সাইফ বিন আইয়ুব •
প্রাচীনকাল হতেই এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা দু'টি ধারায় বিভক্ত। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের এই দেশে ধর্মীয় মুল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে প্রতি বছর মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে পড়া লেখা করে প্রায় দশ লক্ষেরও অধিক ছেলে-মেয়ে। এই বিপুল সংখ্যক ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যত শিক্ষাজীবন কিন্তু নিস্কণ্টক নয়। বিশেষ করে দেশের প্রধান বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই তারা বড় বঞ্চনার শিকার। আশ্চর্য্যজনক হলেও সত্য যে, দেশসেরা এই বিদ্যাপীঠটিই সংবিধান বিরূদ্ধ এবং বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর সাথে সাংঘর্ষিক একের পর এক নিয়ম চালু করে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
একটি দৃশ্যকল্প
মনে করুন লন্ডন, আমেরিকা বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কোনো একটি দেশের এয়ারপোর্টে মাত্রই ল্যান্ড করলো আপনাকে বহনকারী বাংলাদেশ বিমানটি। বিমান থেকে নেমে সবুজ পাসপোর্ট হাতে ধীরে ধীরে চেকিংয়ের দিকে আগাচ্ছেন আপনি। কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধল ওই চেকিংয়েই। দায়িত্ত্বরত সিকিউরিটি গার্ড আপনাকে আটকে দিল। আপনি এই দেশে প্রবেশ করতে পারবেন না।
আপনার অপরাধ? আপনি একজন উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক। আপনার দেশ এখনো উন্নত দেশে পরিণত হতে পারে নি। আপনারা এখনো ক্ষেতে-খামারে কৃষি কাজ করেই বিমলানন্দ লাভ করছেন। মঙ্গলের পানি আবিস্কারে আপনাদের কোনো অবদান নেই। শিল্প-সংস্কৃতিতেও আপনাদের তেমন কোনো কৃতিত্ব নেই।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা ব্যবস্থা, তথ্য-প্রযুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য এমন কোনো খাত নেই যেখানে আপনারা কোনো অবদান রাখছেন। তবে আপনি কেন এই উন্নত দেশে প্রবেশ করবেন? আপনি আপনার যুক্তি দেখালেন, “...আমরা গরীব রাষ্ট্র। আমাদের আহামরি কোনো অর্থসম্পদ নেই যা দিয়ে উন্নতি সম্ভব। তোমাদের দেশে ঢোকার অনুমতি দাও, ব্যবসা-বাণিজ্য করে অর্থ উপার্জন করি, তারপর দেখ দেশটাকে কিভাবে পাল্টে ফেলি!” সিকিউরিটির তৎক্ষণাৎ উত্তর, “আগে মাথাপিছু আয় বাড়াও, উন্নয়নশীল দেশের জন্য নির্ধারিত জিডিপি ক্রস কর। তারপর এসো আমাদের দেশে।
” বলে ধরে বেঁধে জোর করে আপনাকে পাঠিয়ে দেয়া হল বাংলাদেশে।
উপরের ঘটনাটি কাল্পনিক। তবে অনুমান করতে কষ্ট হয় না আদতেই ও রকম কোনো ঘটনা বাংলাদেশের বেলায় ঘটলে দেশজুড়ে কি রকম ঝড় বয়ে যেতে পারে। সরকারি আমলা, এমপি-মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত উক্ত ন্যাক্কার জনক ঘটনার প্রতিবাদ করতেন। কোনো একটি অভিযোগে অভিযুক্ত করে সেই অভিযোগের সমাধানে আপনাকে বাধা প্রদান করলে এবং কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে প্রবেশের সমস্ত মানদণ্ড পূরণ করার পরও আপনাকে সেখানে প্রবেশে বাধা দিলে, প্রিয় পাঠক, বোধ করি আপনিও প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠতেন।
বাংলাদেশের সেরা বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এই বিদ্যাপীঠটি প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে বহু নাটকীয় ঐতিহাসিক ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিলো, শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য যাতে বজায় থাকে এবং মুসলমান ছাত্ররা যাতে নিজেদের ধর্মীয় তাহজীব-তমদ্দুন রক্ষায় সফল হতে পারে সে ব্যবস্থা করা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণার পর থেকেই বিশেষ একটি মহল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চরম বিরোধিতা করে আসছিলো। এই বিরোধিতার সমুচিত জবাব দিতেই ঢাকার নবাব পরিবারের সন্তান নবাব নওয়াব আলী তাঁর জমিদারীর একাংশ বন্ধক রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল এবং ছাত্রদের জন্য একটি বৃত্তি তহবিল গঠন করেন।
যাতে পশ্চাতপদ মুসলমানরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গণে উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে। নাথান কমিশনের রিপোর্টেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। নাথান কমিশনে বলা হয়, “We do not forget that the creation of the university was largely due to the demand of the Muslim community of eastern for greater facilities for higher education.”
