দক্ষতা পরীক্ষা ছাড়াই প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার লোককে যানবাহন চালানোর পেশাদার লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। মোটরযান আইনে ভারী মোটরযান চালানোর জন্য সরাসরি পেশাদার লাইসেন্স দেওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের চাপে আবার এমন ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ১ জুন নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন দক্ষতা পরীক্ষা ছাড়াই ২৪ হাজার ৩৮০টি লাইসেন্স দেওয়ার জন্য আবেদন করেছে। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীর সঙ্গে আবেদনে প্রতিস্বাক্ষর করেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।
জানতে চাইলে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবেদনটি আমার কাছে আছে। ন্যূনতম পরীক্ষা নিয়ে কীভাবে লাইসেন্স দেওয়া যায়, সে বিবেচনা করছি। ’
বিআরটিএসহ পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স দেওয়ার এই প্রক্রিয়া শ্রমিক ফেডারেশনের একটা ব্যবসা। অতীতেও টাকার বিনিময়ে এমন লাইসেন্স বিক্রি করেছে ফেডারেশন। জানতে চাইলে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান অনেকটা স্বীকার করে নিয়ে বলেছেন, কিছু অনিয়ম হয়েছে।
সে জন্য বিআরটিএর লোকজনও দায়ী।
মোটরযান আইন লঙ্ঘন: আইন অনুযায়ী, লাইসেন্স পেতে আগ্রহীদের প্রথমে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শিক্ষানবিশ লাইসেন্স (লার্নার) নিতে হয়। তিন মাস পর লিখিত, মৌখিক ও মাঠ (চালিয়ে দেখানো) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে হালকা যানবাহন চালানোর লাইসেন্স পাওয়া যায়। এই লাইসেন্সধারী চালক কার, অটোরিকশা, জিপ চালাতে পারবেন। এর অন্তত তিন বছর পর মাঝারি যানবাহন চালানোর লাইসেন্স নিতে হয়।
তখন এর জন্য আবার পরীক্ষা দিতে হয়। এই লাইসেন্সে মিনিবাস, পিকআপ ভ্যান, মিনি ট্রাকসহ ছোট যানবাহন চালানোর অনুমোদন দেওয়া হয়। মাঝারি যানবাহন পাঁচ বছর চালানোর পর ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স দেওয়ার নিয়ম। ভারী লাইসেন্সধারী চালক বাস, ট্রাক, লরিসহ যাবতীয় যানবাহন চালানোর বৈধতা পান। কিন্তু নৌমন্ত্রীর সংগঠন চাইছে, তাদের দেওয়া তালিকা ধরে কোনো পরীক্ষা ছাড়া সরাসরি ভারীসহ অন্যান্য পেশাদার লাইসেন্স দিক বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
উদ্বেগ: এ অবস্থায় সড়কপথে যানমালের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সরকারি প্রতিষ্ঠান সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রসহ নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলনকারী নাগরিকেরা। যোগাযোগমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকারি কমিটি সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘যথাযথ পরীক্ষা ও প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পেশাদার লাইসেন্স দেওয়া খুবই অন্যায়। এসব লাইসেন্সধারীর দ্বারা কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে এবং প্রাণহানি হলে তা হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে। এই হত্যাকাণ্ডের দায় নিতে হবে লাইসেন্স দাতা ও আবেদনকারী উভয়কেই। ’ তিনি আরও বলেন, এসব লাইসেন্সধারীর দ্বারা সংঘটিত প্রাণহানি হত্যাকাণ্ড হিসেবে আদালতে প্রমাণ করা না গেলেও বিবেকের কাছে তারা হত্যাকারী হিসেবেই চিহ্নিত হবে।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স দেওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। গত এক বছরে আমরা ১৬ জেলায় চালকদের সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করেছি। পাঠ্যপুস্তকে সড়ক নিরাপত্তার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতেও কাজ করছি। কিন্তু পরীক্ষা ছাড়া যাকে-তাকে লাইসেন্স দেওয়া হলে আমাদের সব পরিশ্রম বিফলে যাবে। ’
আইন ভাঙার ইতিবৃত্ত: বিআরটিএ সূত্র জানায়, ১৯৯০ সাল থেকেই পরীক্ষা ছাড়া পেশাদার লাইসেন্স দেওয়া শুরু হয়।
বিআরটিএ এ পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ পেশাদার লাইসেন্স দিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় চার লাখই বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ পরীক্ষা এবং প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে দেওয়া হয়েছে বলে বিআরটিএ সূত্র জানায়।
