও আছে, আছে কৃষকের প্রতি দরদ। আছে সমস্যার কারণ খোঁজার চেস্টা এবং সমাধানের কিছু পরামর্শ। এতকিছুর পরেও বলতে হবে- এসবে শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে, কেননা এসবই হয়েছে শাসকগোষ্ঠীর সেই চিরচেনা পদ্ধতিতে।

আর সেকারণেই, এই নিবন্ধে সমাধানকল্পে যেসমস্ত পরামর্শের কথা আছে, আশংকা হয়- সেগুলো নিছক পরামর্শ, নাকি শাসকগোষ্ঠীর শীঘ্রই বাস্তবায়ন করতে যাওয়া পদক্ষেপ বা ইতোমধ্যেই বাস্তবায়িত পদক্ষেপ নয়তো? শুরুর প্যারতেই আমরা পাই, সেই চেনা পদ্ধতির অনুসরণ- প্রথমে সমস্যার ভয়াবহতার কথা, সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়ার প্রচণ্ড তাগিদের কথা। এপর্যন্ত ঠিক আছে, সবসময়ই ঠিকই থাকে- কিন্তু এরপরেই যা পাই তা হলো শাসকগোষ্ঠীর নেয়া গৃহীত পদক্ষেপের পক্ষে গাওয়া সাফাই এবং তাদের আগামীতে নিতে যাওয়া পদক্ষেপসমূহের পক্ষে একধরণের প্রচারণা, যাকে বলা যেতে পারে শাসকগোষ্ঠীর পদক্ষেপগুলোকে সাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেস্টা। তিনি বলেন, "....আপাদমস্তক সমস্যায় জর্জরিত এ দেশের এমন কিছু সমস্যা আছে, যা নিয়ে এখনই কাজ না করে যদি অপেক্ষা করে থাকি, তাহলে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব। তেমনি একটি বিষয় হলো খাদ্যনিরাপত্তা। ...... আমাদের যে পরিমাণ খাদ্যশস্য দরকার, তা যদি আমরা উৎপাদন করতে না পারি, তাহলে খাদ্যঘাটতি হবেই"।

খুবই যৌক্তিক ও প্রত্যাশিত অবস্থান। এধরণের কথা বর্তমান প্রেক্ষাপটে সকলেই আশা করেন, ফলে আগ্রহ জন্মে, কিভাবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিৎ করা সম্ভব, কিভাবে আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন করতে পারি- সেসম্পর্কে তিনি কি বলেন তার প্রতি আকর্ষণ তৈরী হয়। তিনি অনেক কিছুই বলেছেন, কিন্তু যা কিছু বলেছেন তা কি শুরুর এই আগ্রহ ও আকর্ষণ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে? ধীরে ধীরে সেটিই দেখার চেস্টা করবো। রাষ্ট্র তথা সরকারের ভূমিকা কতখানিঃ সেনাপ্রধানের নিবন্ধের সূচনা বক্তব্যে (প্রথম দু প্যারার আলোচনায়) দেখা যায়- তিনি যেমন জানাচ্ছেন খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তেমনি- সেটি অর্জনের কিছু দাওয়াইও সংক্ষেপে বাতলে দিয়েছেন। একই সাথে তিনি সমস্যার কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন।

কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে এসমস্ত আলোচনা যখন আসে, তখন প্রথমেই প্রশ্ন আসে এ সংক্রান্ত রাষ্ট্রের ভূমিকা কি হওয়া দরকার ছিল, তার কতখানি রাষ্ট্র পালনে ব্যর্থ হয়েছে এবং ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে রাষ্ট্রের পদক্ষেপ কতখানি কি হবে। রাষ্ট্র তথা সরকারের ব্যাপারেও আলোচনা আমরা সেই নিবন্ধের সূচনা বক্তব্যেই পাই, "....১৫ কোটি মানুষের দেশে ১৫ কোটি মুখ। এ মুখে খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের; কিন্তু সীমিত সামর্থ্য নিয়ে সরকারের পক্ষে একা এ দায়িত্ব পালন করা কতটুকু সম্ভব? প্রতিদিন খাবারের মুখ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আনুপাতিক হারে আবাদযোগ্য জমি কমছে। বাড়তি মুখের এ খাবার জোগাতে সরকারকে তার সামর্থের সবটুকু ঢেলে দিতে হচ্ছে। কিন্তু পুরো পৃথিবীর খাদ্যনিরাপত্তাই যেখানে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, সেখানে আমাদের মতো দরিদ্র দেশের সীমিত সামর্থ্য এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটুকু সমর্থ হবে? এর উত্তর আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে।

আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে"। এই অংশটুকু আমার মনে হয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেনাপ্রধানের সমস্ত নিবন্ধটির পেছনকার দৃষ্টিভঙ্গি এখান থেকেই পাওয়া যায়- বস্তুতপক্ষে এতো আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোর শাসকগোষ্ঠীরই দৃষ্টিভঙ্গি। "সীমিত সামর্থ্য", "দারিদ্র্য" এসমস্তের অযুহাত তুলে সরকারের ভূমিকাকে আড়াল করা এবং মূল দায় জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার ("আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে"। ) এই চেস্টা আজকের নয়। আবাদযোগ্য জমি কিভাবে কমছে, খাদ্যঘাটতি কেন হচ্ছে এবং সম্প্রতি আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা এভাবে হুমকির সম্মুখীন কেন হলো- এসব কিছুতে রাষ্ট্র তথা সরকার ব্যবস্থার ভূমিকা কি- ব্যর্থতা কতখানি এ প্রসঙ্গকে সযত্নে আড়াল করে, তাই সেই নিবন্ধে খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের জন্য যে দাওয়াই পাই তার সার-সংক্ষেপ অনেকটা এমনঃ "চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়াতে হবে, জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, উচ্চ ফলনশীল বীজ ও আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি প্রয়োগ করে ফলন বাড়াতে হবে।

সর্বোপরি জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে এনে দেশের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে"। সূচনা বক্তব্যের এই অংশটুকুই পরবর্তীতে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন- বিস্তারিত আলোচনায় তার যুক্তি তুলে ধরেছেন। আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধিঃ খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং এক্ষেত্রে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি অবশ্যই করতে হবে- উল্টোভাবে বলতে হলে, বর্তমানে আমরা দেশে প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য হারে চাষযোগ্য জমি হারাচ্ছি- যাতে করে দিন দিন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি হুমকির মুখে পড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে যেকোন আলোচনায় এ প্রসঙ্গটি খুব গুরুত্বের সাথে আলোচিত হওয়ার দাবী রাখে। সেনাপ্রধানের নিবন্ধটিতেও এই বিষয়টি এসেছে গুরুত্ব সহকারে, শুরুর দিকেই।

তিনি সঠিক তথ্যই আমাদের জানান, "১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, আর আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৯৯ লাখ হেক্টর। বর্তমানে জনসংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ১৫ কোটিতে, আর জমির পরিমাণ কমে হয়েছে ৬৬ লাখ হেক্টর। ৩৬ বছরে জনসংখ্যা হয়েছে দ্বিগুণ, আর আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে এক-তৃতীয়াংশ"। কিন্তু এই আবাদি জমির পরিমাণ ক্রমশ হ্রাসের কারণ কি? সেসম্পর্কে তিনি বলছেন, "বিভিন্ন কারণে আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে। অনেক জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, অনেক জমিতে ঘর উঠেছে, কলকারখানা বসেছে, পেট্রল পাম্প, সিএনজি স্টেশন, এমনকি মোবাইল টাওয়ার বসাতেও নষ্ট হয়েছে অনেক জমি।

অধিক মুনাফার লোভে আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে গ্রামের সড়ক। একই জমি বংশানুক্রমে খণ্ড-বিখণ্ডিত হয়েছে, নতুন আইল পড়েছে। শুধু আইলের কারণে সারা দেশে কী পরিমাণ জমি নষ্ট হচ্ছে!" আরো বলছেন, "একটি মোবাইল টাওয়ারে সব ‘মোবাইল অপারেটর’ স্থান করে নিলে বেঁচে যেত অনেক জমি। কমিউনিটি পদ্ধতিতে চাষ করলে বাঁচানো যেত আইলের জমি। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে আইলের জমিটুকু কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

