অনিয়মই নিয়ম : নীতিসত্তার অমোঘ অন্বেষণ
ফকির ইলিয়াস
=========================================
রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সঙ্গতি-অসঙ্গতি নিয়ে এই যে এতো কলাম প্রতিদিন লেখা হয়,তা কী পাঠক-পাঠিকারা পড়েন? নিবন্ধ এবং নিরীক্ষাধর্মী লেখা লিখে সমাজ বদলে কতোটা ভূমিকা রাখা যায়? এমন একটা প্রশ্ন একবার করেছিলাম বরেণ্য কবি শামসুর রাহমানকে। তিনি মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, কলাম লিখে সাধারণ মানুষের খুব কাছে পৌঁছা যায়। বলা যায় মানুষের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কথা। কড়ানাড়া যায় রাষ্ট্র শাসকদের দরোজায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী বাঙালি সমাজের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আনন্দ-বেদনা এবং আশা-আকাংখার কথা যারা লেখায় লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছেন, সাঈদ-উর-রব তাদের অন্যতম।
তার আরো একটি বড়ো পরিচয় আছে। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় একজন ক্রীড়াবিদ ছিলেন এক সময়। অ্যাথলেটিক্সের শটপুট এবং ডিসকাস থ্রোতে নিজের রেকর্ড নিজেই ভেঙেছেন পরপর আটবার। জাতীয় পর্যায়ে জেলা ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হন দুবার। জাতীয় ক্রীড়াবিদ হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
নিউইয়র্কে আসার পর সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িত হন। ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এক দশকেরও বেশি সময়। এখন সাপ্তাহিক ঠিকানার প্রেসিডেন্ট হিসেবে যুক্ত রয়েছেন লেখালেখির সঙ্গে। করছেন সমাজসেবা।
সাঈদ-উর-রব আপাদমস্তক সমাজ বিনির্মাণে একজন বিশ্বাসী মানুষ।
তার প্রত্যয় আকাশ ছোঁয়া। তিনি সব সময়ই চান এই প্রজন্ম সত্যের সপক্ষে দাঁড়াক। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃত অর্থেই সমৃদ্ধশালী হোক। গড়ে তুলুক বাংলার মাটিতে সোনালি ফসলের গোলা।
নিউইয়র্কের ২০০৮ সালের বইমেলায় সাঈদ-উর-রবের একটি বই বেরিয়েছে।
এর নাম হচ্ছে ‘অনিয়মই নিয়ম’। নামটি দেখামাত্র বুঝে নেওয়া যায় সহজে, গ্রন্থটির প্রতিপাদ্য বিষয় কি হতে পারে। যদি কোনো সমাজে অনিয়মই নিয়ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়ে, তাহলে কেমন হয় কিংবা হতে পারে সে সমাজের অবস্থা?
লেখক সাঈদ-উর-রব খুব দরদ দিয়ে এবং সূক্ষ বিচারে বাংলাদেশ ও বিশ্বের সামগ্রিক বাস্তবতা তুলে ধরতে চেয়েছেন তার এই গ্রন্থের তেরোটি নিবন্ধে। তিনি খুব স্পষ্ট করেই বলতে চেয়েছেন কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদের কারণেই আজ বাংলাদেশের এমন বেহাল অবস্থা; বিশ্ব আজ চরম দুঃসময়ের মুখোমুখি।
দীর্ঘ প্রথম নিবন্ধটির শিরোনাম, ‘সংবিধান নয় অনিয়মই নিয়ম, কতিপয় স্বার্থপর রাজনীতিবিদের কারণেই ক্ষত-বিক্ষত বাংলাদেশ।
’ বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে সাঁইত্রিশ বছর আগে। তারপরও আজ দুর্নীতি, সন্ত্রাস, স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে কেন সম্মিলিত চেতনা প্রতিষ্ঠিত হলো না, এ প্রশ্ন রেখেছেন লেখক। রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ নিজ সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে, কৃষক-শ্রমিক-মজুরের সন্তানদেরকে রাজনীতির বলি করবেন কেন? তিনি প্রশ্নগুলো জনমনে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন।
দ্বিতীয় লেখায় লেখক প্রজন্মকে গৌরব এবং ঐতিহ্যের আলোয় শাণিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। হীনমন্যতা, দীনতা থেকে বেরিয়ে এই সমাজকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উদার আহ্বান জানিয়েছেন সমাজপতিদের প্রতি।
