আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রেইন ম্যান

স্যার বসব ? ডাঃ তাবারেজ এম ডি চশমার ফাক দিয়ে তাকিয়ে বললেন , স্যার বলছেন কেন ? আমাকে মিঃ তাবারেজ বলে ডাকবেন। স্যার আমার দেশে ডাঃ দের সবাই স্যার বলেতো আমার ও সেই থেকে অভ্যাস । আশ্চর্য । কেন ? আমরা ডাঃ দের সম্মান করে স্যার বলি । তার মানে বলতে চান আমার দেশে ডাঃ দের কেউ সম্মান দেয় না? না স্যার তা বলছি না ।

আসলে অনেক দিনের অভ্যাস তো । ঠিক আছে আপনি না হয় স্যারই বলুন । স্যার আজকে না হয় চলেই যাই । কেন? স্যার বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে । কেন ? বৃষ্টির দিনে আপনি কথা বলেন না? না স্যার।

এই প্রথম মনে হয় ডাঃ তাবারেজ একটু আগ্রহ দেখালেন । আপনি বসুন । কফি খাবেন? জি স্যার খাব। আচ্ছা আমি আনতে বলছি । আপনি আপনার সমস্যার কথা বলুন ।

স্যার আমার কোনও সমস্যা নেই । ঠিক আছে । তাহলে আসুন কিছুক্ষন গল্প করি । ঐ যে বৃষ্টির কথা বললেন না , আজ বৃষ্টি নিয়েই না হয় কথা বলি । স্যার , ছোটবেলা থেকেই আমি বৃষ্টি পাগল ।

ছোটবেলায় বৃষ্টির দিনে যখন সব বন্ধুরা ফুটবল খেলত , আমি অবাক হয়ে বৃষ্টি দেখতাম । আমি বৃষ্টির রঙ দেখতে পাই । বৃষ্টির গন্ধ পাই । মায়ের বুকের গন্ধের মত । বৃষ্টি হলে সেখান থেকে আমাকে নাড়ানো জেতনা ।

স্যার আপনাদের কাছে বৃষ্টির শব্দ কেমন লাগে আমি জানি না। কিন্তু স্যার আমি বৃষ্টির শতেক শব্দ পাই। প্রত্যেক ফোঁটার অস্তিত্ব আমি আলাদা ভাবে বুঝতে পারি । লেখাপড়ায় আমি ছোট থেকেই খুব ভাল ছিলাম । তাই হঠাৎ করেই আমি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে একটা বৃত্তি পাই ।

আজ থেকে ৫ বসর আগে । স্যার দেশ থেকে আসার পর খুব বেশি কি মিস করেছি জানেন ? বৃষ্টি । কেন? এখানে কি বৃষ্টি হয়না ? হয় স্যার । কিন্তু হাজারো গাড়ি আর সাবওয়ের একটানা শব্দের মাঝে আমার বৃষ্টির সুর হারিয়ে গেল । আমি বৃষ্টির গন্ধ ভুলে গেলাম ।

নিউইয়র্ক এর হিমশীতল বৃষ্টির মাঝে আমি পাগলের মত ঘুরে বেরাতাম একটুখানি গন্ধ , একটু খানি সুরের জন্য। পাগলের মত হয়ে গেলাম । হঠাৎ এমনই এক বৃষ্টির মাঝে আমি কুইন্স এর একটা পার্কে বসে আছি । ৩ ডিগ্রি সেঃ তাপমাত্রা । কিন্তু আমার সেদিকে কোন খেয়াল ছিলনা ।

আমি শুধুমাত্র মন দিয়ে বৃষ্টি অনুভব করছি এমন সময় আমি প্রথম রাইনাকে দেখি । বাচ্চা একটা মেয়ে । দৌড়ে দৌড়ে লেকের পারে হাসগুলোকে ধরার চেষ্টা করছে । ৭-৮ বছর বয়স হবে । আসে পাশে কেউ নাই ।

মেয়েটির মা বাবা কোথায় ? আমার মনে হোল মেয়েটি পথ হারিয়েছে । নইলে এই কনকনে ঠাণ্ডা আর বৃষ্টির মধ্যে কে মেয়েটিকে একা ছাড়বে । আমি সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেলাম । তেমন কিছু হলে পুলিশ কল করতে হবে । আমি এগিয়ে যেতেই মেয়েটি আমার দিকে তাকাল ।

তখনই সেই আশ্চর্য ব্যাপারটা ঘটল । আমি হঠাৎ করেই আমার হারিয়ে যাওয়া গন্ধ রঙ ফিরে পেলাম । মেয়েটির চোখ , স্যার বুঝলেন মেয়েটির চোখ । মেয়েটির চোখে স্যার আমি বৃষ্টির রঙ সব একসাথে দেখতে পেলাম । এমন সময় মেয়েটি আমাকে ডেকে উঠলো ।