আমি চট্টগ্রামে ‘আইল চাষ’ পদ্ধতিতে শিমের ব্যাপক চাষ হতে দেখেছি। সারা দেশে যদি এ আইল চাষ ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে বেঁচে যেত সবজি লাগানোর জমি, সেখানে চাষ করা যেত অন্য কোনো শস্য। " কি চমৎকার- আমরা সমস্যা দেখলাম, কারণ জানলাম এবং সমাধানও পেয়ে গেলাম! কত সহজেই সমস্ত কিছু বেরিয়ে আসলো! কিন্তু আসলেই সমস্ত বিষয়টি এত সহজ ও সরল? চাষযোগ্য জমিতে কলকারখানা, পেট্রল পাম্প, সিএনজি স্টেশন, মোবাইল টাওয়ার বসেছে সত্য, কিন্তু এই চাষযোগ্য জমি তো কৃষকের হাতেই ছিল এবং সেখানে গড়ে উঠা কলকারখানা-সিএনজি স্টেশন-পেট্রল পাম্প-মোবাইল টাওয়ারের মালিকও নিশ্চয় তারা নয়। তাহলে এই প্রশ্ন কি আসে না যে, কেন কৃষক তাদের একমাত্র সম্বল, আবাদি জমিটুকু কলকারখানার মালিক, পেট্রল পাম্পের মালিক এর কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে? সেই বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে আলোচনা করা হলে প্রকৃতই কি সমাধান সম্ভব? স্বাধীনতার পর থেকে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ যেমন কমেছে, তেমনি বেড়েছে ভূমিহীনের সংখ্যা। আজ আমাদের চাষীদের বড় অংশই ভূমিহীন, অর্থাৎ যে জমিতে তারা শ্রম দেয়- সেই জমির তারা মালিক নয়।

কেন এমন হলো? আমাদের চাষীরা কি স্বেচ্ছায় জমি ছেড়ে দিয়েছে? নাকি বাধ্য হয়েছে? এ প্রশ্নের সমাধান না খুঁজে, মোবাইল টাওয়ারে জমির নষ্ট কমানো- আইল চাষ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে কি আমরা আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়াতে পারবো? সেনাপ্রধান জানিয়েছেন, "বিন্দু বিন্দু পানি জমেই তো সৃষ্টি হয়েছে মহাসাগর। আপাতদৃষ্টিতে ক্ষুদ্র মনে হলেও এমন অসংখ্য ক্ষুদ্রের সমষ্টিই আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করবে"- কিন্তু জমার খাতায় বিন্দু বিন্দু আর খরচের খাতায় যদি থাকে স্রোতের গতি- তবে মহাসাগর গড়া তো মহাকল্পনা, তাতে মহাসাগরই ধু ধু মরুতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। কেন কৃষি অলাভজনক, কেন কৃষকেরা চাষাবাদ করে খরচটুকুও তুলতে পারে না, কেন চড়া সুদে ঋণ নিয়ে প্রতিবছর চাষ করতে হয়- ফসল উঠার সাথে সাথে ঋণ শোধ করতেই সব শেষ হয়- পরের বছর আবার আরো বেশী ঋণ- এবং শেষ পরিনাম সহায় সম্বল চাষের জমিটুকু হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়- কেন? সরকারের কি এখানে কোন দায় নেই? সরকারের দায়ের কথা সেনাপ্রধানের আলোচনায় পাশ কাটানোটা কি ইচ্ছাকৃত? তা নাহলে, খাদ্য নিরাপত্তার আলোচনায় একবারের জন্য কৃষি বাজেট নিয়ে আলোচনা কেন হবে না? কৃষি বাজেট দিন দিন কমেছে, কমেছে কৃষি ভর্তুকি, কৃষি ঋণ। রাষ্ট্র এ দায় থেকে প্রতিবারই মুক্ত হতে চাচ্ছে, বিশ্বব্যংক-আইএমএফ এর পরামর্শে তথা সাম্রাজ্যবাদীদের প্রভাবে লাগামহীন মুক্তবাজার অর্থনীতির জোয়ার এবং তারই ফলাফল কৃষকদের দেউলিয়া হওয়া। সে ধারা আজতক বিরাজমান।

