আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছাগু ও পাঠা নিয়ে আওয়ামী লীগ এমপির কলাম, এবং সাহার আফার একটা কিচ্ছা

জামাত-শিবির দূরে গিয়া মর! বাংলাদেশ প্রতিদিনে আওয়ামি এমপি গোলাম মাওলা রনির কলাম পড়লাম, ইন্টারেষ্টিং মনে হওয়ায় শেয়ার করলাম। -------------------------------------------------------------------- ছাগু রনি-ভণ্ড পার্থ সমাচার গোলাম মাওলা রনি অনেককেই অকথ্য ভাষায় গালাগাল দেওয়া হয়েছে। গাল দেওয়া হয়েছে ড. আকবর আলি খান, ড. আসিফ নজরুল, ড. পিয়াস করিম, সাংবাদিক নুরুল কবির, ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ ও আমাকে। ঘটনার সূত্রপাত একটি পোস্টারকে কেন্দ্র করে। তাও আবার ইন্টারনেটের পোস্টার।

জনৈক ব্যক্তি উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গের ছবি সংবলিত একটি পোস্টার বানিয়ে নিচে লিখেছে- 'আমি উনাদেরকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি এবং ভালোবাসি। তাদেরকে কেউ গালি দিলে আমি কষ্ট পাই। ' পোস্টারটি ফেসবুকে পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গে হাজারো মন্তব্য। সুখের কথা হলো, বেশির ভাগ লোকই ভালো মন্তব্য করেছেন। অনেকে যুগপৎভাবে বা পৃথক পৃথকভাবে আমাদের সমালোচনা করেছেন।

আবার কেউবা গালমন্দ করেছেন অকথ্য ভাষায়। জনৈক তরুণ বন্ধু বলেছেন- রনি তো একটা ছাগু আর পার্থ হলো ভণ্ড। পার্থর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি রাজনীতি বোঝেন না। কতগুলো মুখস্থ করা কথা কিছুদিন পর পর টেলিভিশনে হাজির হয়ে উপস্থাপন করেন, কেবল চমক সৃষ্টির জন্য, যা তিনি নিজেই বিশ্বাস করেন না। অন্যদিকে তার প্রয়াত পিতার রাজনৈতিক দর্শন, অর্থ উপার্জন এবং সেসব অর্থের ওপর বসে পার্থের পরিবার একদিকে বিলাসিতায় মত্ত অন্যদিকে নীতি ও আদর্শ নিয়ে বাগাড়ম্বর- এসব অভিযোগ তুলে নানারকম আপত্তিকর মন্তব্য।

বিষয়টি নিয়ে আমি পার্থের সঙ্গে ফোনে আলাপ করে কিছু লেখার ব্যাপারে তার অনাপত্তি নিয়ে নিয়েছি। তার যদি ভিন্ন বক্তব্য থাকে সে ক্ষেত্রে হয়তো তিনি তা বলবেন। আমি আর তার সম্পর্কে কিছু বলব না বা সাফাই গাইব না। প্রসঙ্গক্রমে তার নামটি হয়তো একাধিকবার চলে আসতে পারে। এবার আমি নিজের সম্পর্কে কিছু বলার চেষ্টা করব।

আমাকে তেমন কিছু বলা হয়নি কেবল 'ছাগু' ছাড়া। এর অর্থ আমি ভালো মতো বুঝিনি। দুরকম হতে পারে। বাচ্চা ছাগল অর্থাৎ একেবারে অল্পবুদ্ধির মানুষ অথবা ছাগলের গু বা মল বা বিষ্ঠা। আমি যেহেতু অভিযোগকারীর মতোই একজন মানুষ সেহেতু অন্য মানুষের মর্যাদার স্বার্থে নিজেকে ছাগলের মলের পরিবর্তে 'বাচ্চা ছাগল' গালিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে কিছু আলোচনা করব।

কিন্তু সবার আগে ছাগল সম্পর্কে আমার কিছু অভিব্যক্তির কথা বলে নিই। বাংলাদেশের যে প্রান্তে আমার জন্ম সেখানে শৈশব বা কৈশোরে আমি ছাগল শব্দটি খুব কমই শুনেছি। আমাদের গ্রামে সবাই বলত খাসি। শৈশবে পুরুষ ছাগলদের পুরুষত্বহানি ঘটিয়ে খাসি বানানো হতো। গ্রামের সব ছাগলই মূলত খাসি।

