দেশের অর্থনিতী ও সামাজিক অবক্ষয়কে সামনে রেখে ১৯৭৮ সালের দিকে এদেশে প্রথম নতুন একটি থিয়েটার ফর্মের প্রবেশ ঘটে। উদ্দেশ্য ছিল এদেশের মানুষের কাছাকাছি থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রসার ঘটানো। পপুলার থিয়েটার নামের এই নতুন থিয়েটার টি পরবর্তিতে Development Theatre নামে পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশে এর নাম হয় উন্নয়ন নাট্য। এই নতুন রিতীর নাটক পদ্ধতিটি দ্রুত জনপ্রীয়তা পেলেও পরে নানা দোষে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
এই থিয়েটার পদ্ধতিটি বিদেশী ফান্ড নির্ভশীল হয়ে পড়ে। এনজিওরা নানা ভাবে একে ব্যবহার করে। উন্নয়ন সংস্থাগুলো তাদের নিজস্ব প্রচারনা ও বার্তা প্রধান করে তোলায় এর শৈল্পিক ক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। ফলে যে নাট্যপ্রক্রিয়ায় সাধারন মানুষের স্মতস্ফুর্ত অংশগ্রহন করার কথা সেখানে ঘটে যায় উল্টো চিত্র। সাধারন মানুষ মনে করে ঋন বিতরনের মতোই এই নাটক।
তারা নাট্যপ্রক্রিয়াটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন কে অবিশ্বাস করতে থাকে। দর্শক আর নাট্যকর্মিদের মধ্যে আত্নিক যোগাযোগ ঘটেনা এবং থিয়েটার থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়। উন্নয়ন সংস্থাগুলোর এ আয়োজন শৈল্পিক দক্ষতার উপর গুরুত্বারোপ না করে প্রদর্শনীর কোটা পুরন আর দাতা সংস্থার কাছে জবাব দিহিতায় বেশী মনোযোগ দেয়া শুরু করে। ফলে থিয়েটার পক্রিয়াটি ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়।
সকল সৃজনশীলতাই মানব প্রজাতির উন্নয়নের জন্যই ঘটে থাকে।
থিয়েটার মানব উন্নয়নে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। থিয়েটার কে বলা হয় সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। কালে কালে এর প্রমাণও আমরা দেখতে পাই। থিয়েটার গনমানুষের আত্নিক উন্নয়নের স্বার্থে এর ব্যাপক চর্চা দাবী করে। কাহিনী, নাট্যনির্মাণ, অভিনয় কৌশল এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষন একজন বখে যাওয়া মানুষকেও গতি দিতে পারে।
পপুলার থিয়েটার তৃতীয় বিশ্বের সকলশ্রেণীর মানুষের মুক্তি চিন্তা সহায়ক আর লড়াইয়ের সম্মিলিত চিন্তার থিয়েটার । এটি জনগণের নিজস্ব থিয়েটার। এই থিয়েটার পরিবেশনায় জনগনের বিভিন্ন সমস্যা, ভাবনা, সমাধান পক্রিয়া ও প্রতিফলন ঘটে। পপুলার থিয়েটারের উদ্ভব তৃতীয় বিশ্বে। এই বিশ্বের কমবেশী প্রতিটি মানুষই নিযার্তীত।
তৃতীয়বিশ্বের দেশগুলি নিজেদের নিরপেক্ষ দাবী করলেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বৃহৎ শক্তির রাষ্ট্র দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত। বৃহৎ শক্তিগুলি সবসময় প্রত্যাশা এবং চেষ্টা করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে নিজেদের বলয়ের মধ্যে আটকে রাখার। তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলিতে বহুজাতিক পুঁজির বাধাহীন অনুপ্রবেশ ঘটায় সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। দরীদ্র জীবনের হার কমার থেকে বেড়েছে অনেক বেশী। ফলে এই দেশ গুলিতে সামাজিক সাংস্কৃতিক অবক্ষয় শুরু হয়েছে।
তাদের অত্যন্ত সুপ্রাচীন ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।
