আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুপ্রিয় বাংলাদেশ : এ চিঠি লেখা হলো বৈশাখ-বরষায়, কিছু মেঘ কিছু রোদ্দুর, স্বপ্ন-ভরসায় (শততম পোস্ট)

অনেকের মাঝেও একা থাকা যায়, নি:সঙ্গতায় কারো অনুভব ছুঁয়ে যায় ...

সুপ্রিয় বাংলাদেশ, কেমন আছো তুমি ? তোমাকে নিয়ে কত আলোচনা করি; চায়ের কাপে ঝড় ওঠে; কারো কারো দেশের জন্য দরদ উথলে আসে তো কেউ বা কট্টরপন্থী রকমের সমালোচনাকারী; কেউ সহসাই হাততালি পায়- দেশ-প্রেমিক উপাধি বীরদর্পে গলায় ঝোলায় । কিন্তু কেউ পথ চলতে গিয়ে ধুলোয় ঢাকা সবুজ পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে জিগেষ করে কি কখনও, ”বাংলা আমার, কেমন আছো তুমি ?” বাংলা, তোমাকে তুমি করেই বলছি । যদিও তোমার জন্ম হতে দেখিনি আমি, তোমার শৈশবের কিছুটাও আমার আড়ালে, তবুও তোমার আমার বয়সের ব্যবধান খুব বেশী তো আর নয় । না হয় তুমি আমার থেকে কিছুটা বেশীই বিবর্ণ পৃথিবী দেখেছো, বদলে যাওয়া মানুষ দেখেছো, এক রক্তের সাগর, এক বুক আহাজারি কিনবা ক্ষমতার আস্ফালন, সামাজিক বিভেদ দেখেছো । প্রশ্ন করতে পারো, আমার পরিচয় কি ? আমি কোন পরিবেশবিদ নই, তবু ধূসর পৃথিবী আমার কপালে বলিরেখা ফেলে ।

শ্বাস-প্রশ্বাসে কেঁপে উঠি, কোন বিশুদ্ধ অক্সিজেনের অপচয় হলো নাতো ? বিষাক্ত আবহাওয়া বুঝি আমার কার্বন-ডাই-অক্সাইডে আরো ভারী হয়ে গেল । আমি কোন উচ্চাভিলাষী রাজনীতিবিদ নই যে তোমাকে ক্ষমতার সিঁড়িরূপে ব্যবহার করতে পারি । আমি অর্থনীতিবিদ নই যে বলে দিতে পারি, আগামী দশ বছরে তোমার অর্থনৈতিক অবকাঠামো সুসংহত হবে কিনবা আসছে বছরে তোমার উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি বেড়ে ’এতো’ হবে। আমি কোন ’দাতা’ নই যে, কথায় কথায় কাঁড়ি কাঁড়ি ডলারের ঋণে মোড়াবো তোমাকে । আমি সেই লোভী বণিকটিও নই যে সিন্ডিকেট করে, পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে তোমাকে নিয়ে বেসাতি করতে পারি।

আমি তো মুক্তিযোদ্ধাও নই ! অবশ্য তাতে আমার আর আফসোস হয় না । যখন দেখি, তোমার জন্ম পরিচয় নিয়ে আজো ছিনিমিনি খেলা চলে, পাঠ্যপুস্তকে তোমার ইতিহাসগুলো ফি বছর বদলে যায়- নাম বদলে যায়, ছবি বদলে যায়; কিন্তু কাউকে খুঁজে পাইনা এসব নিয়ে প্রতিবাদের জন্য । নাহ! বোধহয় মিথ্যে বলছি । আমরা এখনও যুদ্ধ করি- বাকযুদ্ধ; এখন পুরোদস্তর বাকযোদ্ধা আমরা, আমাদের রনাঙ্গন এখন চায়ের টেবিল । গোলা-বারুদ-অস্ত্র রসদের জায়গায় এখন পেয়ালা ভরা ধুমায়িত চা, সাথে মচমচে সমুচা।

