আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভয়াল ২৯ শে এপ্রিলের স্মৃতিঃ প্রেক্ষিত অরক্ষিত উপকূল।

ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত একটি গ্রাম। আজ সেই ভয়াল ২৯শে এপ্রিল । ১৯৯১ সালের এই দিনে পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যায় স্মরণকালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়। আমার এখনো মনে আছে। তখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি।

আমাদের একতলা পাকা কাছারি ঘরে (মেহমান খানা) গ্রামের প্রায় সবাই আশ্রয় নিয়েছে। কাছারি ঘরের সামনে পুকুরের ঘাটের পাশে ৪টি বড় আম গাছ ছিল। আমি আম্মির কোলে বসে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখছিলাম পূর্ব দিকের জানালার বিশাল গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে আকাশে বজ্রপাতের বিদ্যুৎ চমকানি। বাতাসের গতি এত বেশি ছিল আমগাছের পাতা গুলো ছিড়ে আকাশে উড়ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব গাছের পাতা বাতাসের তোড়ে উড়ে গিয়ে গাছ গুলোকে শীতে গাছের পাতা ঝরে যাওয়ার পর যে অবস্থা হয় ওরকম কংকালসার হয়ে গেল।

। এলাকায় একটি প্রচলিত লিজেন্ড কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগেই আমাদের বংশের ভিটার তেমন বেশি ক্ষতি হয় না। আমাদের পূর্ব পুরুষরা ছিল মাঝি। মাঝি মানে মাছ ধরার কিংবা খেয়া পারাপারের মাঝি নয়। তাদের ছিল বিশাল সব সওদাগরি বোট।

বাণিজ্যিক নানা পণ্য নিয়ে ব্যাবসার পসার ঘটাতে নীল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাণিজ্য করত মায়ানমারের রেঙ্গুন, আকিয়াব, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি পূর্ব দেশীয় শহরে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে সওদাগরদের মাঝি বলা হয়। ওনারা উপলব্ধি করেছিলেন সমুদ্রের পাড়ে টিকে থাকতে হলে কি ধরণের জায়গায় ভিটে তৈরি করতে হবে। বোধ হয় একারণে আমাদের ভিটেটা এলাকার অন্য গ্রাম থেকে একটু উঁচু জমিতে অবস্থিত। সকালে দেখলাম আমাদের বাড়ীর আশে পাশে গাছ পালা উপড়ে পড়ে আছে।

সবখানে কাঁদা। পশ্চিমের পুকুরের পাড়ের লম্বা নারিকেল গাছগুলোর অনেকগুলো কাত হয়ে পড়ে রয়েছে। অনেক গুলো নারিকেল গাছের ডাল ভেঙ্গে আশে পাশে পড়ে আছে। সামনের পুকুর পাড়ের আমগাছ গুলোর তেমন ক্ষতি হয়নি। শুধু পাতাগুলো উড়ে গেছে।

বাড়ীর বিশাল রেইন-ট্রি গাছগুলোর ডাল ভেঙে পড়ে আছে এখানে সেখানে। বাঁশ এবং কাঠের তৈরি পুরনো লম্বা বাড়ীটার টিনের কিছু চাল উড়ে গেছে। আশে পাশে কাদা। পুকুরের পানি ঘোলাটে হয়ে গেছে। সন্দ্বীপ উপকূলে ভেসে আসা লাশ।

আমরা পিচ্চিরা দল বেঁধে পশ্চিম পুকুরের পিছনে গেলাম। রাস্তায় ঢেউ আঁচড়ে পড়ছিল। যেদিকে চোখ যায় ঘোলা পানির সমুদ্র। মাঝে মাঝে দ্বীপের মত একটা দুটো বাড়ি ভগ্ন ধ্বংসস্তূপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম আমাদের ভিটেতেই পানি উঠেনি।

