আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জ্ঞানীর দায়িত্ব, ল্যাংটা বাবা, গোয়েবলস ও বর্তমানের আস্তিক নাস্তিক প্রোপাগান্ডা

আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
কিছুদিন আগে ন্যাটজিওতে একটা প্রোগ্রাম দেখলাম “The Indian Witch”, বাংলায় যা হবে ‘ভারতীয় ডাইনী’। সেই প্রোগ্রামে এক ল্যাংটা বাবাকে দেখিয়েছিল যে কিনা কাল যাদু (Black Magic) জানে। ঐ বাবার দাবী কালযাদুর জ্ঞান দিয়ে সে যেকোন মানুষকে মেরে ফেলতে পারে, অনেক দূর থেকেই। তবে সে বিনা প্রয়োজনে সেটা করে না কারন এতে তার জ্ঞানের মর্যাদাহানি ঘটে। যদিও ঐ প্রোগ্রামে দেখানো হয় লোকটা ভূয়া কিন্তু তার একটা কথা আমার ভাল লেগেছেলি।

তা হল, ‘জ্ঞান হল মানুষের উপর একটা দায়িত্ব, এটাকে খুব যত্ন করে লালন করতে হয় এবং মানুষের উপকারে ব্যবহার করতে হয়’। উক্তিটি খুবই গুরুত্বপূর্ন বিশেষ করে বর্তমান পেক্ষাপটে। পৃথিবীতে সব মানুষ জ্ঞানি হয় না, কিছু লোক হয়। তাদের বাকিরা অনুসরণ করে। তারা যদি জ্ঞানের অপব্যবহার করেন, তার অনুসারীরা তাই করে।

বিধায় প্রথম ব্যক্তির (যে কিনা জ্ঞানি) অপরাধ মানুষের উপর অনেকগুন বর্ধিত রুপে কাজ করে। এর উলটোটিও সত্য। যে কোন জ্ঞানী ব্যক্তির ভাল কাজ অনেক অনেক মানুষ অনুসরন করে বিধায় জ্ঞানীর জ্ঞানের প্রভাব বহুগুনে বৃদ্ধি পায়। এমনি এক জ্ঞানী মানুষ হিটলারের তথ্য মন্ত্রী যোসেফ গোয়েবলস। ইহুদি নিয়ন্ত্রিত এই বিশ্বে হিটলার ও তার সাথিরা চরমভাবে ঘৃণ্য এবং সেই সাথে আলোচিত।

তবে গোয়েবলসকে যে যাই বলুক, উনি যে অত্যন্ত জ্ঞানি ও মেধাবী ছিলেন সেটা উল্লেখ করতে কেউ ভোলে না। আমি এ পর্যন্ত নানান বইতে, ইন্টারনেটে যেখানেই গোয়েবলস্‌ সম্পর্কে কিছু পড়েছি তার শুরুতেই বলে নেওয়া হয় লোকটা অনেক মেধাবী ও জ্ঞানী ছিল। তারপর বলা হয় সে যা করেছে তা ঠিক করে নাই, সে খুব খারাপ ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই ধরে নিচ্ছি গোয়েবলস্‌ আসলেই খুব মেধাবী ও জ্ঞানীই ছিলেন। এই ব্যক্তির বিশেষ অবদান হচ্ছে, মিথ্যাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবার অত্যন্ত ফলপ্রসু পদ্ধতি উদ্ভাবন।

১৯৪৫ সনে হিটলারের ব্যাংকারে সপরিবারে আত্মহত্যা করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও বর্তমান বিশ্বে সবচাইতে প্রভাবশালী দার্শনিক মূলত গোয়েবলস। পশ্চিমা বিশ্বে এরিস্টোটলের দুইহাজার বছর ধরে যে প্রভাব বিদ্যমান ছিল, আমাদের এই বিশ্বে গোয়েবলসের প্রভাব তার চাইতে কমতো নয়ই বরং অনেক অনেক বেশী। মিথ্যা প্রচারে গোয়েবলসের পদ্ধতি হল, প্রথমে একটা কনফিউশন সৃষ্টি কর, তারপর ব্যাপক প্রচার কর। একসময় মিথ্যাটাই সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। বার বার মানুষের কানের কাছে একটা রেকর্ড বাজাতে থাক কাজ হবেই হবে।