প্রতি ঘন্টার তুমুল বাকযুদ্ধ শেষে এখন জন্ম নেয় একটি বিলের কাগজ । আমি মুক্তিযোদ্ধা হলে আজ হয়ত লজ্জিতই হতাম পরিচয় দিতে। আমি কোন এক বীরঙ্গনাও নই । অথচ আজও প্রতিদিন সম্ভ্রম হারাই কোন হায়েনার গোপন লালসা মেটাতে; তরল এসিডে আজ অহরহ আমার মুখে ভেসে ওঠে তোমার মানচিত্রের বিকৃত রূপ। আজ প্রতিদিন আগুনে ঝলসে উঠি যৌতুকের চাহিদা মেটাতে; আজ সৃষ্টিকর্তার আদেশে নয়, মৌলবাদীদের সৃষ্ট ফতোয়ার ভয়ে নিজেকে আবৃত করি শুধু।

এইসব আস্তাকুড়ের কুকুরগুলো কোন পাকবাহিনীর নয়, তোমারই সোনার ছেলেরা! আমি রাজাকার হলে আজ হয়ত আমার হাতের মুঠোয় তোমাকে রাখতে পারতাম । তোমার পতাকা শোভিত করে আজ বীরদর্পে সরকারী গাড়ি হাঁকাতাম । তোমার শস্যক্ষেত্র থাকতো আমারই তত্বাবধানে। আমি চাইলেই প্রতি জুম্মার পর টুপিওয়ালা মুসুল্লীদের ”নারায়ে তাকবীর” ধ্বনিতে কেঁপে উঠতো বায়তুল মোকারম প্রাঙ্গণ। আমি ভাল কোন লেখক হতে চাই না ।

হতে চাই না ভাল পাঠক । কারণ আমি জানি ওখানে কথার ফুলঝুড়ি থাকে। এখন সস্তার অন্তর্জালে মানুষের লেখার তুবড়ি ছোটে বড্ড বেশী । কত উপদেশ, আশা, আশ্বাস - ”সাথে আছি”, ”পাশে আছি”, ”আমরা আশাবাদী”। মনে হয় আমরা বুঝি একই সত্তা, একই চাওয়া-পাওয়া, বুঝ-জ্ঞান , অথচ মিনিট দশেক যেতে না যেতেই বিভেদের ডামাডোল বাজে।

একটা লজ্জিত সত্য- কেন জানি ’আমরা’ হতে পারি আর, এখন ’আমি’, ’তুমি’ আর ’আপনি’ । আমি দেশপ্রেমিকও হতে চাই না, নিজেকে সুবিধাবাদী মনে হয় । ছোটবেলায় এক স্কুল শিক্ষক বলেছিলেন বোধহয়, ”কাক যখন ময়লা খায় তখন চোখ বন্ধ করে খায় , কারণ কি খায় তা দেখতে চায়না আর কাক ভাবে চোখ বন্ধ করলে সে যে ময়লা খাচ্ছে তা আর কেউ দেখবে না ! ” দেশপ্রেমিকতা দেখানোর খেলায় নিজেকে সেই ’কাক’ এ পরিণত হতে দিতে চাই না আমি একদমই। বাংলা, তুমি বোধহয় ভাবছো, আমি তাহলে কি আসলে , কিনবা কি হতে চাই ? শুনতে যতই খারাপ লাগুক, তুমি যতো কষ্টই পাওয়া না কেন, তবু বলি, আমি তোমরই তীব্র সমালোচনাকারী হতে চাই! অনেক দু’মুখো পরিচয়ের ভিড়ে এই একটি পরিচয়েই আমি অন্তত্য নিজের সততা খুঁজে পাই, আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। ”ভাল-মন্দ যেমনই হোক তবুতো আমার দেশ”, অনেক আবেগী কথা, কিন্তু কেমন জানি দায়সারা গোছের মনোভাব মনে হয় আমার কাছে ।

শুকনো কথায় চিড়ে ভেজানোর প্রয়াস। আমি খুব দেশপ্রেমিক- নিজের ঢোলটা আরেকবার জোরসে পিটিয়ে নেয়া । কারো কারো দেশপ্রেম এতো গভীর হয় যে, তোমাকে নিয়ে কোন নেতিবাচক কথা বলতেই তারা নারাজ! অথচ এদের মুখেই কখনো ”থার্ড ওয়ার্ল্ড” আর ”ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড” এর শব্দগত ব্যবহারে তোমার অবস্থানটুকু নিদারুণ ভাবে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে! দেশে বাস করলেই ’দেশপ্রেমিক’ আর বিদেশে বাস করলেই ’সুবিধাবাদী’ এমন একটা মনোভাব আজকাল অনেকের মাঝে দেখি । যারা দেশে আছেন তারাই কেবল দেশের ভাল-মন্দ নিয়ে কথা বলবে আর প্রবাসীদের দেশীয় কোন কিছু নিয়েই যেন উচ্চবাচ্য করার অধিকার নেই! ’আমি দেশে থাকি, তাই দেশপ্রেমিক’ এ এক অদ্ভূত নিম্নরুচির খেলা মনে হয় আমার কাছে । জানো, আমার স্বল্প সময়ের প্রবাস জীবনে দেখেছি, বিদেশের মাটিতে কিভাবে নিজের দেশীয় পরিচয়কে তুলে ধরতে হয় বারবার।