বিশ শতকের সাতের দশকে কানাডিয়ান অধ্যাপক জন রিড তৃতীয় বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সহায়ক থিয়েটারকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য তাঁর ‘ পপুলারথিয়েটার , কনসিয়েটাইজেশন আ্যান্ড পপুলার অর্গানাইজেশন” বইটিতে প্রথম পপুলার থিয়েটার শব্দটি ব্যবহার করেন। ১৯৭১সালের প্রথম ম্যানিলায় এবং ১৯৭৩ সালে ইরানের শিরাজে দ্বিতীয়বারের মতো তৃতীয় বিশ্বের থিয়েটার উৎসব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই দুটি সম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ‘ শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে তৃতীয়বিশ্বে থিয়েটার একটি সৃজনশীল শক্তি”। এই ঘোষনায় বলা হয় থিয়েটারকে অবশ্যই সামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের প্রধান অংশ হয়ে ওঠার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
নাগরিক ও গ্রামীণ উভয় সমাজের কাছে থিয়েটার কে জনপ্রীয় ও এর উন্নয়ন ধারনা পৌছে দিতে হবে।
আশির দশকে ‘ইন্টারন্যাশনাল পপুলার থিয়েটার অ্যালায়েন্স ” সহ স্থানীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে অনেক নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। এই সময় প্রথম গ্রামীণ জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য আর্থিক সাহায্যকারী দেশ সমুহ তথা এনজিওরা বিভিন্ন ওয়ার্কশপ আয়োজন শুরু করে।
পপুলার থিয়েটার আন্দোলনের প্রকৃতি এক হলেও এর বিন্যাস ভাবনা ও প্রয়োগ এক থাকেনি। কারন তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোর রয়েছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
পপুলার থিয়েটার এই ঐতিহ্য ধারন করে তা বৈশিষ্টমন্ডিত ও বিচিত্রময় হয়ে উঠেছে।
এই পক্রিয়ায় থিয়েটার ও উন্নয়ন ধারনায় অভিজ্ঞ নাটকের দলটি নির্দিষ্ট একটি অঞ্চল বেছে নেয় এবং সেখানকার মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে মিশে যায় । তাদের সমস্যা গুলো চিহ্ণিত করে। এই সমস্যা গুলোকে সবার অংশগ্রহনে থিয়েটারে রুপান্তরিত করে পরিবেশন করা হয়। এর পর সমস্যাগুলোর সমাধান ভাবনা ও সমস্যার নতুন দিক নিয়ে নতুন প্রযোজনা নির্মিত হয়।
নাটকটির কোন চুরান্ত রুপ থাকেনা। নাট্যদলটি সেখানে একটি নাটকের দলও তৈরী করে দেয়।
১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে পপুলার থিয়েটারের উপর একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে পপুলার থিয়েটারের নতুন সংজ্ঞা নিরুপন করা হয়। বলা হয় “ পপুলার থিয়েটার হল জনগনের নিজস্ব থিয়েটার, যে থিয়েটার জনগণরেই ভাবনা,সমস্যা, ও বিশ্লেষণকে প্রতিফলিত করে , যে থিয়েটারের বিষয়বস্তুতে জোর দেয়া হয় স্থানীয় বিশেষ বিশেষ সমস্যা, যে থিয়েটার ব্যপক ভাবে প্রচারিত অন্যান্য বৈদ্যুতিক মিডিয়ার পুঁজিবাদী প্রচার কে প্রতিরোধ করে যে থিয়েটারে জনগণের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ইতিহাসের চর্চা করে, তাদের অগ্রগতির পথ কে সুগম করে, যে থিয়েটার লোকশিক্ষা,দেশ ও জনগণের মধ্যে সংহতি আনে, যে থিয়েটারে আঞ্চলিক ভাষাও ব্যবহৃত হয় আবার বিনোদন হিসেবে জনগনকে আনন্দ প্রদান করে”"।
১৯৮৪ সালে আরণ্যক নাট্যদলের নেতৃত্বে “মুক্তনাটক” –এর যাত্রা শরু হয়। রাজনিতী সচেতনতা আর ভূমিহীন কৃষকদের সংগঠন মুক্ত নাটকের মূল ল্ক্ষ্য। ঢাকা থিয়েটারের নেতৃত্বে “গ্রাম থিয়েটার” দেশজ আঙ্গিকের পুনরুজ্জীবন কে লক্ষ্য করে যাত্রা শুরু করে। শুরুতে ব্যপক সাফল্য পেলেও বিভিন্ন কারনে এই দল দুটির অগ্রযাত্রা স্থিমিত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুটি কারনই গুরুত্বপূর্ণ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।