যতই নিন্দা করি গোয়েবলসের সত্যিই এ এক নিঁখুত অস্ত্র। গোয়েবলসীয় দর্শনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হল ‘আজকের দুনিয়ার মার্কেটিং’। যার মূল মন্ত্র , ‘স্যাব কুচ বিকতাহে, ব্যস এক বেচনে ওয়ালা চাহিয়ে’ (হিন্দি সিনেমার পপুলার ডায়লগ)। যেমন, রিমো নামে ভারতের এক মিউজিক ডিরেক্টর আছে যিনি আধুনিক ধুমধাড়াক্কা গান কম্পোজ করেন। তার একটা গান (কোনটা তা মনে নাই) এক সময় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।

আমার মা সেই গানটা কোথাও বাজতে শুনলেই বিরক্ত হয়ে কিছু অবশ্যই বলত। মা বলত, কোথায় সেই হেমন্ত, কিশোর, লতা, এসডি বর্মন, আশা আর কোথায় আজকের এই ফালতু রিমো। একদিন হঠাৎ খেয়াল করি আমার মা রান্নাঘরে তরকারি কুটছে আর গুন গুন করে রিমোর সেই ধুম ঢাড়াক্কা গানটাই গাচ্ছে। খুবই অবাক হলাম আমি সেদিন। অদ্ভুত! তবে সত্যি হল এই যে, বার বার টিভিতে, গানের দোকানে বাজাতে বাজাতে মানুষের মস্তিস্ককে ঐ গান ভাল লাগাতে বাধ্য করা হয়েছে।

আমার এক বন্ধুর বাবা কোকাকোলা কম্পানিতে চাকরি করতেন মিডলইস্টের কোন দেশে। তখন কোকের দাম ছিল ১০টাকা। উনি নাকি বলেছিলেন, এই ১০ টাকার মধ্যে কিছু অংশ ট্যাক্স, ২ টাকার জিনিস বোতলের ভিতরে আর বাকিটা আমির খান, শাহরুক খান, কারিনারা বিজ্ঞাপন করে নিয়ে যায়। বার বার বিজ্ঞাপন দেখিয়ে আমাদের তৃষ্ণার সময় পানি না কিনে কোক-পেপসি প্রভৃতি কিনতে বাধ্য করা হয়। কিছুদিন আগে History চ্যানেলের একটা প্রোগ্রামে দেখলাম আমেরিকা তার so called সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে যে সব ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে গুয়ান্তেনামো জাতীয় কারাগারে বন্দি রাখে তাদের কানের কাছেও নাকি আমেরিকার জয়গান করা নানা ধরনের গান অবিরত বাজতে থাকে।

উদ্দেশ্য একটাই বন্দিদের মনে আমেরিকার জন্য শ্রদ্ধা বা ভয় জাগ্রত করা আর পন্থা সেই গোয়েবলসীয়। তবে গোয়েবলসের তত্ত্বের সব চাইতে নোংরা ব্যবহার ঘটে রাজনীতিতে। ডান, বাম, সাম্প্রদায়িক, অসাম্প্রদায়িক, ধার্মিক, ধর্ম নিরপেক্ষ, আস্তিক, নাস্তিক কেউ কারো চাইতে এখানে কম না। যেমন আমাদের দেশে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়নি এই প্রোপাগান্ডা যতটা শক্তিশালি ঠিক ততটাই শক্তিশালি পোপাগান্ডা হচ্ছে আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল। যেখানে একটা গ্রুপ রবীন্দ্রনাথকে কবি সাহিত্যিক থেকে মহাপুরুষ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক অন্যদিকে আর একটা গ্রুপ খুব পোক্ত ভাবেই অশিক্ষিত জনসাধারণের মাঝে এটা প্রতিষ্ঠিত করেছে যে রবীন্দ্রনাথই হিংসা করে নজরুলকে অসুস্থ করেছিলেন।

