যারা উত্তম কে উচ্চকন্ঠে উত্তম বলতে পারে না তারা প্রয়োজনীয় মুহূর্তে শুকরকেও শুকর বলতে পারে না। এবং প্রায়শই আর একটি শুকরে রুপান্তরিত হয়।
এসএসসি আর এইচএসসির ফলাফল যখন প্রকাশিত হয় তখন যাদের সত্যিকার আগ্রহ নিয়ে দেখি তারা হলেন সেইসব দৃঢ় মুখ যারা ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পাননি, প্রয়োজনীয় বইগুলো কিনতে পারেননি, এক বেলা বা আধ বেলা খেয়েছেন, এক কাপড়ে বছর পার করেছেন, পরিবারের আয়ের জন্য নানাকাজে যুক্ত থেকেছেন, প্রতিবেশীর বাড়ীর আলোয় পড়ালেখা চালিয়েছেন এবং নানাভাবে যাদের পড়ালেখা থেমে যেতে চেয়েছে নানা সময়। তবুও এই সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে ভালো ফলাফল করেছেন। এঁদের অদম্যতায় আমার ঈর্ষা হয়, গভীর এক মমত্ব নিয়ে এই মুখগুলোর দিকে আমি তাকিয়ে থাকি, আমার নিবিড় শ্রদ্ধা জাগে, মধ্যবিত্তীয় কাঁচা কাঁচা আহা উহু করার সাহস আমার হয় না।
শিক্ষা ব্যবস্থার তথাকথিত বড় বড় তর্কগুলো এক নিমিষেই চোখের সামনে থেকে হাওয়া হয়ে যায়, বটম লাইন এভাবে নগ্ন উপস্থিত হলে কোন তর্কই কোন অর্থ তৈরী করতে সক্ষম হয় না। বরং আজকের খাবারটা কিভাবে জুটবে, আজকের পড়াটা কিভাবে হবে, আজকের আব্রুটা কিভাবে রক্ষা পাবে সেটাই বিবেচ্য হয়ে ওঠে। শ্রেণীগত দূরত্বের মানুষজনের পক্ষে এই উপলব্ধিটা প্রায়শই খুব দুরুহু অথবা এই দূরত্বে তারা সুখী। তারা অপারঙ্গমতার এমনসব বয়ান দেন যা শুনলে বোঝা যায় শ্রেণী কিভাবে দুটো ভিন্ন বিশ্বজগতই তৈরী করে না করে ভিন্ন উপলব্ধি জগৎও।
পত্রিকায় প্রকাশিত হবার আগ পর্যন্ত শিক্ষিত মধ্যবিত্তীয় উপলব্ধি জগতে এই অদম্যতার প্রবেশ প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে, এই অদম্যতা হয়ত তাদের বিচলিতও করে।
এই প্রবেশও তাই পরনির্ভরশীল ব্যবস্থাপনার আরেকটি উপকরণ মাত্র। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে কি উচ্চ বা মধ্যবিত্ত কি এসব বুঝতে পারে না? সেটা পারে নিশ্চয়ই, তবে নিজের সুযোগ সুবিধা মত পারে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে উভয়ের বটম লাইন এক জায়গায় নয়। ফলে স্বল্প সংখ্যক সংবেদনশীল গোষ্ঠীতে যে কর্মতৎপরতা দেখা যায় তা কোন এক সুবর্ণার, কোন এক সজলের, কোন এক লিয়ার শিক্ষা চালু রাখার সাহায্য করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
খুবই ইউটোপীয় আর রোমান্টিক শোনাতে পারে তবুও বলি, এবারে যেভাবে পাশের হার বেড়েছে তাতে নতুন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি এমনিতেই কঠিন।
তবুও এই অসাম্যমূলক পরিস্থিতিতে আমি ভর্তির বাছাইয়ে অদম্য মেধাবীদের এগিয়ে রাখতে চাই। আমি মনে করি একই ফলাফল করা অন্য শিক্ষার্থীর চাইতে তাদের জন্য ভর্তি হবার সুযোগ বেশি থাকা উচিৎ। তাদের আনুষাঙ্গিক সাহায্য সহযোগীতার বিষয়টিও অন্যদের চাইতে তুলনামূলক উন্মুক্ত থাকা দরকার। কারণ একটাই; সেটা হল তাদের জীবন পরিক্রমণ। জীবন প্রায়শই যেমন ফেয়ার প্লে গ্রাউন্ড নয় তেমনি এই ময়দানে অধিকতর যোগ্যের উপস্থিতি নিশ্চিত করাও আবশ্যক।