তাহলে, এ প্রসঙ্গকে আড়াল করা মানে কি এই নয় যে, আগামীতেও সেটি একইভাবে বজায় থাকবে? সেনাপ্রধানের আলোচনায় আমি তারই আলামত পাই, সেকারণেই সরকারকে ধরা ছোয়ার বাইরে রাখা, সেকারণেই জনগণের কাঁধে দায় তুলে দেয়া। "আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে"। আর একারণেই সেনাপ্রধানের পুরো প্রবন্ধটিতে সন্দেহ ও আশংকাই এসে ভীড় করে। কৃষি ও কৃষক বাঁচানোর কথা বেশ কয়েকবার থাকলেও- এতে ব্যবসায়ী শ্রেণীর স্বার্থই প্রধানত রক্ষার চেস্টা দেখা যায়। তাই তিনি যখন বলেন,"জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে", তখনও নিশ্চিন্ত হতে পারিনা।

"এ জমির সবটুকু ক্ষমতা নিংড়ে বের করার ব্যবস্থা করতে হবে", "এক ফসলি জমিকে দু-তিন ফসলিতে রূপান্তর করতে হবে। প্রয়োজনে শস্যবিন্যাস পরিবর্তন করতে হবে", "উচ্চ ফলনশীল বীজ ও আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি প্রয়োগ করে ফলন বাড়াতে হবে" এসব কথায় আরো ভয়ংকর ভবিষ্যতের ছবিই চোখে ভেসে উঠে। তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের সময়ও এসমস্ত শ্লোগান আমরা শুনেছি- তার চরমতম ফল ভোগ করেছে আমাদের কৃষকেরা, এর মধ্য দিয়ে জমিকে নিংড়ে নেয়ায় আমাদের অনেক ফসলি জমি হয়েছে রিক্ত, পতিত, সার-কীটনাশকের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি খরচ বেড়েছে জ্যামিতিক হারে, আর উল্টোদিকে মুনাফাখোর ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বাগিয়ে নিয়েছে মুনাফার পাহাড়। জমির সর্বোত্তম ব্যবহারের কথা আমিও বলি- কিন্তু এর মানে আমি বুঝি আমাদের প্রধান শস্য ও রবি শস্য চাষের সুসমন্বয়, নাইট্রোজেন সাইকেলের কথা বিবেচনা রেখেই শস্যবিন্যাস এবং প্রয়োজন মাফিক জমির বিশ্রাম। কিন্তু সেনাপ্রধান তার আলোচনায় "জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে" জানিয়ে পরক্ষণেই সর্বোত্তম ব্যবহার যে অর্থে দাঁড় করিয়েছেন তাতে এখন পর্যন্ত কৃষি নিয়ে শাসকগোষ্ঠী যা যা করে এসেছে তার ব্যতিক্রম কোন চিত্র পাওয়া যায়নি বলেই আমার মনে হয়েছে।

আলু নিয়ে তামাশাঃ বিগত খাদ্য সংকটের সময়টিতে যখন আমাদের দেশে আলুর বাম্পার ফলন হলো- তখন আমাদের সরকার এবং সেনাবাহিনী একযোগে জনগণের সাথে তামাশা করেছে। চালের সংকট, দিনকে দিন চালের দামের উর্ধ্বমুখী হওয়া, হতে হতে জনগণের সাধারণ ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়া, ব্যবসায়ী মজুতদারদের চুটিয়ে ব্যবসা করা- এসমস্তই ঢাকা পড়ে যায় এই তামাশা ও নাটকে। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের আহবান জানিয়ে- প্রতিদিনই আলু খাওয়ার পক্ষে নানারকম প্রচারণা চালানো শুরু করে দেয় সরকার। সেনাপ্রধানের আলোচ্য প্রবন্ধটিতে সেই তামাশার একটি বিবরণ দেখি, ".....আমরা যদি বছরের এ সময়টিতে আলুর ব্যবহার বাড়িয়ে দিই, তাহলে একদিকে যেমন কৃষক বাঁচবে, অন্যদিকে চালের ওপর চাপ কমবে। এ জন্যই গত বছর আলুর বাম্পার ফলনের পর আমার শ্লোগান ছিল, ‘আলু খান, কৃষক বাঁচান’।