চেনাতে হয় বাংলাদেশকে- মানে তোমার অবস্থান, প্রকৃতি, মানুষ, সংস্কৃতিকে । এতো পরিচয়ের ভিড়ে কোন বিদেশী যখন প্রশ্ন করে বসে , “তোমাদের দেশে কি এখনও বন্যা হয়, মানুষ পানিতে ভেসে যায় ?” তখন জানিনা একজন দেশপ্রেমিক কি উত্তর দিত,তবে আমার উত্তর ছিল, ”বন্যা আমাদের খানিকটা অমোঘ প্রাকৃতিক ক্রটি, বাদবাকী সরকারী অনিয়ম আর দূর্নীতি” । আজকাল মেধাপাচার নিয়ে সবাই খুবই উদ্বিগ্ন । ছেলে-মেয়েরা বিদেশ যাওয়া শুরু করলেই তাদের মেধার মূল্যটা আমরা বুঝতে পারি! তারমানে এখন যারা দেশে পড়াশুনা করছেন তারা সবাই অন্ত:সারশূণ্য! দেখো, তোমার দেশীয় দেশপ্রেমিকেরা কেমন করে নিজেদের দ্বৈততার প্রমাণ দিচ্ছে । বাংলা, তোমার আসল পরিচয় নাকি খুঁজে পাওয়া যাবে শুধু গ্রামগঞ্জে গেলেই ।

আজ জিগেষ করে দেখোতো, ক’জন ”দেশীয় দেশপ্রেমিক” গ্রামে যাবে শহুরে বিলাসিতা ছেড়ে, মালটিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানে মোটা বেতনের চাকরী ছেড়ে তোমার সেবায় ক’জন খেটে মরবে, খুঁজে দেখোতো ? বছরের পর বছর দাতাগোষ্ঠির কাছে হাত পাতব ঠিকই , আবার উন্নয়নের স্বপ্ন দেখব -এমন নিলর্জ্জতা আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে । আবার সেই লজ্জা আড়াল করতে অনেক কলামে উঠে আসে দাতাদের চাতুরীপনার কথা, কিছু নীতিবাদীদের দেশপ্রেমী কথা - এসব আমাকে হাসায়। বাবা-মা সন্তানদের বড় করেন ঠিকই, কিন্তু বাবা-মা না থাকলেও তো তারা প্রাকৃতিকগতভাবে বড় হবেই । তাই যারা খুব গর্ব করে বলেন, ”আমরা আশাবাদী, একদিন ...”, আমার করূণা হয় এসব দায়সারা কথার ফানুস ওড়ানো ’দেশপ্রেমিক’ - দের জন্য । আমি হলফ করে বলতে পারি আজ থেকে একশত বছর পরে তোমার অর্থনীতি, সামাজিক কাঠামো, জীবন-যাত্রায় ব্যপক উন্নতির ছোঁয়া লাগবেই ।

এটা শুধু সময়েরই খেলা, কিন্তু ভেবে দেখোতো, অন্যদেশগুলোর অবস্থান তখন কোথায় থাকতে পারে ! প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত জাপান এখন কেমন চকচক করে, কত তর তর করে ওরা নিজেদের গুছিয়ে নিল, অথচ বাংলা, তোমার তো কোন কিছুর অভাব ছিল না ! তোমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ প্রবাহিত, আমি চাই তুমি তা জানো সময় থাকতেই । তোমাকে নিয়ে এক অদ্ভূত খেলা চলে- সরকার-জনগণের মাঝে,এমনকি মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকারের মাঝেও । তোমাকে এসব জানতে হবে। তুমি সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা, এই বলে তোমাকে ভুলিয়ে রাখা হয়, অথচ তোমার সুন্দরবন উজাড় হয়ে যায়, কেউ তার খোঁজ করে না ! কেউ বলে না আর, ”ফিরিয়ে দাও অরণ্য, লও হে নগর” ! ক'জন দেশপ্রেমিক বৃক্ষমেলায় গিয়ে গাছ কেনে ! বাড়ির বারান্দায়, ছাদে বাগান করে ! ”তবুও তো নিজের সন্তান..”, এই বলে নিজের বখে যাওয়া ছেলের মাথায় হাত বুলাতে আমি রাজি নই । আমি কাকের মত চোখ বন্ধ করে ভেজাল খাবার, ভেজাল ঔষধ, ভেজাল বায়ু গ্রহণ করে নিজের দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে লালায়িত নই।