বেশির ভাগ বাড়ী পানিতে নিমজ্জিত। পরে জেনেছি সাগরের ভেড়ি বাঁধ ভেঙ্গে গেছে তাই জলোচ্ছাসের পানি আর সাগরের জোয়ারের পানি লোকালয়ে চলে এসেছে। অনেক ছোট ছিলাম তখন। ৪ কি ৫ বছর বয়স। তাই মানুষের জীবনহানি কিংবা ক্ষয় ক্ষতির চেয়ে আমরা পুরো ব্যাপারটিকে আনন্দ করার কিংবা পুরনো গ্রামকে নতুন রূপে দেখার একটা উত্তেজনার মধ্যে ছিলাম।

পুকুর পাড় থেকে শুরু করে বাড়ির আশে পাশে ফলের বাগান, ঝোপ, গোয়ালঘরের আশে পাশে যেদিকেই যাই ঝুনা নারিকেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাতাসে গ্রামের সব গাছের নারিকেল ঝরে পড়ে এখানে উড়িয়ে এনে ফেলেছে। আমাদের পিচ্চিদের দলে বয়সে যারা একটু বড় তারা নারিকেল কুড়িয়ে এনে কেটে খাচ্ছিল। পশ্চিম পুকুরের পানি লবণাক্ত হয়ে গিয়েছিল। জলোচ্ছাসের ঢেউ পুকুরে আচঁড়ে পড়েছিল।

কক্সবাজারে ১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ে সর্বস্ব হারিয়ে ত্রাণ নিতে আসা অপেক্ষমান কয়েকজন। (ফাইল ফটো) আমাদের আশে-পাশে তেমন লাশ ভেসে আসেনি হয়ত। আর এসে থাকলে অনেক ছোট ছিলাম বলে ব্যাপারগুলো বুঝিনি। কয়েকদিন পর থেকে দেখলাম আমার চাচারা , চাচাত ভাইয়েরা জাল দিয়ে মাছ ধরছিল। পুকুরে বিশাল সাইজের সামুদ্রিক কোরাল মাছ, লাক্ষা মাছ, বাড়া মাছ, চইক্কা মাছ, চিংড়ি প্রভৃতি সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যাচ্ছিল।

অনেকে বলছিল মাছগুলো মরা মানুষের লাশ খেয়েছে। তাই ওগুলো খাওয়া উচিত হবে না। আমার এখনো মনে আছে আমি পশ্চিমের পুকুরে ওই সময় জ্যান্ত লইট্টা মাছ দেখেছিলাম। দল বেঁধে সাঁতার কাটছিল। লইট্টা মাছ অনেকটা তুলার মত নরম।

সাগরের পানি থেকে বোটে তুললেই মারা যায়। এটা একটা বিরল অভিজ্ঞতা ছিল আমার। সংস্কারবিহীন ভেড়ি বাঁধে অব্যাহত ভাঙ্গন। ছবিটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালীর উপকূলীয় প্রেমাশিয়া গ্রামের। আস্তে আস্তে পানি নেমে যাচ্ছিল।

বেশ কয়েকদিন পর পানি নেমে গেল। কিন্তু সাগরে জোয়ার আসলে পানি লোকালয়ে চলে আসত। তবে আগের মত উন্মত্ত অবস্থাটা ছিল না। আব্বু এলাকার রাজনীতি এবং সমাজ সেবার সাথে যুক্ত । অনেক এন জি ও আমাদের কাছারি ঘরে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে এসেছিল।

পুরনো কাপড় ছিল বেশি। প্রতিদিন বিকেলে উরার (গোয়াল ঘরের ) সামনের মাঠে দূর্গতদের এসব ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হত। আমার এখনো মনে আছে সকালে আমাদের ভাতের পরিবর্তে চিড়া দেয়া হত। অনেক পরে বুঝেছি সাগরের পানিতে ঢুবে প্রায় সবার গোলার ধান নষ্ট হয়ে গেছে। চালের সংকট চলছিল সবখানে।