এখনো আমরা ছাগলের মাংস না বলে খাসির মাংসই বলে থাকি। যাদের পুরুষত্বহানি ঘটানো হয় না তাদের বলা হয় পাঁঠা। আমাদের গ্রামে এবং পার্শ্ববর্তী ১০-১২টি গ্রাম মিলে কোনো পাঁঠা ছিল না। ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার শ্যামপুর গ্রামে আমার জন্ম। কাছেই চৌদ্দরশির বাজার নামে বড় একটি হাট বসত এবং এখনো বসছে।

সত্তরের দশকে এ বাজারে ভুড্ডা নামের এক বিহারি ঝাড়ুদার ৫-৬টি পাঁঠা পুষত। মূলত প্রজনন কাজে এগুলোকে ব্যবহার করত। আমি তখন সবে বাইশরশি শিবসুন্দরী একাডেমীতে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছি। ক্লাসের কয়েকটি দুষ্ট ছেলে একদিন আমাকে জোর করে পাঁঠা দেখতে নিয়ে গেল। আমি বললাম, পাঁঠার মধ্যে এমনকি দেখার জিনিস আছে, যা স্কুল ফাঁকি দিয়ে দেখতে হবে? ওরা বলল আছে! অনেক মজা আছে।

যা হোক, গেলাম এবং মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে পাঁঠাসী দেখলাম। আমার খুব ঘেন্না হলো। বিরক্ত হলাম এবং লজ্জাও পেলাম। আমি চলে এলাম কিন্তু দুষ্টরা সব রয়ে গেল। এর পর থেকে পাঁঠা শব্দটি আমার কাছে মহা বিরক্তিকর এবং অপমানজনক ইঙ্গিত মনে হয়ে আসছে।

ফেসবুকের সেই ভদ্রলোকের সন্তানকে অসংখ্য ধন্যবাদ, তিনি আমাকে দয়া করে পাঁঠা বলেননি। এবার খাসি নিয়ে আমার উৎসাহের কথা বলছি। আগে আমি খাসি বা খাসির মাংস কোনোটাই পছন্দ করতাম না। কিন্তু এক বন্ধুর কারণে দুটোই আমার ভীষণ পছন্দ। ছোটবেলায় বন্ধুটিকে এক হুজুর সুন্দর করে বেহেশত ও দোজখ বোঝানোর পর জিজ্ঞাসা করলেন, কোনটি চাও? সে উত্তর করল, বেহেশত।

তা বেশ! বেহেশতে গিয়ে আল্লাহর কাছে প্রথমে কি চাইবে। বন্ধুটি বলল, সুন্দর করে রান্না করা এক গামলা খাসির মাংস, ঘিয়ে ভাজা পরাটা দিয়ে মজা করে খাব। ঘটনাটি শোনার পর আমি দুনিয়াতেই প্রথম সেদিন তা খেয়েছিলাম। বলতে গেলে সেই স্বাদ আমার জিহ্বায় এখনো লেগে আছে। এবার প্রসঙ্গে আসি।

'বাচ্চা ছাগল' অর্থাৎ নির্বোধ। রাজনৈতিক মাঠে আমার কর্মকাণ্ড নির্বোধের সঙ্গে এবং পার্থর কর্মকাণ্ডকে ভণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আমার অপরাধ আমি প্রথাবিরোধী কিছু বক্তব্য প্রদান করি মাঝে-মধ্যে। কখনো কখনো টেলিভিশন টকশোতে। কিংবা সেমিনারে অথবা পত্রপত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে।

আমি যা বলি তা বিশ্বাস করি এবং নিজ কর্মক্ষেত্রে তা অনুসরণ করি। ১৯৯১ সাল থেকে ব্যবসা করি। নিজের প্রতিষ্ঠান, পরিবার এবং নির্বাচনী এলাকায় যেখানে কি না মহান আল্লাহ আমাকে ক্ষমতা প্রয়োগের শক্তি ও স্বাধীনতা দিয়েছেন। সেখানে যে কেউ খোঁজ নিলেই আমার বক্তব্যের সারবত্তা বাস্তব রূপ দেখতে পাবেন। আমি কথা বলার সময় যথেষ্ট সতর্কভাবে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করি।

আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত সংসদ সদস্য। তারপর আবার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ অনুগ্রহে মনোনয়নপ্রাপ্ত। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতা-কর্মী যেভাবে বছরের পর বছর রাজনীতির জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা করেছেন, সত্যি বলতে কি, আমার ক্ষেত্রে সেরূপ ঘটেনি। কাজেই আমি যদি ভালো করি, তবে সবাই বলবে ও আওয়ামী লীগের গর্ব আর যদি মন্দ করি তাহলে সবাই জননেত্রীকে দোষ দেবে। বলবে, বলা নেই, কওয়া নেই, যাকে ইচ্ছা তাকে মনোনয়ন দিয়ে দলটাকে সর্বনাশ করছেন।

এ জন্য সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আমার আচরণবিধি কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে সাধ্যমতো পড়াশোনা করেছি, গুণীজনের পরামর্শ নিয়েছি এবং দিনের পর দিন ধ্যানমগ্ন হয়ে চিন্তা করেছি। এমপি হওয়ার পর নতুন করে পড়ছি ইবনে খালদুনের আল মুকাদ্দিমা, আবুল আসাদের মক্কার পথে, ম্যাকিয়াভেলির দ্য প্রিন্স, প্লেটোর রিপাবলিক, হিরোডোটাসের হিস্টিরিয়া, বাবুর নাম, দ্য হোয়াইট মোগল, চেঙ্গিস খাঁসহ অনেক বই। লক্ষ্য একটিই-কীভাবে দলের এবং দলীয় প্রধানের আনুগত্য করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখে জাতীয় উন্নয়ন এবং দল ও দলের প্রধানকে জঞ্জালমুক্ত রাখার কৌশলও অবলম্বন করতে হবে। গত চারটি বছর তো সে মতেই কাজ করে আসছি।

আমি আমার দলের মধ্যে সামনা-সামনি তেমন কোনো সমালোচনার মুখোমুখি হইনি। কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী বলেছেন, ওমুকে তোমাকে গালি দিয়েছেন। যেহেতু তারা উল্লেখযোগ্য কেউ ছিলেন না, তাই বিষয়টি নিয়ে তাদের মুখোমুখি হইনি। অন্যদিকে কারও শিক্ষাদীক্ষার মানের সঙ্গে আমার শিক্ষাদীক্ষার মানের ব্যাপক পার্থক্য থাকলে সে ক্ষেত্রে নিরাপদ দূরত্ব রাখাই উত্তম। পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন হলো ক্ষমতাবানদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলা।

এটা এত সোজা নয়। এটা কোনো ছাগল করতে পারে না। কিংবা কোনো ভণ্ড এ কাজ করে না। এমনকি পাগলেও করে না। আপনারা কি শুনেছেন, কোনো পাগল র্যাবের বড় কর্তা বা থানার ওসির সঙ্গে পাগলামি করেছে! অবশ্যই না।

আপনারা কি শুনেছেন কোনো রাজা-বাদশাহ কিংবা আমির-ওমরাকে পাগলা কুকুরে কামড় দিয়েছে! দেয়নি। কারণ প্রকৃতির কতগুলো অমোঘ নিয়ম রয়েছে। যারা বিশ্বাস করেন বা যারা বিশ্বাসী তাদের জন্য বলছি- 'আল্লাহ যখন কোনো ব্যক্তিকে বিশেষ মর্যাদা, ক্ষমতা বা পদ-পদবি দান করেন, সেই সম্পর্কে জমিনের সব সৃষ্টিকুল ওয়াকিবহাল থাকে। জমিনের সব প্রাণী এমনকি বৃক্ষলতাও সংশ্লিষ্ট বিশেষ ব্যক্তিকে সম্মান করে অথবা লানত বর্ষণ করে। ' এখন প্রশ্ন হতে পারে, আমি কেন প্রথাবিরোধী কাজ করছি।

আমার লাভ কি! দলের লাভ কি! প্রধানমন্ত্রীর কি লাভ! কিংবা এগুলো করার শক্তি ও সাহস আমি কোথা থেকে পাই? সম্মানিত পাঠকদের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার পাশাপাশি বর্তমান একটি প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে লেখার ইতি টানব। গোত্র ও গোত্রপতির আনুগত্যের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ রয়েছে আরব দেশগুলোতে। আরবিতে একটি শব্দ রয়েছে হামিম। অর্থ বন্ধু। সেই বন্ধু যে কখনো বিপদের সময় ছেড়ে যায় না।