তৃতীয় নিবন্ধটি লিখেছেন, ‘রাজনীতির দুষ্ট বলয় থেকে খেলাধুলাকে মুক্ত করতে হবে’ এই শিরোনামে। এ লেখায় খেলাধুলার মাঠকেও কিভাবে সুদীর্ঘকাল ধরে দলীয় প্রভাবে রাখা হয়েছে তার খণ্ডচিত্র তিনি তুলে ধরেছেন। ক্রীড়াক্ষেত্রে এক ধরনের বন্ধ অবস্থা সৃষ্টি করে ফায়দা লুটছে কারা? কী তাদের নেপথ্য উদ্দেশ্য এ বিষয়গুলো তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। বলেছেন, আলোকিত ক্রীড়াবিদদের হাতেই মাঠ ছেড়ে দেওয়া উচিত। ‘ইরাক ধ্বংসের দায়িত্ব কে নেবে? দোষীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কী আদৌ সম্ভব’' এটা হচ্ছে চতুর্থ নিবন্ধের শিরোনাম।
আমরা জানি ইরাক যুদ্ধ নিয়ে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এখন ইতস্তততায় ভুগছেন। তার সিদ্ধান্ত কী সঠিক ছিল এ প্রশ্ন স্বয়ং বুশকেও ভুগায়। কাদের স্বার্থে ইরাক যুদ্ধ? এর ফল কীভাবে ভোগ করছে আজকের বিশ্ব? এসব প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে সচেষ্ট হয়েছেন লেখক তার এই দীর্ঘ লেখায়।
বেগম খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন ‘প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সমীপে’ শিরোনামে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন তিনি। এটি গ্রন্থে পঞ্চম নিবন্ধ হিসেবে স্থান পেয়েছে।
এখানে লেখক সমাজের কল্যাণে বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে আলোকপাত করেছেন।
‘প্রবাসে সাংবাদিকতার অতীত ও বর্তমান’- এই গুর"ত্বপূর্ণ লেখাটি বইয়ের ষষ্ঠ নিবন্ধ। লেখাটিতে মূলত যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সাংবাদিকতা ও এর বিকাশের বিভিন্ন দিক চিত্রিত হয়েছে যা এখানে জন্ম নেওয়া প্রজন্মের জন্য একটি দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে। বাংলা সাংবাদিকতার প্রবাস অধ্যায় নিয়ে যারা গবেষণা করবেন তারা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন।
এর পরের লেখাটির শিরোনাম হচ্ছে ‘প্রবাসে সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ ও আমাদের করণীয়’।
অভিবাসী জীবনে সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত একজন সংবাদকর্মী হিসেবে বেশ খোলামেলা কিছু মতামত ব্যক্ত করেছেন সাঈদ-উর-রব। তার এই ভাবনাগুলো অবশ্যই ভিন্নমত পোষণের সুযোগ করে দেয় যদিও, তবু সময়ের একটি স্থিরচিত্রই আমরা পাই তার লেখায়। জানি তার সমকালকে।
অষ্টম নিবন্ধটি হচ্ছে -'একুশ নিয়ে। পবিত্র শহীদ মিনার নিয়ে দলবাজি, দেশে ও প্রবাসে একুশের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করার ধিকৃত ঘটনাগুলোর কিছু বর্ণনা দিয়েছেন লেখক।
যা অন্য কোনো সমাজে সচরাচর দেখা যায় না।
‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই। ’ প্যারেডি আকারে বাঙালি নেতাদের মানসিকতা ধরা পড়েছে নবম লেখায়। রাজনৈতিক আন্দোলন হোক অথবা সামাজিক দাবিদাওয়াই হোক, দেশে ও প্রবাসে এক শ্রেণীর জোতদাররা যে সবসময় তৎপর থাকে, তাদের স্বরূপ উন্মোচিত করা হয়েছে এ লেখায়। লেখক বলেছেন, নীতিবাক্যের দোহাই দিয়ে এই ভেলকিবাজি আর কতোদিন চলবে?
গ্রন্থের দশম লেখাটি এই প্রবাসের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত সাহসী ও প্রয়োজনীয় লেখা।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশী এসোসিয়েশন ইন নর্থ আমেরিকা বা ফোবানার জন্ম হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। দেশে ও প্রবাসেও একটি সুবিধাবাদী বেনিয়াচক্র দখল করে রেখেছে এই ফোবানার আধিপত্য। সেসব বিষয় নিয়েই লেখাটির শিরোনাম ‘ফোবানা: দিনের আলোর মুখোশ পরা নেতাদের রাতের খেলা। ’ সব সত্য বিসর্জন দিয়ে কীভাবে এই অভিবাসী সমাজকে প্রতারিত করা হচ্ছে তারই স্বরূপ উন্মোচন করেছেন লেখক এই লেখায়।
একাদশতম লেখাটিতে উঠে এসেছে আবারো আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ।
‘ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সমস্যা কী মোড়লদের দাবার ঘুঁটি’ লেখাটিতে লেখক যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে থেকে দেখা বিভিন্ন বিষয়ের বর্ণনা দিয়েছেন। বলেছেন সমস্যা সমাধান করতে হলে রক্তচক্ষু দেখাবার মানসিকতা পরিহার করতে হবে সমূলে। এমনকি মুনাফার জন্য যুদ্ধ লাগিয়ে যারা আজ বিশ্বকে অস্থিতিশীল করে তুলছে তাদের প্রতিও নিন্দা ফুটে উঠেছে প্রতিটি বাক্যে। ‘শাসক বদলালেও শোষণ বদলায়নি’- দ্বাদশ লেখাটি আবারো স্বদেশ প্রসঙ্গে। গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন এসব বিষয়ে একটি সারগর্ভ আলোচনা করা হয়েছে।