একটু যখন বড় হয়েছি, স্কুলে ভর্তি হয়েছি তখন আমার আম্মি, চাচীরা রাতে চাঁদের আলোয় বাড়ির উঠানে গল্পের আসরে ওই ঘূর্ণিঝড়ের কথা বলত। কারো আত্মীয়, বোন, বাবাকে ঘূর্ণিঝড়ে বঙ্গোপসাগর খেয়েছে। আমার এক মামা কক্সবাজার উপকূল থেকে সাগরের পানিতে ভেসে সূদূর নোয়াখালীর কাছে সন্দ্বীপের উপকূলে পৌঁছে শুধুমাত্র একটি কাঠের খন্ড ধরে। প্রায় ১৫ দিন পর ওনাকে খুঁজে পাওয়া যায়। অনেক মহিলার লাশের সাথে শুধু লুঙ্গির মত থামীটি ছিল।

শরীরের অনেক অংশ পঁচে গলে গিয়েছিল। এত লাশ আমাদের গ্রামের মানুষ আগে কখোনো দেখেনি। অরক্ষিত ভেড়ি বাঁধের ভাঙ্গনে সাগরের করাল গ্রাসে একটি প্রাচীন মসজিদ। ছবিটি বাঁশখালী উপকূলের। যখন আরো বড় হলাম তখন দেখলাম ভেড়ি বাঁধটি ঠিক করা হয়েছে।

সাগর পাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত প্যারাবনে নতুন গাছ লাগিয়েছে উপকূলীয় বনবিভাগ। । সরকার যায় সরকার আসে। রাজনীতি এবং লোভের নোংরা খেলায় প্যারাবন এখন কেটে সাফ করে সেখানে লবণ মাঠ করেছে এলাকার ক্ষমতাশালীরা। সেই '৯৩-৯৪ এ ভেড়ি বাঁধ ঠিক করেছে।

এর পর '৯৭ এ আবার ঘূর্ণিঝড়, সাগরের ভাঙ্গন এসবে ভেড়ি বাঁধ সংস্কার জরুরী হলেও বাজেটের টাকা মেরে দেয় নির্বাচিত এমপি। কাগজে কলমে ''সংস্কার'' হয়ে গেছে। এই সংস্কারের বলি হচ্ছে প্রেমাশিয়া, খানখানাবাদের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। গ্রামের পর গ্রাম সাগরে বিলীন হচ্ছে। সাগরে বিলীনের অপেক্ষায় আছে মোঘল আমলে নির্মিত একটি সুরম্য মসজিদ।

১৬৬৬ সালে বার্মার কাছ থেকে চট্টগ্রাম দখলের পরো সাঙ্গু নদীর ওপারে দক্ষিণ চট্টগ্রাম আরো প্রায় ১০০ বছর বার্মার অধীনে ছিল । মুঘলরা দক্ষিণ চট্টগ্রাম অধিকার করে অনেক স্থাপত্য নির্মাণ করে। এগুলোর প্রত্মতাত্ত্বিকভাবে অমূল্য। এধরণের অনেক স্থাপনা সাগর গ্রাস করে চলেছে এখনো। আমাদের এ অঞ্চলে দেশের অন্যান্য এলাকার লোকেরা সাগর, পাহাড় দেখতে পর্যটনে আসে।

এর বাইরের আসল রূপটি কেউ দেখে না। সরকার থেকে শুরু করে কোন মানবধিকার কর্মীকেই দেখলাম না উপকূল রক্ষার জন্য এসব দূর্নীতির বিরুদ্ধে একটা কথা বলতে। এ অঞ্চলের মানুষের পূর্ব পুরুষরা দূর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এ অঞ্চলে এসে আবাদ করে লোকালয় বানিয়েছে। তাদের নির্মিত শত শত বছরের পুরনো দক্ষিণ চট্টগ্রামের সভ্যতা এতদিন টিকে আছে। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এসব জলোচ্ছাস, ঘূর্ণিঝড়ের মাঝেও সৃষ্টিকর্তা আমাদের টিকিয়ে রাখবেন।

সাগরের এই মায়াবী রূপের আড়ালে আছে সবকিছুকে গ্রাস করার বিধ্বংসী ক্ষুধা।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।