আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না



মেইলটা পড়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকি। হতাশায় কিনা জানি না,হতাশ হবার ক্ষমতাই চলে গেছে অনেকদিন। একটা রিজেকশন লেটারে এমন কিছু যায় আসে না,অনেকগুলো বছর হল কোন কিছু পাবার খবর পাই না,না পাওয়া এত স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে পেলেই অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার কথা,কিন্তু তারপরেও নিজের হতাশার পরিমাণ দেখে নিজেই একটু অবাক হয়ে থাকি। বয়স কি বেড়ে যাচ্ছে অল্প বয়সেই? আত্মবিশ্বাসে কি একটু চিড় ধরে গেছে? সিস্টেম কি খেয়ে ফেললো ভেতরের ড্যাম কেয়ার ভ্যাগাবন্ডকে? মেইলটার ভাষা আসলে বেশ প্যাঁচানো,মানে বুঝতে বেশ সময় লাগে মেইলদাতার বক্তব্যটা। বেশ কিছুদিন আগে ১টা কোম্পানিতে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছিলাম,তো সেই প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক তার শতসহস্র কৃতজ্ঞতা এবং অভিবাদন জানিয়ে এবং আমার মত একজন যোগ্য ব্যক্তির আবেদন পেয়ে তারা কতখানি কৃতার্থ সেটা বয়ান করে শেষমেশ শোনালেন,এমন একজন ব্যক্তিত্বের জন্য উপযুক্ত পদ তাদের প্রতিষ্ঠানে এখনো খালি হয়নি,যা খালি আছে সেটায় আমাকে বসিয়ে তারা আমার অপমান করতে চান না।

তবে আমার মহামূল্যবান সিভিখানা তারা ফেলে দিচ্ছেন না,ভবিষ্যতের জন্য সোনালি ফিতায় মুড়ে সংরক্ষণ করে রাখছেন। মেজাজটা শুরুতে ভয়াবহ খারাপ হয়েছিল,একবার ভেবেছিলাম জবাব দিই,সিভিখানা তোমার পশ্চাদ্দেশে দিয়ে বসে থাকো,পরে ভেবে দেখলাম,বিশেষ কিছু না,এটা একটা প্রত্যাখ্যান,অন্তত,শেষ পর্যন্ত আমার মোটা মাথায় সেটাই ঢুকেছে। প্রত্যাখ্যান নতুন কিছু নয়,অনেকগুলো বছর হল আমার আবেদন-নিবেদন কোথাও গ্রাহ্য করা হয়না। অগ্রাহ্য কথাটাই এখানে যথার্থ,কারণ আবেদন যে করা হয়েছিল সেটাই কারো মাথায় থাকে না। কর্মসন্ধান তো শুরু হল সেই সেদিন,আর এই ক'মাসেই মনে হচ্ছে লালন সাঁই নিশ্চয়ই বেকারত্বের সমস্যায় ভুগছিলেন আর একের পর এক আবেদন পাঠিয়ে তীর্থের কাকের মত বসে থেকে শেষমেশ তিতিবিরক্ত হয়ে গেয়ে বসেছিলেন--"আমি অপার হয়ে বসে আছি,ওগো দয়াময়,পারে লয়ে যাও আমায়।