হল্যান্ডের মতো একটি উন্নত দেশের প্রধান খাদ্য যদি আলু হতে পারে, তবে আমরা কেন বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় ভাতের সঙ্গে আলু খাওয়া বাড়াতে পারব না? এ জন্যই আমি বলেছি, ‘ভাতের সাথে আলু প্রতিদিন’"। কোন অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে দীর্ঘদিনের অভ্যস্ত জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে, যার সাথে সে অঞ্চলের জলবায়ু- সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন কৃষিকাজ- উৎপাদন এসমস্তই জড়িত। হঠাৎ করেই এটির পরিবর্তনের কথা কোন শাসকগোষ্ঠীই কি বলতে পারে? হল্যাণ্ড বা আফ্রিকার মানুষ পারলে আমরা কেন পারবো না এ ধরণের আলোচনা কি এখানকার জনগণের সাথে তামাশাস্বরূপ নয়? আর আমাদের এখন পর্যন্ত প্রধানতম ফসল কিন্তু আলু নয়, ধান। এবং আমাদের মোট চাহিদার সিংহভাগ কিন্তু আমরাই উৎপাদন করতে পারি। সেনাপ্রধানের আলোচনাতেও আমরা দেখি, "শুধু চাল আর গমের ক্ষেত্রেই আমাদের বার্ষিক খাদ্যশস্যের চাহিদা ২•৬ কোটি মেট্রিক টন।

এ বছরের বোরোর বাম্পার ফলনে আমরা উৎপাদন করেছি ২•৫৯ কোটি মেট্রিক টন খাদ্যশস্য। সে হিসাবে আমাদের ঘাটতি এক লাখ মেট্রিক টন মাত্র"। গত বছরে ‘সিডর’-এর তাণ্ডবে এক রাতেই ১৮ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়েছে ধরলেও ঘাটতি দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ২০ লাখ মেট্রিক টন (অন্য ফসল আমন-আউশ বাদ দিয়েই)। অর্থাৎ ২.৪ কোটি মেট্রিক টন অর্থাৎ ৯২.৩% শস্য আমরা নিজেরাই উৎপাদন করেছি - অথচ মাত্র ৭.৭ % এর ঘাটতির কথা বলে, সেটা আমদানীর কথা বলে, আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত তুলে- চালের দাম হু হু করে বাড়িয়ে দেয়া হলো। সেটাকে কৌশলে সমর্থন যোগাতেই আলু নিয়ে তামাশাটা করে সরকার।

জনগণের মধ্যে এই ধারণাটাই পোক্ত করতে চায় যে, চালের আসলেই বিশাল সংকট- ফলে আলু খাওয়া ছাড়া উপায় নেই; এবং এটির সাথে সাথে যেটি সরাসরি তারা বলেনি- বা বলার দরকার পড়েনি, সেটি হলো চালের যেহেতু প্রকৃতই সংকট মুহুর্ত চলছে এবং আলু খেয়ে বাঁচা লাগবে- সেহেতু চালের এই উচ্চমূল্য থাকাটাই স্বাভাবিক। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা এই সরকারের আমলে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর লুটপাটের একটি চিত্র আমরা আবুল বারাকাতের আলোচনায় পাই, "বিগত ১ বছরে বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্যের দাম ২৫% থেকে ৩০০% পর্যন্ত বেড়েছে। এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে বিগত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে ৫ বছরে গড়ে প্রতি বছর ৫৭ হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে, সেখানে এই তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে বছরে গড়ে ৭০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে বলা যেতে পারে"। (২) কৃষকের প্রতি দরদঃ শাসকগোষ্ঠী যখনই কৃষি নিয়ে কথা বলেছে, কৃষকদের জন্য উদ্যোগ নিতে গিয়েছে, তখনই কৃষকের প্রতি দরদের বিষয়টি সবচেয়ে সামনে এসেছে। সমবেদনা এসেছে, দেখে মনে হয় আমাদের কৃষকদের দুঃখ দুর্দশায় তারা যেন কত চিন্তিত।

