আমি সত্য বলতে ভালবাসি তাই আমি চাই সবাই সত্যকে প্রকাশ করুক।
বাংলা চলচ্চিত্রের অধিকাংশ কাহিনীগুলোতে প্রেম, বিয়ে, ভাই কিংবা বাবার ভিলেন হয়ে আবির্ভাব অথবা সম্পদের লোভে অন্য কারো চক্রান্তের ঘটনা আমরা সুদূর অতীত থেকে দেখে আসছি। এখন পর্যন্ত বাংলা সিনেমার গল্পগুলো এসব ঘটনার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বাংলা সিনেমায় সাধারণত নারী পুরুষ উভয় চরিত্রের সমাবেশ থাকলেও তা পরিবেশনে ব্যাপক অসমতা লক্ষ্য করা যায় বরাবরই।
আমি অনন্ত জলিলের সিনেমা নিয়ে কথা বলছি।
সাম্প্রতিক সময়ে, মিডিয়া ভাবনায়, আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে রয়েছে অনন্ত। বিশেষ করে তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র 'নিঃস্বার্থ ভালবাসা'র কারণে। তবে সব সমালোচনার পরও একটি কথা সবাই স্বীকার করছে যে অনন্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। এ পর্যন্ত তার যতগুলো সিনেমা মুক্তি পেয়েছে সবগুলিই বড় বাজেটের। তার দেখাদেখি এখন অনেকেই বড় বাজেটে বাংলা সিনেমা নির্মণের সাহস পাচ্ছে।
তবে আমার দৃষ্টি সেদিকে নয়। তার অভিনয় দক্ষতা বা টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে আমি চিন্তিত না আমি বরং ভাবতে চাচ্ছি তার চলচ্চিত্রের সব 'ডিজিটাল' বৈশিষ্ট্য (মারপিট, গান, প্রিন্ট ইত্যাদির নতুনত্ব) পেরিয়ে, তার চলচ্ছিত্রও কী সেই পুর্বের গৎবাধার বাহিরে আসতে পেরেছে। বাংলা সিনেমায় (বিশেষ করে ঢাকার সিনেমার কথা বলছি) যে নারীকে পরিবেশন করা হয়, যে নারী সতিত্ব উপস্থাপন করা হয় তা ভীষণভাবে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নির্মিত এবং নিরীক্ষিত। বিভিন্ন সিনেমায় আমরা কমন কিছু নারী বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ দেখতে পাই যাকে দু ভাগে ভাগ করা যায়ঃ প্রথমত, নারী সাধারণত লোভী, ডাইনি/ষড়যন্ত্র করে, কাজের মেয়েকে নির্যাতন করে, দুশ্চরিত্রা সৎমা। অন্যদিকে, নারীর কিছু 'ভালো' ইমেজ তুলে ধরা হয় যেমন, অত্যান্ত পতিভক্ত, চরিত্রবান/'ইজ্জত' ওয়ালা, উদার ইত্যাদি।
অনন্ত জলিলের নিঃস্বার্থ ভালবাসা সিনেমায় নায়িকাকে দেখেছি অত্যান্ত লোভী চরিত্র হিসেবে এবং নায়ক পুরুষটিকে দেখেছি নিঃস্বার্থ ভালবাসার অধিকারী, বিত্তবান, ভালোমানুষ, উদার প্রেমিক এবং সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে। লোভী প্রেমিকা বারবার ভুল করে আর প্রেমিক শুধু ক্ষমাই করে যায়। এমনকি তার স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি প্রেমিকার নামে লিখে দিয়ে আত্নহননের জন্য উদ্যত্ হয়। অন্যদিকে প্রেমিকা নারীটি বারবার ধোকা খেয়ে প্রেমিক পুরুষটির কাছে ক্ষমা চায়।
সিনেমার অন্যতম টার্গেট থাকে দর্শক গ্রহণযোগ্যতা এবং ব্যবসা।
অনন্ত পরিবর্তনের কথা বললেও হয়ত দর্শক ধরার জন্য কিংবা ব্যবসায়ীক কৌশলের কারণে তার সিনেমার চরিত্রগুলিকে অবাধ বিচরণ করতে দিতে চাননি। প্রবল পুরুষালী মতাদর্শে কখনই নারী চরিত্রের স্বাধীনতা গ্রহণযোগ্য নয়। নারী সিনেমায় নারী চরিত্র কতটুকু বিকশিত হবে তা নির্ধারণ হবে পুরুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা মাথায় রেখে। নায়িকাকে গভীর রাতে ষড়যন্ত্র করে পার্টিটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অশ্লীল ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য, অথচ কোন কিছু ঘটার আগেই নায়ক সেখানে হাজির। 'নায়িকার চরিত্র হরণ এবং সেই নারীকে গ্রহণ' এমন দৃশ্য দেখতে বোধহয় আমাদের মধ্যবিত্ত দর্শক কখনই স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেনা।
দর্শকরা যখন সিনেমা দেখে তখন হয়তো অজান্তেই সিনেমার মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে নিজেকে খুজে ফেরে। আর তাইতো যখন নায়ক ভিলেনদেরকে মেরে নায়িকাকে উদ্ধার করে তখন পুরুষ দর্শকরা যেমন 'সাবাশ' বলে চিৎকার দেয়, চিল্লায় উঠে তেমনি নারী দর্শকেরাও স্বস্তি পায়। আবার নায়িকার ফেসবুক চ্যাটের সময় তার বোন যখন বলে "মেয়েদের এত বন্ধ থাকা ভালো না" তখন হলের দর্শক ঠিক বলে হাততালি দেয়। হলে যখন সিনেমাটি দেখছিলাম, তখন আমার পাশের সিটগুলো কয়েকটি জুটি দর্শক বসেছিল। এক পর্যায়ে একজন পুরুষকে তার সাথে থাকা নারীবন্ধুকে বলতে শুনলাম 'বাস্তবে কিন্তু এমনি হয়।
খারাপ মেয়েছেলে এভাবেই পুরুষদেরকে ধোকা দেয়'।
সিনেমার শেষের দিকে এসে রহস্য পরিস্কার হয়, 'ভালো'র জয় নিশ্চিত করা হয়। শয়তান ভিলেন ধ্বংস হয়, অবাধ্য স্ত্রী ভুল বুঝতে পারে অথবা প্রেমিকা প্রেমিকের মহান প্রেমের কাছে হার মানে, এটাই সাধারণ নিয়ম। নিঃস্বার্থ ভালবাসার নায়িকাকে আমরা তেমনি দেখি। অবশেষে প্রেমিকের প্রেম সে বুঝতে পারে, তার পা ধরে, মধ্যবিত্ত অনুগত স্ত্রীর মত মাফ চায়।
আর এ দৃশ্য দেখে শুধু নায়কই নয় বরং হলে সব দর্শকই আবেগ আপ্লুত হয়ে তাকে ক্ষমা করে দেয়। আর এর মধ্য দিয়ে অত্যাধুনিক নিঃস্বার্থ ভালোবাসা প্রচলিত পুরুষালী মতাদর্শেরই প্রতিনিধিত্ব করে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।