" তা লালনজী এপারে না পেলেও ওপারে গিয়ে মরে বেঁচেছেন,কিন্তু আমার বসে থাকা আর শেষ হয়না। পত্রিকার যে পাতাগুলো আগে উল্টেও দেখতাম না সেই কর্মখালি বিজ্ঞাপনের পাতাগুলো এখন মুখস্ত,চাকরির খবরের সাথে এখন কত ফিট উচ্চতার পাত্রের জন্য কত ফর্সা পাত্রীরা অপেক্ষা করে আছে অথবা কে কাকে পড়িয়ে বিদ্যাদিগগজ বানিয়ে দেবে সেসবের সুলুকসন্ধানও এখন মাথার ভেতরে গাঁথা হয়ে গেছে। আবেদন পাঠিয়ে বসে আছি,অপার হয়েই কারণ আর কিছু করারও নেই,কিন্তু যে মহাজনরা বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকেন তারা যেন সেটা দিয়েই বেমালুম ভুলে যান,আমার আবেদন কোন ব্ল্যাকহোলে চলে যায় কে জানে। অপেক্ষায় থাকি,চিঠি আর আসেনা,মাঝে মাঝে মনে হয়,সুন্দরী পাত্রীর শিক্ষিত বেকার জামাই চাই ঠিকানা বরাবরই আবেদন করে দিই। প্রশ্ন আসতেই পারে,তুমি কে হে যে তোমার জন্য চিঠির জবাব নিয়ে বসে থাকবে লোকজন? তা একটা কথা বটে,আমি কেউ না,আমরা সবাই-ই কি কেউ একজন? প্রতিদিন আমরা কত চিঠি পাঠিয়ে যাই কতজনের বরাবর,আসলেই ক'জন জবাব পায়? পেনশনের জন্য চিঠি পাঠিয়ে যে বৃদ্ধ সরকারি দফতরের বারান্দায় বসে ছিলেন,তাঁর চিঠির জবাব কি শেষদিনটির আগ পর্যন্ত এসেছিল? অথবা দুই নেত্রীর কাছে ঐক্য আর সংহতির আহ্বান জানিয়ে আপামর সাংবাদিক বা কূটনীতিক মহল যেসব চিঠি দিয়েছেন,তার জবাব কি কখনো এসেছে? মাননীয় মেয়র বরাবর সংবাদপত্রের পাতায় কত চিঠিই তো লিখে গেল কত দুর্দশাগ্রস্থ ওয়ার্ডবাসী,মেয়রের আর জবাব দেবার সময় হয়না,যেমন সময় হয়না মাননীয় সরকার বাহাদুরের তার বরাবর দেয়া বিদ্যুৎসংকট সমাধানের জন্য স্মারকলিপির ছোট্ট একটা জবাব দেবার।

সবুজ উদ্যান বাঁচাবার আবেদনের জবাব পাইনা আমরা,সংসদ ভবনের সৌন্দর্য রক্ষার আবেদনে সাড়া পাইনা আমরা,বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধে আকুল আবেদন করে পাত্তা পাইনা আমরা,বাসভাড়া কমানোর জন্য আবেদন করে বাসমালিকদের কাছে সাড়া পায়না সরকার স্বয়ং,অফিসের তাড়ার সময় সিএনজি আর রিকশাচালকের কাছে হাতজোড় করেও ফিরে আসি আমরা,অসুস্থ রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স বা আগুন লেগে সর্বস্ব পুড়ে যাওয়া মানুষকে বাঁচাতে ছুটে যাওয়া ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ির জন্য রাস্তা খালি করে দেবার আর্তি করেও এক কণা ফাঁকা জায়গা পাইনা আমরা,কংক্রিটের জঙ্গলে তাকাবার জন্য একটুকরো মুক্ত আকাশ পাইনা আমরা,দু'মুঠো খেয়ে বাঁচার জন্য চালের দাম সামান্য কমানোর চিঠি দিয়েও আমাদেরই ব্যবসায়ী বাবা-ভাইদের সাড়া পাইনা আমরা,কোটি মানুষের সম্পদ চুরি করে আকাশছোঁয়া বাড়ি আর বিলাসী গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াই আমরা,এমনকি পরিচ্ছন্ন ঢাকা গড়ার আমাদেরই আবেদন ময়লার ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলে দিই আমরাই। চিঠি দিয়ে জবাব না পাবার দেশের মানুষ আমি, অনেকদিন আগে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে কাউকে যে ছোট্ট সেলফোন চিঠি দিয়েছিলাম,তার ছোট্ট থেকে ছোট্টতর একটা জবাব আশা করেও বসেছিলাম অনেকদিন বোকার মত,বুঝতে দেরিই হয়ে গেছে,চিঠির জবাব আর আসবে না কখনো,আমাদের চিঠির উত্তর আসতে নেই,আমাদের জবাব পাবার অধিকার নেই। মার্কেজের কর্নেলের কাছে কেউ চিঠি লিখতো না,হোক না রিজেকশন লেটার,তাও তো কেউ একজন আমাকে একটা চিঠি লিখেছে,কি বলে তাকে ধন্যবাদ জানাবো?

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।