এইচএসসি পরবর্তী সময়ের যে প্রস্তুতি সেটা গভীরভাবে অর্থনীতির সাথে সংযুক্ত, আসলে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই। এই পরিস্থিতি উচ্চশিক্ষায় (মত ভিন্নতায় তথাকথিত সম্ভাব্য ভালো আয়েরও) প্রবেশে অদম্যদের রাস্তাকে আরো সংকীর্ণ করে তোলে। মেধা নিজেই যে অর্থনীতিমূলক সেটা বড় শহরের তথাকথিত ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর ফি বছরের ফলাফল বারবার প্রমাণ করে, অদম্যরা এই বৈষম্যের মধ্য দিয়েই সেটা অতিক্রম করার চেষ্টা করেন। কিন্তু যে ধরণের বাহাসমূলক কল্প সহযোগীতার বাস্তবতা আমরা লক্ষ্য করি তাতে পুরোনো অর্থনৈতিক ফাঁকফোকড়গুলো আর লুকানো থাকেনা। ফ্যান্টাসী কিংডম বা নন্দনে মেধাবীদের উৎসব করানোর ব্যায় দিয়ে অনেক অদম্যদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাথমিক খরচটুকু সহজেই উঠে আসে।
যদিও গণমাধ্যম আর বিপণন চক্রের মধ্যে দিয়ে না প্রবাহিত হলে এর কোনটাই বৈধ হয়ে ওঠে না। ফলে এই গল্পটাও শ্রেণী নির্ভর। আমরা মুখে যতই প্রশংসা করি অধিপতি শ্রেণী খুব ভালো করেই জানে এই দরিদ্র মেধাবীদের দূর্বল অংশটুকু। তারা এটাকে যেমন ঈর্ষা করে তেমনি ভয়ও পায়। জোরালো অদম্যতার এই বিকাশ অনেক নির্মিত প্রতিষ্ঠিত সত্যকেই নাড়া দিতে সক্ষম।
হয়ত এজন্যই ব্যবস্থাপনা এই অদম্যদের নানাভাবে ব্যাপ্তাইজ করার চেষ্টা করে। হয়ত ব্যাপ্তাইজ হওয়া ছাড়া অন্য কোন গত্যান্তর অধিকাংশেরই থাকে না।
কিন্তু আজকের অদম্যদের ছবি ছাপা বা দৈনিকের কল্যাণে কয়েক জনার একটু সাহায্য পাওয়া এর কোনটাই পরিস্থিতি পরিবর্তন করে না। আমি সেলাম করি সেইসব মানুষজনাদের যারা তার পরিচিত কিংবা প্রতিবেশী, মেধাবী শিক্ষার্থীকে সাহায্য করেন অথবা করে চলেছেন। অদম্যদের কৃতজ্ঞতা তালিকায় বারবার উচ্চারিত হয় সেইসব না দেখা মুখ।
সেইসব শিক্ষক যারা বাজারী গল্পের বাইরে এসে বিনা পয়সায় পড়িয়ে যান, বই দিয়ে সাহায্য করেন। আমি বারবারই দেখতে পাই প্রতিষ্ঠানের চাইতে এইসব জনাকয়েক মানুষ যারা সত্যিকার কাজটা করে আবার নি:শব্দে নিজের জায়গায় ফিরে গেছেন তারাই সবচেয়ে কার্যকর। জানি না কেন প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমি সবসময়ই সন্দেহে থাকি। প্রতিষ্ঠান যখন মানুষকে ছাপিয়ে যায় তখন আমি অস্বস্তি বোধ করি। এই অদম্যরা প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে উপেক্ষিত জায়গায় থেকেও প্রতিষ্ঠানের দেয়া পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো ফল করেছেন কিন্তু প্রতিষ্ঠান তারপরও তাদের জন্য একের পর এক কন্টকাকীর্ণ পথের বন্দোবস্ত অগ্রীম করে রেখেছে।
এই ব্যবস্থাপনা ভাঙ্গা বা পরিবর্তন কষ্টকর কিন্তু এই অদম্যদের পথরোধ করার প্রস্তুতির কমতি নেই।
মুখে আর মঞ্চে ফেনা তুলে ফেলা কল্যাণকামীতার বাহাসটা ব্যবস্থপনাকে এমন নিপীড়ক করে তুলেছে যে কয়েক বছর পর এই অদম্যদের খুঁজে পাওয়াও কঠিন হয়ে উঠবে। আমরা দেখবো প্রথম আলো কিংবা স্কয়ারের লোগো ছাড়া কোন মেধাবীদের খোঁজ আমরা পাচ্ছি না। অদম্যতা সম্ভবত মানুষের আদিমতম সারভাইভাল টুল। তবে আমরা নিজেরাই যদি একে কেবল অর্থনীতির গোলামীতে পাঠিয়ে দেই তাহলে সেমিনারে সেমিনারে কল্পিত বাস্তবতার সুরাপান-নির্গমন-সেটাকেই আবার পান এই চক্র ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।