শোষকরা রূপ পাল্টে কীভাবে সময়ে সময়ে মানুষের ওপর ভর করে, তার ক্রমবিবর্তন বর্ণিত হয়েছে এই লেখায়।
গ্রন্থের শেষ এবং ত্রয়োদশতম লেখাটি ওয়ান-ইলেভেন নিয়ে। এর শিরোনাম হচ্ছে- ‘১/১১ আশীর্বাদ না অভিশাপ কোনদিকে যাচ্ছে দেশ: উত্তরণে না আরো সংকটে’। দীর্ঘ রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবির্ভাব, চরম সন্ত্রাসের কারণে ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপট তৈরি সম্পর্কে লেখক তার খোলামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি এটাও স্পষ্ট করে বলেছেন কোনো দেশে গণতন্ত্রের বিকল্প কখনোই সামরিক শাসন কিংবা জরুরি আইন হতে পারে না।
লেখকের এ বিষয়ে খুব স্পষ্ট অভিমত হচ্ছে রাষ্ট্রের জনগণই যদি ক্ষমতার প্রকৃত মালিক হন তাহলে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনে সবাইকে নিবেদিত হতে হবে।
সাঈদ-উর-রব তার লেখাগুলোতে কখনো হয়েছেন খুবই দ্রোহী। আবার কখনো তার স্বদেশপ্রেম বিগলিত হয়েছে মৃত্তিকার প্রতি অশেষ মমতায়। তার প্রধান বক্তব্য হচ্ছে সব অনিয়মকে নিয়ম করে এই দেশ জাতি এবং সমকালের বিশ্বকে কেন ভ্রান্তপথে পরিচালিত করা হচ্ছে?
গ্রন্থটির প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ২৮ জুন সোমবার নিউইয়র্কে। এই উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলা ভাষায় উজ্জ্বল নক্ষত্র সমরেশ মজুমদার।
তিনি তার বক্তব্যে বলেছেন, একজন লেখকের কালিক দায়িত্ব হচ্ছে তার সময়কে ধারণ করা। অনেকে সাহসী রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সমাজের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেন না কিংবা বলতে পারেন না। সাঈদ-উর-রব সে সৎ সাহস দেখাবার জন্য এগিয়ে এসেছেন।
একজন মানুষের মৌলিক আদর্শ কী, একজন লেখকের প্রকৃত দায়িত্ব কী? আমি মনে করি, তা হচ্ছে পরিশুদ্ধ মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো। অপশক্তির সঙ্গে আত্মীয়তা না করে, অপশক্তি যতোই পরাক্রমশালী হোক- তার বিরুদ্ধে কথা বলা।
এই যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সত্য ও ন্যায়ের পতাকা তুলে ধরেছেন এমন কিছু কবি- লেখকের নাম প্রনিধানযোগ্য। মহামহিম অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ, নোয়াম চমস্কি, কবি যোশেফ ব্রডস্কি, কবি আমিরী বারাকা, কবি অ্যালেন গিনসবার্গ এমন কতো আলোকিত নাম আমাদেরকে প্রতিদিন শক্তি জোগায়। এমনকি এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বহুল নন্দিত সাংবাদিক, কলামিস্ট, সম্পাদক ফরিদ জাকারিয়ার নামও উল্লেখ করা যায়। সাঈদ-উর-রবের নিবন্ধ পড়ে আমার মনে হয়েছে তিনিও সেই শাণিত চেতনার উত্তরসূরি হিসেবে থাকতে চেয়েছেন।
গ্রন্থটিতে কিছু মুদ্রণ প্রমাদ রয়েছে।
শব্দ নির্বাচনে লেখক আরো মনোযোগী হলে লেখার প্রাঞ্জলতা বাড়তো। লেখাগুলো নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক ঠিকানা, সাপ্তাহিক পরিচয় ও বাংলাদেশের কিছু জাতীয় দৈনিকে বিভিন্ন সময়ে ছাপা হয়েছে। ভূমিকা লিখেছেন ঠিকানা সম্পাদক মুহম্মদ ফজলুর রহমান। গ্রন্থটি লেখক উৎসর্গ করেছেন অগ্রজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা খালিদ-উর-রব ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিমসহ সকল মুক্তিসেনানীকে। বইটির বিক্রয়লব্ধ অর্থ বিভিন্ন মানবতামূলক কর্মে ব্যয়িত হচ্ছে।
মূল্য বাংলাদেশে এক হাজার টাকা, বিদেশে পঁচিশ ডলার। বলা দরকার এই বই লেখা ও বিক্রির মাধ্যমে জনকল্যাণের কাজটি সাধন করতে চেয়েছেন লেখক। এটি প্রকাশ করেছে ঠিকানা গ্র"প অব পাবলিকেশন্স এন্ড মিডিয়া।
---------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ। ২ আগষ্ট ২০০৮ শনিবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।