অনেক ক্ষেত্রেই এই ব্যাপার গুলো হাস্যকর কিন্তু গোয়েবলসীয় প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে এইগুলোই বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হয়েছে। স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, আমি নিজেও কলেজ পর্যন্ত এই জানতাম যে রবীন্দ্রনাথই নজরুলকে হিংসা করে অসুস্থ করেছিলেন। কে যেন একবার এক ব্লগে লিখেছিলেন, তার দারোয়ান বিশ্বাস করে কবি নজরুল ভাল লোকই ছিল, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মেয়েকে বিয়ে করেই বারোটা বাজিয়েছে। আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক বন্ধু বিশ্বাস করে হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ আর একবার বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হতে চায়, কারন সে নাকি তার সুইস ব্যাংকের একাউণ্টে সিগনেচার দিয়েছে “রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ” লিখে। তাই এরশাদ আর একবার রাষ্ট্রপতি হিসেবে সিগনেচার দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে চায়।

এই হচ্ছে শিক্ষিত মানুষের অবস্থা, অশিক্ষিতদের কথা বাদ। সাধারন মানুষ এরকমই বিধায় তারাই গোয়েবলসের অনুসারীদের টার্গেট। গোয়েবলসীয় তত্ত্বকে সব চাইতে বেশি ব্যবহার করেছে তার বস হিটলারের সারা জীবনের শত্রু ইহুদীরা। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! যে হিটলার, গোয়েবলস ইহুদীদের পৃথিবী হতে নিশ্চিহ্ন করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন, তাদের তত্ত্বই আজ ইহুদীদের বিশ্বে শক্তিশালি করতে ভূমিকা রাখছে। সামরিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী আমেরিকাকে কুক্ষিগত করে ইহুদিরা এখন বিশ্বে খুবই শক্তিশালি।

যুগের পর যুগ যেই খ্রিস্টানদের দ্বারা ইহুদিরা নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়ে আসল তারাই এখন ইহুদিদের হাতের পুতুল। তাদের সব চাইত বড় শত্রু এখন ইসলাম। অথচ, বিগত ১৪ শত বছরে ইহুদিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্ম পালনের সুবিধা পেয়েছে মুসলমানদের থেকে। মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে সব চাইতে বড় বাধা যেখান থেকে আসছে সেটা হল মুসলমানদের মধ্যে ধর্ম ভিত্তিক একতা। তাই ইহুদি মিডিয়ার সব চাইতে বড় টার্গেট স্বয়ং ইসলাম ধর্ম।

তবে সেটা নাস্তিকতার মোড়কে ইসলামের বিরুদ্ধে চলে। গোয়েবলসের তত্ত্ব অনুসরণ করে ইহুদিদের মিডিয়া প্রথমে ধর্ম সম্পর্কে কিছু নেগেটিভ ব্যাপার ফুটিয়ে তোলে, যা মানুষকে যাচ্ছেতাই করতে বাধা দেয়, তারপর কিছু প্রশ্ন তোলে। এরপর শুরু হয় সেগুলোর ব্যাপক প্রচার টিভিতে, সিনেমায়, ইন্টারনেটে নানান ওয়েব সাইটে, সেই সাথে কিছু পেইড কালামিস্ট দিয়ে সংবাদপত্রে এবং হয়ত বা ব্লগেও। আবার এমন কিছু ইসলামী ওয়েব সাইট পাওয়া যায় যেগুলোতে খুব সুন্দর ভাষায় ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা প্রচার করা হচ্ছে, অথচ এই সবগুলোর উৎস একই। ব্যাপার গুলো এমনভাবে সাজানো হয় যে অমুসলিমরা দেখলে ভাববে সবই ইসলাম ধর্মের খুত, তাদের ধর্মেতো এমন নেই।

