এম জে আকবর
তর্জমা : রাহাদ আবির
বিশ্বে মুসলমানদের পরিণাম নিয়ে আল্লাহ উদ্বিগ্ন হলে মুসলিম দেশগুলোর নেতাদের নিয়ে একটি কনফারেন্স ডাকলেন। সেখানে ইরাকের প্রেসিডেন্ট আল্লাহর কাছে একটাই প্রশ্ন রাখলেন, হে মহামহিম, কবে আমি আমার দেশে শান্তি ও সৌভাগ্যের দেখা পাব? আল্লাহ করুণাপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে চাইলেন এবং উত্তর দিলেন, তোমার সেই শান্তি ও সৌভাগ্য আসতে প্রায় একশ বছর লাগবে। ইরাকি প্রেসিডেন্ট হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন, হায় হায়, আমি বেঁচে থাকতে তা দেখে যেতে পারব না! পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টও তার দেশ নিয়ে একই প্রশ্ন রাখলেন। আল্লাহ বললেন, পাকিস্তানে শান্তি ও সৌভাগ্য আসতে প্রায় দেড়শ বছর লাগবে। একথা শুনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তো কপাল চাপড়ে কাঁদতে লাগলেন, সে উন্নতি দেখতে আমি তো ততদিন বেঁচে থাকব না।
এরপর ছিল বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের পালা। হরতাল, অস্থিরতা, অচলাবস্থা এবং দুঃখ-দুর্দশা ও নিরাশার জলে দেশটি আকণ্ঠ নিমজ্জমান, এর থেকে বের হওয়ার কেউ আর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না। তিনি তাই জানতে চাইলেন, বাংলাদেশ কখন এর প্রতিষ্ঠাতা পুরুষদের স্বপ্নভূমিতে পরিণত হবে? এবার আল্লাহ নিজেই কাঁদতে শুরু করলেন।
আবেগি ঢাকাবাসীদের একটি প্রিয় স্বভাব হচ্ছে নিজেকেই নিজে উপহাস করা। যেমন বাংলাদেশের প্রধান দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া পরস্পরের বিরোধিতার দরুন দেশে যে রাজনৈতিক সংকট তৈরি করেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না।
তারা একে অন্যকে এতটাই ঘৃণা করেন যে সেটা অনেকটা হত্যার নামান্তর। তবে বিষয়টা তাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ের হলে তাতে কারো কোনো ক্ষতি ছিল না। কিন্তু সেটা রাজনীতির ভিতর ঢুকে পড়ায় পুরো দেশটিই অচল অবস্থায় পরিণত হয়েছে এবং তার ফলে প্রায় সেনাবাহিনীর শাসন কায়েম করতে হয়েছে। কিন্তু শহুরে বাঙালির তেজোদীপ্ততাকে রুখবে সাধ্য কার? ঢাকা শুধু একটি সম্ভবনাময় দেশের রাজধানীই নয়, একটি মননশীল সমাজেরও রাজধানী।
ঢাকায় এখন একটি আলোচনার বিষয় হলোÑ শহরে কি স্কার্ফ বা বোরকা পড়া মেয়ের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে? অবশ্য এসবের ব্যবহার আগে থেকে থাকলেও বাংলাদেশী নারীরা সাধারণত বোরকাকে অবহেলা করেই এসেছে।
তরুণী মেয়েরা বেশ ফ্যাশনেবল পোশাক পরে যতটা তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা মেনে নেয়। আর বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংগুলোতে তো যৌনাবেদময়ী মেয়েদের সরব উপস্থিতি। তারপরও বোরকার ব্যবহার নাকি বেড়ে চলেছে, হয়তো গুলশানের উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে নয়, শহরের অন্যান্য অংশে। আমার এক চিন্তাশীল বন্ধু এর অন্যরকম এক ব্যাখ্যা দাঁড় করাল। একেবারেই রক্ষণশীল কিছু মহিলারা যারা আগে বাইরে বের হতো না, তারা হয়তো এখন বোরকা পরে বেরুচ্ছে।