হামিমের প্রতিশব্দ পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় নেই। এটি কোরআনেরও শব্দ, যা কিনা একাধিক স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। আরব দেশের গোত্রপ্রীতি এবং আনুগত্যের ধরনে কখনো গোত্রপতির সমালোচনা করা হয় না। গোত্রপতিও সেভাবে চলেন না। কারণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন, যাতে করে সমালোচনার ক্ষেত্র তৈরি না হয়।

মরুভূমির বিরূপ আবহাওয়া এবং বেদুইন জীবনের হাজার বছরের ঐতিহ্য তাদের এই শিক্ষায় অভ্যস্ত করে তুলেছে। ইবনে খালদুন তার আল মুকাদ্দিমা গ্রন্থে সেই কাহিনীই বর্ণনা করেছেন। তার মতে, গোত্রপ্রধানের সমালোচনা করা যাবে না। গোত্রের ক্ষতির কারণ এমন কর্মসমূহ প্রতিহত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যদি কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের কর্মকাণ্ড গোত্রের দুর্নাম বয়ে আনে কিংবা গোত্রের ভবিষ্যৎকে বিপর্যস্ত করে ফেলার আশঙ্কা দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা পরিবারকে নিমর্ূল করার কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কোটি কোটি ভক্ত-সমর্থক আশা করেন, সব সংসদ সদস্য সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করুক। মন্ত্রীরা এমনভাবে কাজ-কর্ম করুন, যাতে দেশ ও জাতির উপকার হয়, দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় এবং প্রধানমন্ত্রীর হাত শক্তিশালী হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো এমপি বা মন্ত্রী যদি একক সিদ্ধান্তে কিংবা ব্যক্তিগত পছন্দ বা অপছন্দ অথবা রাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করেন এবং তা যদি প্রধানমন্ত্রী এবং দলের ভাবমূর্তির জন্য হুমকিস্বরূপ হয়, সে ক্ষেত্রে সেই এমপি বা মন্ত্রীর সমালোচনা করা প্রতিটি দলীয় নেতা-কর্মীর জন্য ফরজ। গোপনে নয় কিংবা দলীয় ফোরামে নয় বা ব্যক্তিগতভাবে নয়_ বরং প্রকাশ্যে এবং সমস্বরে সমালোচনা হওয়া উচিত। এতে করে অন্য সবাই যেমন সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাবেন তেমনি নিজেদের লোক সমালোচনা শুরু করলে বিরোধী পক্ষ ঢোল বাজানোর সুযোগই পাবেন না।

এমনটি করলেই দলের নেতৃত্বে যোগ্য লোক ছাড়া অন্য কেউ টিকতে পারবে না। যেসব জাতি গত একশ বছরে সফলতার স্বর্ণশিখরে পেঁৗছেছে তারা সবাই এমনটি করেই এগিয়েছে। এই বোধ এবং বুদ্ধি থেকেই আমি কতিপয় প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিই। আমার বিশ্বাস- দলীয় প্রধান এবং দল আমার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বরং ভিন্নমত পোষণ করার পরও আমাকে বারণ করার জন্য গণতন্ত্রমনা দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে চিন্তাশীল বোদ্ধাজনদের কাছে।

আমি মূলত সরকার ও দলের স্বার্থেই এ কাজ করি। আমাদের দলের যেসব নেতা অত্যন্ত রক্ষণশীল অবস্থানে থেকে দলের পক্ষে কথা বলেন, বাস্তবতা হলো_ তারা সত্য বললেও মানুষ বিশ্বাস করে না। অন্যদিকে কিছু হালকা-পাতলা আত্দসমালোচনার পর সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো উপস্থাপন করলে জনগণ সহজেই তা গ্রহণ করে। কাজেই আমি দ্বিতীয় পন্থাটি সবসময় অবলম্বন করে সরকারের সফলতাকে জনগণের মনের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করি। এটি অত্যন্ত দুরূহ এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়।