তৎকালীন যে বুদ্ধিজীবী সমাজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলো, আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৯২ বছর পার হওয়ার পরও তথাকথিত সেই বুদ্ধিজীবী সমাজের উত্তরসূরীরা মাদরাসা ছাত্রদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে নানাবিধ অন্তরায় সৃষ্টি করে চলেছেন।
যারা কথায় কথায় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের “পিছিয়ে পড়া” বলে আখ্যা দিতে বিমলানন্দ বোধ করেন তারা সাধারণত সুযোগ পেলেই, “মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন, আধুনিকীকরণ প্রয়োজন” টাইপের কথা বলেন। কিন্তু এই লেখার প্রথম অংশের সিকিউরিটি গার্ডের মতো তারাও মাদরাসা ছাত্রদের সমস্যা সমাধানকল্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ভর্তির চরম বিরোধিতা করেন এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সমস্ত শর্তাবলী পূরণ করার পরেও তাদেরকে এসএসসি ও এইচএসসি লেভেলে বাংলা-ইংরেজীতে ২০০ নম্বর অতিরিক্ত পড়ার অযৌক্তিক শর্তের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন।
এই “আবশ্যক ২০০ নম্বর”-এর ফাঁদে ফেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৩টি বিষয় মাদরাসা ছাত্রদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে। যা স্পষ্টতই দেশের সংবিধান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩– এর পরিপন্থী। কিন্তু সংবিধান বা শিক্ষানীতিতে যাই থাকুক না কেন, উচ্চশিক্ষায় ভর্তিতে অহেতুক শর্তারোপ করার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের নিষিদ্ধ করা এখন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার মেধা তালিকায় প্রতিবছরই মাদরাসা শিক্ষার্থীরা প্রথম সারি দখল করে নিলেও তারা কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ২৬টি বিভাগের মধ্যে ১৩টিতেই ভর্তি হতে পারে না (সর্বশেষ ২০১২-১৩শিক্ষাবর্ষের নীতিমালা অনুযায়ী)!