তার মানে এ ক্ষেত্রে অগ্রসরতা বেড়েছে এবং তার ফলে দেখা যাবে এসব মহিলাদের মেয়েরা একসময় বোরকা পরা ছেড়ে দিচ্ছে। গ্রামের চিত্রের দিকে তাকালে ব্যাপারটা বোঝা সহজ হবে। গ্রামে বোরকা পরা পারিবারিক স্বচ্ছলতার চিহ্ন। গ্রামের দরিদ্র মহিলাদের কাজ করে খেতে হয়, তাই তাদের পক্ষে পর্দা নেয়ার বিলাসিতা করা সম্ভব না। তবে যখন তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটে তখন তারা সামাজিক পদমর্যাদার জন্য বোরকা পরা শুরু করে।
তবে এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবের যে ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে সেটি অস্বীকার করার জো নেই। সৌদি আরবে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি কাজ করে। এসব শ্রমিকরা তাদের মা-বোন-বউদের জন্য দেশে যেসব উপহার পাঠায় সেই তালিকার প্রথমেই থাকে বোরকা।
বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক কর্মী; কমিউনিজমের ওপর তিনি অনেক বইপত্র লিখেছেন। তার বাবা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহকর্মী, যিনি মুসলিম লিগের একজন নামকরা নেতা ছিলেন এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগেরও নেতা হন।
বদরুদ্দীন ভাষা আন্দোলনের ওপর কয়েকটি ভাল বই লিখেছেন যেগুলো অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বের হয়েছে। ঠিক এই কারণেই আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম এবং তার সাথে আমার কথাবার্তার মূল বিষয়ও ছিল এটি। তার ড্রইংরুমে স্ট্যালিনের একটি পোট্রেট আঁকা, সেই সারিতে তার বাবারও একটি পোট্রেট রাখা। আমি বলে ফেললাম, এই সময়ে বসে স্ট্যালিনের রাজনৈতিক মতাদর্শ মেনে নেয়া যায় না। তিনি নির্দ্বিধায় বললেন, আমি স্ট্যালিনকে শ্রদ্ধা করি।
মানুষ বলে সে কয়েক লক্ষ লোককে হত্যা করেছে। তার জায়গায় আমি হলে হয়তো সে সংখ্যাটা আরেকটু বাড়ত। শেষ বাক্যটি বলতে গিয়ে তিনি টুক করে হেসে দিলেন। তার মানে এ হত্যার সাথে স্ট্যালিনের ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল না, সেটা ঘটেছিল সময়ের প্রয়োজনে।
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুস তার ক্ষুদ্র-ঋণ প্রণালীর মাধ্যমে বাংলাদেশে দৃশ্যত এক ধরণের বিপ্লব করে ফেলেছেন যেটি তাকে সারা বিশ্বে সুনাম এনে দিয়েছে।
তবে বদরুদ্দীন উমর সেটাকে সুনাম না বলে দুর্নাম বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তার মতে ক্ষুদ্র-ঋণ ব্যবস্থা আগেকার মহাজনি ব্যবসার চেয়েও খারাপ। এটা হচ্ছে পুঁজিপতিদের গরীবদের ওপর প্রতারণার নতুন খোলস। তিনি মোহাম্মদ ইউনুসের শতকরা ২০ ভাগ সুদ নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করলেন। ১৯৯১-এর সেপ্টেম্বরে মোহাম্মদ ইউনুস বলেছিলেন, হ্যাঁ, আমরা শতকরা ২০ ভাগ সুদ নেই, কেউ যদি মনে করে সুদের হার অনেক বেশি, তাহলে বেশি।
এতে আমি মোটেও লজ্জিত নই। সবচে বড় কথা, আমরা তো টাকা নেয়ার জন্য কাউকে জোর করি না। বদরুদ্দীন উমর মজা করে বললেন, আগেকার মহাজনেরাও তাদের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার জন্য কাউকে জোর করতেন না। গ্রামীণ ব্যাংক কেবল ঋণের ফি হিসেবেই ৮ কোটিরও বেশি টাকা এর সদস্যদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে। এই টাকা এবং সুদের টাকাÑ শেষমেষ এগুলো যায় কোথায়? ভাল প্রশ্নই করেছেন বদরুদ্দীন উমর।