প্রায়ই প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়তে হয়। বিরক্তিকর সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় কখনো কখনো। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। সেদিন ছিল ভারতের জাতীয় দিবস। ভারতীয় দূতাবাস সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে আয়োজন করেছিল একটি অনুষ্ঠানের।

স্থান, ঢাকার র্যাডিসন হোটেল। সমাজের সর্বস্তরের নেতা সেখানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। আমিও গিয়েছিলাম আরও অনেকের মতো। সরকার-বিরোধী দল, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, বর্তমান ও সাবেক সামরিক ও বেসামরিক আমলা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং নামকরা কবি-সাহিত্যিক-লেখকদের মিলনমেলা বসেছিল। বিভিন্ন কারণে আমি ছিলাম সেখানে সর্বাধিক ব্যস্ত মানুষদের একজন।

কেননা, আমন্ত্রিত হাজার দেড়েক অতিথির বেশির ভাগই আমার পরিচিত এবং তাদের সঙ্গে রয়েছে আমার চমৎকার ব্যক্তিগত সম্পর্ক। হালকা পানাহার করতে করতে অতিথিরা আড্ডায় মেতে উঠলেন। প্রেম-বিয়ে-রাজনীতি-অর্থনীতি এবং অন্যান্য চটুল বিষয় নিয়ে খোশগল্প হচ্ছিল। পুরুষরা হা হা করে এবং মহিলারা হি হি করে হাসছিলেন মাঝে-মধ্যে। কোথাও দুই-তিনজনের জটলা আবার কোথাও ৮-১০ জনের।

আমি ঘুরে ঘুরে সব জায়গায়ই যাচ্ছিলাম এবং রঙবেরঙের কথা শুনছিলাম। একটি ৮-১০ জনের আড্ডার কাছে পেঁৗছামাত্রই শুনলাম, ওই দেখো ভিজিটাল মন্ত্রী একা দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছেন। কেউ বলছেন_ তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে কীভাবে স্যাটেলাইট পাঠানো হবে, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। কাছে যেও না শটসার্কিট হবে কিংবা রেডিয়েশনে আক্রান্ত হবে! এক সাংবাদিক নাকি তাকে প্রশ্ন করেছিলেন_ 'হ্যাকার'দের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেবেন! তিনি বললেন, আমরা 'হকার' উচ্ছেদের জন্য খুব তাড়াতাড়ি কঠোর ব্যবস্থা নেব। শুনেই সবাই হেসে উঠল হা হা করে।

আমি মন্ত্রী মহোদয়ের দিকে তাকালাম। তিনি একা দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ তাকে সালামও দিচ্ছেন না বা কাছে গিয়ে কথাও বলছেন না। এমনকি একজন বেয়ারাও তার কাছে যায়নি খাদ্য ও পানীয় নিয়ে। এ ধরনের অনুষ্ঠানে তিনি সম্ভবত অভ্যস্ত নন।

দূর থেকে মনে হলো তিনি খুবই বিব্রত। তার চাঁদ মুখখানা আলো-আধারিতে অনেকটা বিবর্ণ। তিনি কারও দিকে না তাকিয়ে হোটেলের বলরুমের ঝাড়বাতির দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার দলের মন্ত্রীর একাকিত্ব এবং আড্ডাতে তাকে নিয়ে ঠাট্টা-মস্কারার চটুল শব্দমালা শুনে আমার মন হাহাকার করে উঠল। আমি বাচ্চা ছাগলের মতো মন্ত্রী মহোদয়কে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এগিয়ে গেলাম।

সবাই নিষেধ করলেন। তারপরও গেলাম। মন্ত্রী মহোদয়ের সামনে গিয়ে আমি তাকে সালাম দিলাম। তিনি আকাশ থেকে মুখ নামালেন। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

আমি আবার সালাম দিলাম। তিনি আবারও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম- আপা কি আমাকে চিনতে পেরেছেন! আমার জানা মতে তার স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল। মনে থাকে না। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কয়েকদিন আগে নাকি তাকে সালাম দিয়েছিলেন।

মন্ত্রী বললেন, আপনাকে যেন চেনাচেনা লাগছে? মোতাহার ভাই বললেন, জি আপা, আমি একজন প্রতিমন্ত্রী এবং গত চার বছর ধরে আপনার সঙ্গে কাজ করছি। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ঘটল ব্যতিক্রম। তিনি হুঙ্কার দিলেন, জি তোমাকে চিনতে পেরেছি! তোমাকে কে না চেনে? আমি তোমার সালাম নেইনি এবং নেব না। কেন? তিনি বললেন, তুমি আমার অনেক সমালোচনা করছ। আওয়ামী লীগ কর, আবার আমার সমালোচনা কর? এত বড় সাহস।