সূত্র জানায়, ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত নৌমন্ত্রীর সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১০ হাজার চালককে পরীক্ষা ও প্রক্রিয়া না মেনেই পেশাদার লাইসেন্স দিয়েছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন বিআরটিএ।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ সালে নির্ধারিত পরীক্ষা ছাড়া সারা দেশে ছয়টি শ্রমিক ইউনিয়নের তালিকা ধরে পেশাদার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগর বাস-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নকে চার হাজার ৭৮৭টি, খাগড়াছড়ি বাস-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নকে এক হাজার ৩৫০টি, খুলনা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নকে ৩১২টি, নড়াইল জেলা মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নকে ২০৫টি, নওগাঁ জেলা মোটর ইউনিয়নকে এক হাজার ৪৭৫টি এবং ঢাকা মহানগর শ্রমিক ইউনিয়নকে এক হাজার ৯৫৩টি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে ঢাকা মহানগর শ্রমিক ইউনিয়নের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী এখনো লাইসেন্স দেওয়া শেষ হয়নি। সব মিলিয়ে ছয়টি সংগঠন ১০ হাজার ৮২টি লাইসেন্সের তালিকা দিয়েছিল।
এসব লাইসেন্স দেওয়ার ঘটনা বিভিন্ন মহলে সমালোচিত হলে ২০০৯ সালে বিআরটিএ সংস্থার তৎকালীন উপপরিচালক (প্রশাসন) জহুরুল ইসলামকে প্রধান করে একটি কমিটি করে। ওই কমিটি দেখতে পায় তালিকায় নাম থাকা লোকজন পরীক্ষা তো দূরে থাক, কোনো রকম ফরমও পূরণ করেনি। পরীক্ষা ছাড়াই যাকে-তাকে উত্তীর্ণ দেখিয়ে পেশাদার লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে শ্রমিক সংগঠনের তালিকা ধরে পেশাদার লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই আদেশ অমান্য করে পরীক্ষা ছাড়া আবার লাইসেন্স দেওয়া শুরু হয়।
সড়কে নৌমন্ত্রীর দৌরাত্ম্য: সারা দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলোর ফোরাম বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। এ হিসেবে পরিবহন খাতের চাঁদা নির্ধারণ, ভাড়া নির্ধারণ, সড়ক নিরাপত্তাসহ যাবতীয় সরকারি বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন তিনি।
গত ২৭ জুলাই যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক বৈঠকে পরিবহন খাতের চাঁদা সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দেওয়ার প্রস্তাব করেন শাজাহান খান।
গত বছরও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে তিনি চাঁদা নির্ধারণ করার জন্য চাপ দেন।
গত ১৬ মে পরিবহন খাতের ভাড়া নির্ধারণের বৈঠকে মন্ত্রী শাজাহান খান উপস্থিত থেকে মালিকদের পক্ষে অবস্থান নেন। ওই বৈঠকে রাজধানীর মিনিবাসগুলোর জন্য সর্বনিম্ন ভাড়া না রাখার প্রস্তাব করেছিল বিআরটিএ। কিন্তু শাজাহান খানের চাপে মিনিবাসেও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। এতে সাধারণ যাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
শাজাহান খান শ্রমিক নেতা হলেও তাঁর পরিবারের মালিকানাধীন একাধিক বাস কোম্পানি আছে। ঢাকা-মাদারীপুর ও রাজধানীর মিরপুর-আবদুল্লাহপুর পথে এসব বাস চলে।
সর্বশেষ পরীক্ষা ছাড়া চালক লাইসেন্সের জন্য আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, ‘দেশে প্রতিবছর গড়ে ৪০ হাজার যানবাহন নামছে। কিন্তু বিআরটিএর লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতা আছে ১১ হাজার। ফলে অনেকে ভুয়া লাইসেন্স দিয়ে গাড়ি চালায়।
এ জন্য শ্রমিক ইউনিয়নের তালিকা অনুযায়ী সহজ শর্তে লাইসেন্স চেয়েছি আমরা। ’
এভাবে লাইসেন্স দিয়ে মানুষের জীবন ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে শাজাহান খান বলেন, ‘আমাদের চালকেরা তো গাড়ি চালাতে পারে। কিন্তু বিআরটিএ লাইসেন্স দিতে পারে না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এত লাইসেন্স দেওয়ার সক্ষমতা নেই প্রতিষ্ঠানটির। ফলে যানবাহনের তুলনায় দেশে বৈধ চালকসংকট আছে।
তাদের দেওয়া তালিকা ধরে লাইসেন্স দিলে এ সমস্যা আর থাকবে না। ’
অবশ্য বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, গত বছর সারা দেশে প্রায় ৬০ হাজার চালককে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। চালক লাইসেন্সের আবেদনে চিকিৎসকের সনদ দরকার হয়। সহজ শর্তে লাইসেন্স দেওয়ার লক্ষ্যে বিআরটিএ সম্প্রতি তাদের বেশ কয়েকটি কার্যালয়ে চিকিৎসক হাজির করে সনদ দিয়েছিল। পরীক্ষাও দ্রুত নেওয়া হয়।
এই উদ্যোগে ৩২ হাজার চালককে লাইসেন্স দেওয়া হয়। কিন্তু পেশাদার লাইসেন্সের জন্য কেউ যায়নি। শ্রমিক সংগঠনগুলো চায়, তারা তালিকা দেবে আর বিআরটিএ মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার লাইসেন্স দিয়ে দেবে।
থানায় মামলা হয়েছে—এমন সড়ক দুর্ঘটনায় গত এক বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার লোক মারা গেছে। গত মাসে মিরসরাইয়ে ট্রাক উল্টে ৪০ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যু সারা দেশকে নাড়া দিয়েছিল।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার নরসিংদীতে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে মারা যায় ১৬ জন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ৮০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনাতেই কোনো না কোনোভাবে চালকের ভুল পাওয়া যায়। এ অবস্থায় পরীক্ষা না নিয়ে চালকদের লাইসেন্স দেওয়া আত্মঘাতী হবে।
সূত্র ঃ প্রথম আলো ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।