শুধু দেশে থাকি বলে নিজের তথাকথিত দেশপ্রেমের বিজ্ঞাপন দিতে আমার নিজেকে ভন্ড মনে হয় । কোন দেশের কোন মন্ত্রির চারিত্রিক দোষক্রটির চেয়ে আমাকে তাদের পালিত উন্নয়নের নীতিগুলো আকর্ষণ করে বেশী । আর সত্যি কথা বলতে কি, আমাদেরই নেতাদের চারিত্রিক দোষক্রটি নিয়ে অনেক গুঞ্জন, সত্য বচন- এসব বলতে গেলে হয়ত আরব্য রজনীর এক হাজার এক রাতও কম পরে যেতে পারে! বাংলা, তোমাকে নিয়ে, নিজেকে নিয়ে আমার আকাংখাগুলো অনেক বেশী বেশী । তোমাকে নিয়ে যা ভাল, তা ভাল বলতে সংকোচ নেই এক ফোঁটা, কিন্তু যা খারাপ তা বলতে পিছপা হবো কেন ! ”নিন্দুকেরে বাসি আমি সবচেয়ে ভাল”- কোন এক জ্ঞানী মণীষির কথা ছিল । তোমার সমালোচনা তোমার পেছনে নয়, তাই সামনেই করি আজ, না হলে কি করে বুঝবে কোথাকার ক্ষতে কতটুকু পচন ধরেছে ।

সময় তো অনেক চলে গেল, ৩৮ ছুঁই ছুঁই বয়সে চেহারায় মলিনতা নয়, থাকা উচিত ছিল ভিন্ন লাবন্যতা । এই লাবণ্যতা ফিরিয়ে আনতে আমার অনেক কিছু চাই- কচি সবুজ পাতা, সবুজ মাঠ, সুস্থ জীবন, মুক্ত চিন্তা, একটা নিশ্চিন্ত সকাল সহ আরো অনেক কিছু । কারণ আমি ভাল থাকতে চাই, সুস্থ থাকতে চাই, আমার অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা সুন্দর পরিবেশের নিশ্চয়তায় আমি এতটুকু ছাড় দিতে রাজি নই । নিজেকে নিয়ে, তোমাকে নিয়ে এই বিচলিত ভাবনাই আমাকে দেশপ্রেমিক হতে দেয়নি কখনো, বরং কট্টর সমালোচনাকারী হতেই স্বস্তিবোধ হয় । মনে হয়, অন্তত্য তোমাকে মিথ্যে আশ্বাসে ঘুম পাড়িয়ে কোন বিশ্বাসঘাতকদের প্রশ্রয় দিচ্ছিনা ।

বিশ্বাস করো বাংলা, এই সমালোচনা তোমাকে মোটেও ছোট করে না বরং সজাগ করে। ছোটবেলা থেকে শুনে আসা "বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ", এই ছেলেভুলানো মন্ত্রপাঠ একঘেয়ে লাগে এখন । আর তাই নিজেকে সাজাতে, তোমাকে সাজাতে যে উপঢৌকনগুলো দরকার তার দাবীতে আমি অনঢ় থাকতে চাই বরাবরই। কোন রকম খেদ ছাড়াই আমি প্রচন্ড রকমের স্বার্থপর হতে চাই, কারণ, ”...আমার এতো অল্প-স্বল্পে কিছু হয় না ” ... । হয়ত আবার কখনো লিখব।

ভাল থেকো সবসময় । ইতি, তোমার কোন তথাকথিত দেশপ্রেমিক নয়, একজন একনিষ্ঠ সমালোচনাকারী ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.