বদরুদ্দীন উমর সব বিষয়েই প্রবন্ধ লিখেছেনÑ মার্কসীয় অভিধানে যেসব বিষয় মানব শোষণের হাতিয়ার বলে পরিচিতÑ সাম্রাজ্যবাদ, প্রতিক্রিয়াশীলতা, বুর্জোয়াতন্ত্র প্রভৃতি।
ঢাকার রাস্তার লম্বা ট্রাফিক জ্যাম দেখে কি বোঝা যায়? সেটা কি বাংলাদেশের উন্নয়নের নিদর্শন নাকি হতাশ হওয়ার? আমি মনে করি দুটোইÑ নব্য ধনিক শ্রেণীরা গাড়ি কিনছে কিন্তু সেই সাথে পাল্লা দিয়ে সরকার নতুন অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারছে না। আসলে ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা কখন তৈরি হয়? ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা দেখা যাওয়া মানে বুঝতে হবে শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গাড়ি কেনার সামর্থ্য আছে। তবে ট্রাফিক বিশৃঙ্খলার জন্য যে নগরীর রিকশার বড় ভূমিকা রয়েছে তা ভুললে চলবে না। তারা একটা কাজ খুব ভালোমতো পারেÑ একটু সুযোগ দিলেই বাবলার আঠার মতো রাস্তায় জ্যাম বাঁধিয়ে দেবে।
ট্রাফিক জ্যামের জন্য দেরি হওয়াকে এখন আর কেউ অজুহাত বলে মানতেই চায় না। ফলে যাদের দেরি হয় তাদেরকে চেষ্টা করতে হয় তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার। নগরীর স্বাভাবিক রূপটির দেখা মেলে একমাত্র সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে। এই সমস্যার কেবল একটিই সমাধান রয়েছে, তা হলো সাপ্তাহিক ছুটি তিনদিনে বৃদ্ধি করা এবং সেটা পর্যায়ক্রমে ভাগে ভাগে দেয়া। শহরের এক অংশে একদিন ছুটি থাকবে, অন্য অংশে আরেক দিন।
কাজের দিনগুলোতে শুধু অর্ধেক জনগোষ্ঠী কাজ করবে। এতে উৎপাদন বেড়ে যাবে প্রায় দ্বিগুণ।
এবার একটি গোপন ঘটনার কথা বলা যাক। বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার কিছু উচ্চ পর্যায়ের নির্বাচিত অতিথিকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানালেন। এটার মধ্যে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই।
হাই কমিশনাররা তাদের দেশের কর্মকা-ের অংশ হিসেবে মাঝেসাঝেই এরকম ভোজের আয়োজন করে থাকে। মজার ব্যাপার হলো ভোজ অনুষ্ঠানটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। কারণ যার সম্মানে এ আয়োজন তিনিই এলেন না। কারণ কী? নিরাপত্তার কারণে তিনি নাকি আসলেন না। আর সেই সম্মানিত অতিথি হলেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড মিলিবেন্ড।
সাবাই নাম জানলাম কীভাবে? কারণ সব পত্রিকাতেই সকালে পররাষ্ট্র সচিবের ছবি দেখা গেছে। বর্তমানে নিরাপত্তার বিষয়টি একটি হাস্যকর অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটিশ হাই কমিশনের নিরাপত্তাওয়ালাদের কি ধারণা ছিল আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে কেউ একজন ভেতরে ভেতরে সন্ত্রাসী? যে কিনা সম্ভাব্য সুস্বাদু খাবারের কথা মুখ-ঢাকা কোনো বেনামী সন্ত্রাসীর কাছে ফাঁস করবে? আমি জানি না এই আমন্ত্রণ পেয়ে কারও মধ্যে ভয় কাজ করেছিল কিনা। তবে এটা জানি অনেকের এ ঘটনা শুনে হাসতে হাসতে পেট ফাটার যোগাড় হবে।
এম জে আকবর ভারতীয় কলামিস্ট, দ্য এশিয়ান এইজ’র সম্পাদক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।