এভাবেই তারা কৃষকদের অধিকারের প্রসঙ্গটিকে আড়াল করেন, আড়াল করে কৃষকদের দাঁড় করিয়ে দেন দয়া-দাক্ষিণ্যের পাত্র হিসাবে। আলোচ্য প্রবন্ধটিও তার ব্যতিক্রম নয়। পুরোটি পড়লে যে কেউ খুব সহজেই কৃষকদের প্রতি আমাদের সেনাপ্রধানের একটি দরদী মন খুঁজে পাবে, যেমনটি পাওয়া যায় প্রতিটি বাজেট বক্তৃতায় কৃষি সংক্রান্ত আলোচনায়, পাওয়া যায় কৃষি মন্ত্রণালায়- কৃষি অধিদপ্তরের প্রতিটি হোমড়া চোমড়ার কথায়-বক্তৃতায়-আলোচনায়, পাওয়া যায় সরকারের-শাসকগোষ্ঠীর প্রতিটি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির কৃষি সংক্রান্ত আলোচনা-মন্তব্যে। সেনাপ্রধানের প্রবন্ধটিতে তাইতো অসংখ্য দাওয়াই দেয়া হয়েছে কৃষকদের বাঁচানোর কথা বলেই। সেরকম শ্লোগান "আলু"কে কেন্দ্র করে তারা তুলেছিলেন, "আলু খান, কৃষক বাঁচান"।

এ কিন্তু শুধু সেনাপ্রধানের কৃষক দরদী হওয়া নয়- এ আমদেরকেও অনুরূপ কৃষক দরদী বানানোর চেষ্টা। আমাদের প্রয়োজন হোক বা নাহোক, আমাদের ভালো লাগুক বা না লাগুক- আলু খেতে হবে, কেননা এতে কৃষক বাঁচবে! কিন্তু, কৃষকদের অপরাপর জনগণের দয়ার পাত্র হিসাবে উপস্থাপন না করে কি সরকার দায়িত্ব নিতে পারতো না? আমাদের টিসিবি কে অথর্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে কেন? সরকার নিজে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে আলু তথা যেকোন শস্য না কিনলে কি ভোক্তারা বাজার থেকে আলু তথা শস্য কিনলে কৃষক বাঁচবে? আবুল বারাকাতের সূত্র মতে, উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যন্ত আট-দশটি হাত বদলায় এবং এর মধ্য দিয়ে গড়ে ৪১% এর বেশী মূল্য বৃদ্ধি ঘটে(৩)। ফলে সরকার নিজে শস্যপণ্য কেনার উদ্যোগ না নিলে, সেসব যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না নিলে এবং নিজ উদ্যোগে বিপননের দায়িত্ব না নিলে কি কৃষক বাঁচবে? একই ভাবে, দাদন ব্যবসা নিয়ে কথা বলতে গিয়েও সেনাপ্রধানের দরদী চেহারাটা আমরা দেখি। তিনি বলেছেন, "দেশে দাদনের প্রচলন সেই অনেক আগে থেকেই। যারা দাদন দেয় তাদের চুক্তি থাকে ১০০ টাকায় প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে সুদ দিতে হবে এবং ফসল যা হবে তা তাদের কাছে বিক্রি করতে হবে।

অসহায় কৃষককে শোষণ করার কী নির্মম ব্যবস্থা! কৃষকদের এ অসহায়ত্ব আমাকে স্পর্শ করেছে"। এই আলোচনা পড়ার সাথে সাথে কৃষকদের অসহায়ত্ব নিশ্চিতভাবে পাঠকদেরও স্পর্শ করবে। কিন্তু এ থেকে বের হবার উপায় কি? সরকারের করণীয় কি এ আলোচনা না করলে, সেই দরদ শুধু লোকদেখানোই হয় বলে আমার মনে হয়। চড়া সুদের দাদন ব্যবসা কি নামমাত্র সুদে পর্যাপ্ত সরকারী কৃষি ঋণ ব্যতীত বন্ধ করা সম্ভব? দাদন ব্যবসায়ীরা যদি এই চড়া সুদের ঋণ সুদাসল সহ অনেকগুণ বর্ধিত আকারে আদায় করতে পারে, তবে কেন সরকারী ব্যবস্থাপনায় আদায় করা সম্ভব হবে না? সামরিক তত্ত্বাবধান কিসের আলামতঃ কৃষির সামরিকীকরণ? সেনাপ্রধানের প্রবন্ধটিতে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ ভাবে দৃষ্টি চলে যায়। সেরকম কিছু কথা দেখিঃ "সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে শস্যবিন্যাস পরিবর্তন করে এক ফসলি জমিকে দু-তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরের মাধ্যমে ফরিদপুর জেলায় মাত্র এক বছরেই অতিরিক্ত ১২ হাজার হেক্টর এবং সিলেট জেলায় অতিরিক্ত ৪৩ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে।