আগে দল থেকে পদত্যাগ কর, তারপর সালাম দিতে এসো। আমার তো আক্কেল গুড়ুম। আল্লাহ আল্লাহ করে আশপাশে তাকালাম। কেউ দেখল কিনা বা শুনল কিনা। বিধিবাম।

৮-১০ জন চলে এলেন। সাংবাদিক, কূটনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী। এমন সময় প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা ভাইও এলেন। মন্ত্রী বললেন, আমি মূসা ভাইয়ের সালামও নেব না। আবার বললেন_ মূসা ভাইয়ের সালাম নেব কারণ তিনি কখনো আমার সমালোচনা করেননি।

মূসা ভাই আগামাথা না জানার কারণে হাসতে থাকলেন। এক সাংবাদিক বললেন, রনি ভাই তো বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ বা প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করেন না। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ে কখনো কখনো কারও বক্তৃতা-বিবৃতির আলোচনা করতে গিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। মন্ত্রী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, তুমি কে! তোমার সঙ্গে আমি কোনো কথা বলব না।

তোমার কথা থাকলে আমার অফিসে এসো। সাংবাদিকও কম যান না। বললেন, আপনার কাছে কোনো কাজের জন্য জীবনে যাইনি আর যাবও না। মন্ত্রীর উত্তর, তুমি তো একবার গিয়েছিলে। জি গিয়েছিলাম।

তবে ছয় মাস চেষ্টা করেও একজন ওসি বদলি করতে পারেননি। পরে আপনার প্রতিমন্ত্রীকে দিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে করিয়েছিলাম। আমি খুবই বিব্রত ও পেরেশান হয়ে পড়লাম। এসব অবস্থায় পড়লে মানুষ কৃত্রিমভাবে হাসার চেষ্টা করে। প্রমিত বাংলায় বলা হয় কাষ্ঠ-হাসি।

বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয়_ 'মোর মনু ভ্যাটকাইতেছে'। কাষ্ঠ হাসি বা ভেটকী মারা হাসি না দেওয়াই ভালো। আমি মুখ গম্ভীর করে খাবার টেবিলের কাছে গেলাম। একটু চটপটি ও তিনটি কাঁচামরিচ খেলাম। কাঁচামরিচ চিবিয়ে চিবিয়ে খেলে নাকি মাথা ঠাণ্ডা হয় এবং মনও ভালো হয়_ বিএনপির এমপি পাপিয়া আমাকে সে কথা বলেছিল।

পরীক্ষা করার সুযোগ পাইনি। সেদিন পেলাম। প্রথমে চোখ দিয়ে দর দর করে পানি পড়ল, এর পর মাথা ও বগল ঘামাল। আমি মুখ ধোয়ার জন্য বাথরুমে গেলাম। চোখে-মুখে পানি দেওয়ার পর কিছুক্ষণ হাঁ করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিলাম।

বেশ ভালো লাগল। পাঁচ মিনিট পর আমি আনন্দে ভরপুর হয়ে সভাস্থলে প্রবেশ করলাম। দেখলাম সেই মন্ত্রী মহোদয় আবার একা দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার আশপাশে কেউ নেই বা যাচ্ছেও না। মিনিট দশেক পর দেখলাম তিনি নেই।

যা বলছিলাম_ ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গের মতের বিরুদ্ধে কথা বলা তত সহজ নয়। কোনো একটি বিষয়ের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, জ্ঞান, সাহস, বিশ্বাস ও আস্থা, নির্লোভ মনোভাব এবং সর্বোপরি মহান আল্লাহর প্রতি অসীম নির্ভরতা না থাকলে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে সত্য কথা বলা যায় না। আবার কিছু সত্য বলাও অনুচিত। যে সত্য প্রকাশে লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি এবং ব্যক্তির অপমান এবং ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত_ সেই সত্য না বলাই উত্তম। চেপে যাওয়া উচিত।

