বড়লোকদের গাড়ী গুলো সব কাছিমের মত ভাসে,
বরষা বাদল দুই ভাই বোন, শহর দেখতে আসে.......
মিউজিক সিস্টেমে গান বাজছে-মন্ট্রিয়ল থেকে টরন্টো ফিরছি, বিশাল এক ফোর্ড ভ্যান চালিয়ে, পাশে একমাত্র যাত্রী সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া পুত্রধন। আম্মুর প্রতি অনাস্থার অভাব তার কোন দিনই ছিল না। প্রায় মফঃসল শহর মন্ট্রিয়লের রাস্তায় হন্ডা সিভিক চালানো আর সিক্স ট্রাকের হাইওয়েতে ফোর্ড ভ্যান চালানো যে এক বস্ত নয়, তার ধারনা আজ আম্মু সেটা টের পাবে। দম বন্ধ করে সিটে বসে আমার প্রতিটি মুভমেন্ট ভীষন সন্বিগ্ধ ভাবে লক্ষ করছে, পুরোপুরি সর্তক, ধরেই নিয়েছে যে কোন গুবলেট পাকানো অবস্থায় তাকেই সেভিয়ারের ভুমিকা নিতে হবে।
মাইলের পর মাইল ধরে দিগন্ত ভেদ করে যাওয়া মসৃন রাস্তা, কিছুটা চড়াই-উৎরাই, লম্বা জার্নি, একেক সময় একঘেয়ে লাগে।
স্পিড মিটারের কাটা ১৩০-১৪০ এর ঘরে অলস ভাবে ঘোরাঘুরি করছে, প্রায় নিঃশব্দ ইঞ্জিন, এখনো পুরোটা শক্তি ব্যয় করা হয়নি, তবুও ছুটছে এক শ্বাপদের মতো- ষ্টিয়ারিংএর মসৃনতায় হাত বুলিয়ে আমি মনে মনে ফোর্ডের সাথে কথা বলি- শরীরে তোর পরিপুর্ন যৌবন, সময় থাকতে ছুটে নে, বুড়ো হবি, তো তোকে পাঠিয়ে দেবে তৃতীয় বিশ্বে। বাকী জীবন তোর কাটবে গড়িয়ে গড়িয়ে।
গত মাসের আমার পুরোটাই কেটেছে ঢাকা শহরে। প্রায় দশ বছরের ব্যবধান, কিন্ত এ কোন ঢাকা শহর? প্রধান রাস্তাগুলো রিক্সা শুন্য অথচ গাড়ীগুলো ক্রমশঃ মন্থর থেকে মন্থরতর হয়ে উঠছে। রাস্তা জুড়ে এত ঝলমলে, চকচকে সব গাড়ী।
কি বিশাল শক্তি একেকজনের শরীরে, অথচ কি করুন ভাবে গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে চলা আর একেকটা মোড়ে এসে সারিবদ্ধ ভাবে ধুঁকতে থাকা, দু পা এগূলেই বুঝি ওল্ড কার গ্রেভইয়ার্ড। এ দৃশ্য দেখাও কষ্ট- অনেকটা রেস কোর্সের ঘোড়াকে লাগাম পড়িয়ে কায়েৎতুলির রাস্তায় টাঙ্গা চালানো আর কি।
ঢাকার রাস্তায় দীর্ঘ জ্যামের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে আমার সেই সব রিক্সাওয়ালাদের কথা খুব মনে হয়। কান পাতলে আমি যেন তাদের অভিসম্পাত মাখা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাই। খুব কাছ থেকে অশরীরে তারা আমাদের লক্ষ করে, আমাদের স্থবির হয়ে যাওয়া মেট্রোপলিটান জীবনের দিকে তীব্র ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে তাকায়।
....... এখন তোমরা ময়ুরপঙ্খী ছোটাও- আরো জোরে ছোটাও না? .......গাঁও গেরামের উপদ্রব গুলোকে তো খেদাঁনো হয়েছে .......তোমাদের রাজহংশ এখন ভাসাও না কেন? মেশিনের সাথে টক্কর দেওয়ার খেলা থেকে তো কবেই নাম কাটান দিয়েছি....... পুরা রাস্তার মালিক তো এখন তুমরা.......
আমার প্রথম যৌবনের পুরানো স্মৃতির অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ ছিল বিরল প্রজাতির সেই সব রিক্সাওয়ালারা। এ্যথলেটদের মতো পায়ের মাশল- কালো পাথরে খোদাই মুর্তির মত পেশল শরীরে তারা আমার কাছে ছিল রুপকথার সত্যি রাজপুত্রের মত। তাদের বিশাল থাবার মতো হাতে ধাতব রিক্সার নিখুঁত কন্ট্রোল, এ্যসফল্ট বিছানো রাস্তার মসৃনতায় তীব্র গতিময়তা, যে কোন গন্তব্যে পৌছে দেবার দুর্ভেদ্য ক্ষমতা। ঝড় বৃষ্টি তুফান, কিংবা রাস্তায় হরতাল, দাঙ্গা মিছিল আপনার রাজপুত্র তার যাবতীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করবেই আপনাকে নিরাপদে তার গন্তব্যে পৌছে দিতে।
নিজেদের বিবর্ন জীবনের সাথে তীব্র কনট্রাষ্ট, ঝালর দেওয়া রঙচঙে ছবি দিয়ে মোড়ানো একটা রিক্সায় আপনি উঠেছেন- আপনার সত্যি রাজপুত্র দারুন মমতায় উবু হয়ে বসে- আপনার শাড়ীর কুচি গুছিয়ে দেবে- পাছে রিক্সার চেইনে তা না জড়িয়ে যায়, রিক্সার হুড তুলে দেবে.......
বিশ্বাস করুন এত যত্ন আপনার প্রেমিকও আপনাকে কখনো দেখায় নি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।