অন্যদিকে সাধারণ মুসলমানেরা ভাববে এইগুলা ধর্মের খুত, চল সবাই নাস্তিক হই। এই সবই মহান গোয়েবলসের তত্ত্বের ফসল। এই সবের প্রমান পাওয়া যায় দুটি ব্যাপার লক্ষ্য করলে: ১ বেশির ভাগ নাস্তিকের প্রশ্ন ইসলাম কেন্দ্রীক। ভাবটা এমন যেন বিশ্বে অন্য কোন ধর্ম নেই। ২ নাস্তিকদের প্রশ্নে কোন বৈচিত্র নেই।

গুগল, ইয়াহুতে atheist লিখে সার্চ দিলে খুব সহজেই নাস্তিকদের যেইসব প্রশ্ন গুলো পাবেন সেগুলোই দুনিয়াভরের নাস্তিকেরা কপচাতে থাকে নানান মিডিয়াতে। আবার এই ক্ষেত্রে ধর্ম ব্যবসায়ীরাও কিন্তু পিছিয়ে নেই। তাদের অনেকেরই গুরু সেই মহান গোয়েবলস। নানান মিডিয়ায় (টিভি চ্যানেল, ইন্টারনেট, সংবাদপত্র এমন কি ব্লগ) এরাও সৃষ্টিকর্তার প্রমান, কোন ধর্ম ভাল, কোনটা খারাপ, বিজ্ঞানের কি কি নেওয়া যায়, কি কি বাদ দেওয়া যায় প্রভৃতি নিয়ে দোকান খুলে বসেছে। অনেকে আবার সিডি/ডিভিডি বা চটি বইয়ের ব্যবসাও করে থাকেন।

আমাদের ব্লগীয় কিছু এছলামী ব্লগার ও নাস্তিকতা নামক ধর্মে বিশ্বাসী ব্লগার উভয় গ্রুপই ঐ সব ওয়েবসাইট থেকেই ডাইরেক্ট কপিপেস্ট মারেন। ধর্ম সম্পর্কে যদি কারো প্রশ্ন থাকে তবে নিজেই তার উত্তর খোজ চেষ্টা করা উচিত। ওদের রেফারেন্স মত চলে বিভ্রান্ত হওয়া খুবই ক্ষতিকর। এটা আস্তিক ও নাস্তিক (যারা কোন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন না তাদের কথা বলছি, নাস্তিকতা ধর্মে বিশ্বাসীদের কথা বলছি না) উভয়ের ক্ষেত্রেই সত্য। অহেতুক অর্ধ শিক্ষিত মোল্লা-মুন্সি বা প্রোপাগান্ডাকারি নাস্তিকতা ধর্মে বিশ্বাসীদের সাথে তর্ক করে সময় নষ্ট করার কোন মানে নাই।

কারন তারা এসেছে ব্যবসা করতে। গোয়েবলস সত্যিই জ্ঞানী ছিলেন, কিন্তু জ্ঞানের দায়িত্ব নেবার যোগ্যতা তার ছিল না। ফলশ্রুতিতে, তার জ্ঞানের খেসারত আমাদের আজো দিতে হচ্ছে। তিনি যদি একই তত্ত্ব সত্য প্রচারে ব্যবহার করতেন তবে হয়ত আজকের বিশ্ব অন্যরকম হতে পারত। তাই বলি লেখাপড়া শেখাবার সাথে সাথে এটা আমাদের উপর যে অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করে তা বুঝানোও জরুরি, নইলে জ্ঞানের অপব্যবহার চলতেই থাকবে।

(আমার যা বলার তা বললাম, এখন যার যা ইচ্ছা বলতে থাকেন। )
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।