সত্য বলার একটি উদাহরণ পেশ করার লোভ সামলাতে পারছি না_ এটি দুনিয়ার অন্যতম মহান শাসক আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুরের ঘটনা। বর্ণনাকারী স্বয়ং ইমাম গাজ্জালি (রহ.)। আবদুর রহমান ইবনে আমর আওযায়ী (রহ.) বলেন_ "আমি সমুদ্র উপকূলে ছিলাম। খলিফা লোক পাঠিয়ে আমাকে দরবারে ডেকে আনলেন। বললেন- আপনি আমার কাছে আসেন না কেন? আমি বললাম- আমার কাছে আপনার কি প্রয়োজন।

তিনি বললেন, কিছু শিখতে চাই। কিন্তু আপনি তো ভুলে যাবেন! না ভুলব না। কারণ আমি নিজের প্রয়োজনেই জিজ্ঞাসা করছি। আমি বললাম, আশঙ্কা হয়, আপনি শুনবেন, কিন্তু তদানুযায়ী কাজ করবেন না। এ কথা বলতেই রাজপ্রহরী আমাকে হুঁশিয়ার করে দিল এবং তরবারির কব্জায় হাত রাখল।

খলিফা তাকে শাসিয়ে বললেন, এটা সওয়াল-জওয়াবের মজলিস। শাস্তির জন্য নয়। এতে আমার মন প্রফুল্ল হয়ে গেল এবং কথা বলার জন্য মনের কপাট খুলে গেল। আমি বললাম- হে আমিরুল মোমেনিন, আমি মকহুলের কাছ থেকে এবং তিনি আতিয়্যা ইবনে বুসরের কাছ থেকে বর্ণনা করেন_ রাসূল (সা.) বলেছেন_ যে বান্দার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে ধর্ম সম্পর্কে কোনো উপদেশ আসে সেটা নিঃসন্দেহে অতি উত্তম নেয়ামত। বান্দা কৃতজ্ঞতা সহকারে তা কবুল করলে উত্তম।

নতুবা এর কারণে তার গুনাহর পরিমাণ বেশি হবে এবং আল্লাহও নারাজ হবেন। হে আমিরুল মোমেনিন_ রাসূল (সা.) বলেছেন_ যে শাসক প্রজাদের অহিতকামী হয়ে মারা যাবে, আল্লাহ তার ওপর জান্নাত হারাম করে দেবেন। অতএব আপনার উচিত আল্লাহর ওয়াস্তে প্রজাদের মধ্যে সত্য কায়েম করা, ন্যায়বিচার সহকারে থাকা, তাদের দোষ গোপন করা, ফরিয়াদির ফরিয়াদ শ্রবণ করা। তাদের জন্য ফটক বন্ধ না করা এবং তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হওয়া। হে খলিফা আপনি বলুন- যারা আপনার বিছানায় থাকে এবং আপনার ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত থাকে, তার হিসাব কি আপনাকে দিতে হবে না? হে খলিফা! যাবুর কিতাবে আল্লাহ হজরত দাউদ (আ.)কে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেন_ যখন বাদী ও বিবাদী তোমার সম্মুখে উপস্থিত হয় এবং তোমার মনে তাদের একজনের প্রতি ঝোঁক থাকে তখন কখনো এ কথা চিন্তা কর না যে, হোক সে-ই লাভ করুক এবং বিজয়ী সে-ই হোক।

যদি এরূপ চিন্তা কর তবে তোমার নাম নবুয়তের দফতর থেকে কেটে দেব। এর পর তুমি আমার খলিফাও থাকবে না এবং কোনো মাহাত্দ্যও পাবে না। হে দাউদ আমি আমার রাসূলগণও মনোনীত শাসকগণকে উটের রাখালের মতো করেছি। রাখালেরা পথঘাট সম্পর্কে সম্যক অবগত থাকে এবং শাসন নরমভাবে করে। মোটা উটকে বেঁধে রাখে এবং দুর্বল ও কৃশ উটের সামনে ঘাস-পানি দেয়।

আবদুর রহমান ইবনে আমর আওযায়ী (রহ.) বলেন, এই পর্যন্ত শুনে খলিফা আল মনসুর মুখে রুমাল দিয়ে এত কাঁদলেন যে, আমাকেও কাঁদিয়ে দিলেন। " লেখক : রাজনীতিক  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.