.....আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে দেশের ৬৪টি জেলাতেই এ পরিবর্তন করা সম্ভব"। "...কৃষির উপকরণ সুলভ ও সহজলভ্য করতে সব রকমের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সেনাবাহিনী প্রতিটি উপজেলায় সার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। ফলে গত বছর কোনো সার সংকট হয়নি"। "....আমি সেনাবাহিনী দিয়ে ওই ফসলগুলো দ্বিগুণ দামে বিক্রি করে তাদের ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করেছি।

ঋণ প্রদানকারী সংস্থা থেকে শতকরা চার টাকা হিসাবে ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছি....."। "...সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে চাঁদপুরের ঘোড়ামারা এলাকায় নদীতে ভাসমান খাঁচা দিয়ে মৎস্য চাষ করে প্রভূত সফলতা অর্জন করা গেছে"। প্রশ্ন আসে, কৃষি বিষয়ক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব কি সেনাবাহিনীর? কৃষি মন্ত্রণালয়, বিএডিসি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারী নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব কেন সেনাবাহিনীর হয়ে যাবে? বিশেষ সময়ে বিশেষ প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে সরকার তলব করতে পারে, তবে যে কাজে তলব করবে সেই কাজে নিয়োজিত সরকারী প্রতিষ্ঠানকেই তো তত্তাবধানের দায়িত্বে থাকতে হবে! এর ভিন্নটি যখন দেখি তখন নানাবিধ সন্দেহ মনে এসে ভীড় করাটাই কি স্বাভাবিক নয়? শস্যবিন্যাস বা একফসলী জমি থেকে দু-তিন ফসলী জমিতে রূপান্তরের নামে চাষাবাদ পর্যায়েও সেনা তত্ত্বাবধান- এক জেলা থেকে ৬৪ জেলাতেই তার প্রসারের ঘোষণা (পরামর্শের আদলে), কৃষি উপকরণ (সার-সেচ-কীটনাশক) সরবরাহ, এমনকি মৎস্য চাষেও সেনা উপস্থিতি-তদারকি তথা তত্তাবধান আসলে কিসের আলামত? সন্দেহকে আরো বাড়িয়ে দেয় যখন দেখি বলা হয়- সেনা তত্তাবধানে কোন সার সংকট হয়নি। যেখানে সারের দাবীতে কৃষকদের অসন্তোষ-বিক্ষোভের কথা মিডিয়ায় নানাসময়ে প্রচারিত হয়েছে, এমনকি সরকারী হিসাবমতেও আমাদের এখানে সারের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে স্পষ্ট গ্যাপের কথা স্বীকার করা হয়- সেখানে সেনাপ্রধানের "কোন সার সংকট হয়নি" কথাটি আমাদের মধ্যে ভীতিরই সঞ্চার করতে পারে। তাহলে কি এটাকে এখনও পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় অংশের মানুষকে (দেশের মোট জনসংখ্যার ৭৬% বাস করে গ্রামাঞ্চলে, আর গ্রামাঞ্চলের ৯০% মানুষ জীবিকার জন্য সরাসরি কৃষি খাত ও কৃষিসংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের উপর নির্ভরশীল।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সর্বাধিক কর্মসংস্থানের খাতটি হচ্ছে কৃষি। বিগত ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৫১.৬৯%-ই হয়েছে কৃষিখাতে) সেনাবাহিনীর নজরদারিতে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা হিসাবে দেখবো? তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে যাতে এরকম গায়ের জোরে অস্বীকার করা যায়- সেকারণেই কি এই আয়োজন? (বাকি অংশ পরের পর্বে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.