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বাংলা ওইংরেজিতে ২০০ নম্বরের শর্তারোপ করে ১৯৯৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সর্বপ্রথম বাংলা ও ইংরেজি বিভাগে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিষিদ্ধ করে। এরপর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে শর্তারোপ করা হয়।
২০০৮ সালে বেশ কয়েকটি বিভাগে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে ফের শর্তারোপ করে বিশ্ববিদ্যালয়। তখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রশাসন সব বিষয়ে ভর্তির শর্ত তুলে নেয়। ২০০৯ সালে প্রশাসন আরও কয়েকটি বিভাগে শর্তারোপ করে। বিষয়গুলো হচ্ছে– ভাষাবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডারস্টাডিজ, অর্থনীতি, উন্নয়ন অধ্যয়ন এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতি। এরপর ২০১০-১১শিক্ষাবর্ষে সমাজবিজ্ঞান বিভাগেও ভর্তি নিষিদ্ধ করা হয়।
সর্বশেষ গত বছর (২০১২ সালে) তিনটি বিষয় শর্তারোপ করা হয়েছে। বিভাগগুলো হচ্ছে– আইন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা (ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারাবিলিটি স্টাডিজ) ও পপুলেশন সায়েন্স। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি নির্দেশিকায় এইচএসসি বা সমমান পাশ যে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেন বলে স্বীকৃত আছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট কিছু বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় বাংলা-ইংরেজিতে নির্ধারিত নম্বর পাওয়ার শর্ত ছাড়া এসএসসি ও এইচএসসিতে অতিরিক্ত ২০০ নম্বরের বাংলা-ইংরেজি পড়ে আসার শর্ত পুরোপুরি অযৌক্তিক বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। বস্তুত বাংলা-ইংরেজিতে অতিরিক্ত ২০০ নম্বরের শর্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরোভর্তি প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।
এই অদ্ভুত প্রক্রিয়ার কারনে দেখা যায়, সমমানের সার্টিফিকেট নিয়ে আসা কোন ছাত্র ভর্তি পরীক্ষায় বাংলা-ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়ার পরও আকাঙ্খিত বিষয়ে ভর্তি হতে পারে না। তখন স্বাভাবিকভাবেই ভর্তি পরীক্ষার যথার্থতা নিয়েও সাধারণের মনে প্রশ্ন তৈরী হয়।
বাংলাদেশ সংবিধান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০- এর সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ পাঠকের জ্ঞাতার্থে এখানে দেয়া হল। যেহেতু আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারো বলেছেন, “জনগণের ভোট নিয়ে সংবিধান সংশোধন করেছি। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে।
একচুলও নড়া হবে না। অর্থাৎ সবকিছু সংবিধান মতে চলবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৯(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, “সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবে। ” ২৮ (৩) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদবা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না। ” ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০' এ শিক্ষার ৩০ টি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ৮ নাম্বারে বলা হয়েছে: ‘‘বৈষম্যহীন সমাজ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে মেধা ও প্রবণতা অনুযায়ীস্থানিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সকলের জন্য শিক্ষা লাভের সমান সুযোগ-সুবিধা অবারিত করা।
শিক্ষাকে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে পণ্য হিসেবে ব্যবহার না করা। ’’ Dhaka University Order,1973 –এর ৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, The Dhaka University shall be open to all parsons of either sex and of whatever religion, race, creed, class or colour". এখানে কোন বিশেষ সম্প্রদায় বাশ্রেণীর প্রতি বৈষম্য করা হয়নি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে একমাত্র মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে মেধাকে। মেধার মূল্যায়ন পদ্ধতি হলো লিখিত ভর্তি পরীক্ষা। যেমনটি বলা হয়েছে Dhaka University Ordinances and Regulations” Gi Chapter ২ এর ৩(২) এ, “Candidates shall be admitted on the basis of merit based on written test to be conducted by the respective unit and according to the availability of number of seats fixed by the General Admission Committee.”
সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের লক্ষ্যে কোটাপদ্ধতি বুদ্ধিমান মাত্রই সমর্থন করবেন বলে মনে করি এবং বাংলাদেশে এই পদ্ধতি বেশ ভালোভাবেই চালু আছে।
যে সমস্ত নীতিনির্ধারক-বুদ্ধিজীবীগণ মাদরাসা ছাত্রদের “সেকেলে-পিছিয়ে পড়া” বলে উপরে উপরে আফসোস করেন তারা অবশ্যই মাদরাসা ছাত্রদের “উন্নতি” আশা করেন। তাদের কাছে অনুরোধ, সিকিউরিটি গার্ডের মতো মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বাধা দেবেন না, তাদের উন্নতিকল্পে বরং উচ্চ বিদ্যাপীঠটিতে “মাদরাসা কোটা” চালু করা যায় কিনা সেটা ভেবে দেখুন। আর যারা সংবিধান মতে সব কিছু পরিচালনা করতে চান, তাদের কাছেও অনুরোধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনাতেও সংবিধান অনুসরণ করুন, সেখান থেকে এক চুল নড়ার দরকার নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।