কেমন আছো রেইনম্যান ? আমাকে বলছ? তোমাকেই ত ডাকছি । আশেপাশেতো আর কেউ নেই । তোমার অসুখটা কি সেরেছে রেইন ম্যান? কিসের অসুখ? মেয়েতি খিলখিলিয়ে হেসে বলল বৃষ্টির অসুখ । তুমি কি আমাকে চেন? আমরা সবাই তোমাকে চিনি । তোমরা কারা? মেয়েটি এবার হাসের দিকে মনোযোগী হোল ।

আমি বুঝলাম আমি আর আমার উত্তর পাব না । তোমার নাম কি? রাইনা । রেইনম্যান আর রাইনা মজার না । আমি যাই , মা বকবে । এই বলে মেয়েটি এক ছুটে লেকের পাশের বনের মধ্যে ঢুকে গেল ।

বুঝলেন স্যার আমি এত ডাকলাম এই মেয়ে দাড়াও । কিন্তু সে কোন কথা শুনলনা । আমার রোগটা সারিয়ে দিয়ে চলে গেল । আপনার কফি। তারপর বলুন ,আর কখনো মেয়েটির দেখা পাননি? জি স্যার আর দুইবার দেখেছি ।

এই ঘটনার ঠিক এক বছর পর। তখন আমার অবস্থা আর আগের মত নেই । নিউইয়র্ক এ আমার প্রচুর বন্ধু হয়েছে । তাদের সময় দিয়ে আর আগের মত বৃষ্টি দেখার সময় পাইনা । হঠাৎ এক ছুটির দিনে বৃষ্টি দেখে আমার রাইনার কথা মনে পরল।

আমি হেটে হেটে সামনের পার্ক এ যেয়ে বসলাম । পাসের বেঞ্চে দেখলাম এক সাদা চুলের যুবতী বসা। চুপচাপ যেন কিছুতা বিসন্ন । কেমন আছ রেইনম্যান ? আমি চমকে উঠলাম । অবিকল রাইনার কণ্ঠ ।

কিন্তু একটু বিসন্ন। তাকিয়ে দেখলাম পাশে বসা যুবতীটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আজকাল আর বৃষ্টি দেখার সময় পাও না তাইনা?জানো আমাদের খুব মন খারাপ হয় । আমি কি আপনাকে চিনি । আমি রাইনা ।

বুঝলেন স্যার আমি চমকে গেলাম। মেয়েটির চোখের দিকে তাকালাম ,এই চোখ স্যার ভুল করার নয় । স্যার আমি কবি নই । হলে আরও ভালভাবে আমি বর্ণনা করতে পারতাম । শুধু স্যার এইটুকু বলতে পারি তপ্ত রোদে হঠাৎ করে বৃষ্টির ছাঁট লাগলে যেমন লাগে মেয়েটির চোখ দুটো আমাকে সেভাবে ভিজিয়ে দিয়ে গেল ।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম , কে তুমি ? রাইনা । আমার কাছে কি চাও ? তুমি আর বৃষ্টিতে আসনা কেন ? আমার খুব মন খারাপ হয় । এই বলে কাদতে কাদতে মেয়েটি আবার ও পাশের বনের মধ্যে হারিয়ে গেল । দাঁড়ান ,দাঁড়ান । একটু আগে না বললেন রাইনা বাচ্চা একটা মেয়ে ।

এক বছরের মধ্যে কি করে সে যুবতী হয় ? স্যার আপনিই বলুন । সে জন্যই ত আমার আপনার কাছে আসা। আচ্ছা আপনি শেষ করুন । স্যার রাইনাকে শেষ দেখি জ্যামাইকা হাসপাতালে । পিক ডিজিস নামে আমার একটা অসুখ ছিল ।

তখন আমি প্রায় মৃত্যু শয্যায় । মুষলধারে বৃষ্টি চারিদিকে । তখনই আমি আবার রাইনাকে দেখতে পেলাম । না স্যার এবার চেহারা তেমন বদলায় নি । আগের মতই আছে ।

কেমন আছো রাইনা ? খুব কষ্ট হচ্ছে রেইন ম্যান ? হা রাইনা । অনেক কষ্ট । আমি জানি । আমরা আজ সবাই তোমাকে দেখতে আসছি । কই আমিতো আর কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা ।

পাবে রেইন ম্যান । আজ থেকে তুমি সবাইকে দেখতে পাবে । আজ আমাদের বড় আনন্দের দিন রেইন ম্যান । বড় আনন্দের দিন । স্যার সেই দিন বিকাল বেলায় আমি মারা যাই ।

হঠাৎ করেই তারপর সব কিছু আমি পরিস্কার বুঝতে পারি । আমি কে,রাইনা কে, আমরা কে,আপনি কে,স্যার আপনি কি জানেন আপনি কে? দাঁড়ান দাঁড়ান । আপনি বলতে চান আপনি মারা গেছেন। জি স্যার । কিন্তু আপনি ত আমার সামনে বসে আছেন ।

আপনি মারা গেলে আমার সামনে বসে আছেন কি করে? সব কিছু কি আমরা বুঝি স্যার। সবকিছু বোঝার দরকারই বা কি । জীবনতো চলে যায় , তাইনা স্যার। সত্যি করে বলুনতো আপনি কে? স্যার আমি কেউ না । আমরা কেউ না ।

। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।