সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার
সকাল বেলা আরামকেদারায় হেলান দিয়ে খুব তৃপ্তির সাথে গড়গড়ি হুক্কা টানছিলেন জনাব মাশরাফ রাহমান। পাশে খবরের কাগজ পড়ে শোনাচ্ছিলেন তারই সচিব। এই সময়টা তার জন্যে খুব সুন্দর সময়। দেশবিদেশের খবরাদি পাওয়া যায়। নিজে প্রাইমারী শিক্ষা না নিয়েও এমনি পরিস্থিতিকে নিজেকে টেনে আনতে পেরে খুব পরিতৃপ্ত জনাব মাশরাফ রাহমান।
কি দরকার পড়শোনার? ঝোপমতো কোপ দিতে পারলে কতো বিদ্যাধর এসে পায়ের সামনে উবু হয়ে পড়বে! এই সে সচিব, ব্যটা এমএ পাশ করেছে পুরস্কার পেয়ে, আর এখন এই নিরক্ষরের তোষামোদী করে সংসার চালাচ্ছে।
তারপরও মনটা একটা ভারী হয়ে আছে। সকাল বেলা মেয়েটা স্কুলে যাবার আগে মন খারাপ করে ছিল। তার এই রমরমা অবস্থা হওয়ার আগে যেতো গ্রামের স্কুলে। এখন শহরের সবচেয়ে দামী স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন।
প্রতিটি বিষয়ের জন্যে একজন করে মাষ্টার রেখেছেন। তারপরও নাকি স্কুলে যেতে চায়না। মায়ের কাছে নাকি কান্নাকাটিও করেছে। তার বড় সখ মেয়েকে আমেরিকা পড়তে পাঠাবেন। তার জন্যে তো অবশ্যই ভাল স্কুলে পড়া দরকার।
- আজকে পরথম পাতায় আপনের খবর ছাপাইছে স্যার!
- কি লিখেছে?
- হিন্দুগো মন্দির ভাইঙ্গা যে মসজিদ বানাইছেন, তার খবর ফলাও কইরা ছাপাইছে।
- হ, এহন ত ছাপাইবই, সরকার আমাগো, ছাপাইব না?
- পইড়া শোনাইমু স্যার?
- হ, শোনাও।
সচিব পড়লেন, আর পরিতৃপ্তির সাথে শুনে গেলেন মাশরাফ রাহমান। পুরো হিন্দু এলাকাটাই খালি করা হয়েছে। ধর্মপ্রসার তো আল্লারই আদেশ।
সেজন্যে যদি কঠোর হলে আল্লহই খুশী হবেন। এর মাঝে নিজের সম্পদ সম্পত্তি বাড়ানো, চামচাদের খুশী করা তো উপরি পাওয়া। এর মাঝে কিছু বিধর্মী যদি মারাও যায়, তাতে কি? মৃত্যু তো জিহাদেরই একটা অংশ। তাছাড়া আরব দেশগুলো থেকে টাকাপয়সা আসে। তাতে নিজের সম্পদের পাশাপাশি দেশের সম্পদও বাড়ে।
- স্যার, এইখানে আরেকটা খবর ছাপাইছে।
- কি খবর?
- কাদিয়ানী গো খবর স্যার।
- কি লিখছে?
- হেরা দেশ ছাইড়া পাকিস্তান, ইন্ডিয়ায় পলাইতাছে।
খবরটি শুনতে শুনতে জনাব মাশরাফ রাহমান খুবই খুশী হলেন। কাদিয়ানীদের অমুলিম ঘোষনার চালটি চেলে খুব ভাল একটা কাজ করেছেন।
এতো দিন হয়ে গেলে এদেশের, এখন পর্যন্ত রাজাকারদের পক্ষ নিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী কথা বললে ধার্মিক মুসলমানরাও শুনতে চায়না। ক্ষেপে ওঠে যখন তখন। কাদিয়ানী আর হিন্দু ইস্যু দিয়ে এখন ওদেরকে দলে টানা গেছে কিছুটা। আস্তে আস্তে, খুব সাবধানে এগুতে হবে, ঝোপ বুঝে কোপ না মারলে আজকালকার দুনিয়ায় যে চলে না, তা জনাব মাশরাফ রাহমান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা বেশ ভালোই টের পেয়েছেন।
- স্যার, এইহানে বিদেশের একটা ইন্টারেষ্টিং খবর দিছে।
- কাগো খবর?
- ইহুদী আর জার্মানগো খবর।
- হেগো খবর আবার কি লিখছে।
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদী মারণের খবর নাকি মিছা কতা। যেই হালায় লিখেছ, হের আবার নাৎসীগো লগে দহরমমহরম।
- খবরটা ভালা কইরা পড়, কামে দিব।
- মিছা খবর পইড়া কি অইব স্যার।
- খবরটা মিছা, হেইডা ক্যামনে জানলা।
- আমি ইতিহাসে এমএ পাশ করছি স্যার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লইয়া রিসার্চ করছিলাম।
- চুপ কর হারামজাদা।
- স্যার!
- বউ, বাচ্চা লইয়া রাস্তাত নামবার চাও?
- না স্যার।
- তাইলে যা পড়াশোনা করছ, সব ভুইল্লা যাও। আমি যা কই সেইটা শোন।
- ঠিক আছে স্যার।
- কাগজ কলম লইয়া, খবরটা ভাল কইরা পইরা নাৎসী পক্ষে একটা রিপোর্ট লেখ।
হের লগে আরো কিছু বানাইয়া লেইখা দিবা।
- ঠিক আছে স্যার।
- ভাল কইরা লিখ্যা সামহোয়ারইনব্লগে আমার নামে দিয়া দিও। আমার কিছু চ্যালা চামুন্ডা আছে, হ্যরা খুশী অইব।
বলেই আরামকেদারা ছেড়ে উঠে পড়লেন জনাব মাশরাফ রাহমান।
ঠিক সেই মহুর্তে তার মেয়ে ফিরলো স্কুল থেকে। চোখে জল। মেয়ের চোখে জল দেখে হাহাকার করে উঠলো জনাব মাশরাফ রাহমানের বুকটা। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বললেন,
- কি অইছে আম্মা, কানতাছ কেন?
- আমি আর এই স্কুলে যামুনা আব্বা। বলে হাউহাউ করে আরো জোরে কেঁদে উঠলো মেয়ে।
- আমি তোমারে অন্য স্কুলে দিমু আম্মা। এখন কও, কোন হারামজাদা কি কইছে। টেঙরি ভাইঙ্গা ফালাইমু।
- কেউ কিছু কয় নাই আব্বা।
- তাইলে কি অইছে?
- সব ছাত্রছাত্রীরে নিজেগো বাপেরে নিয়া রচনা লেখতে কইছিল, আমিও আপনেরে লইয়া লেখছি।
- তো?
- সব সত্য কতা লিখছি আব্বা। আপনে যে পড়াশোনা করেন নাই, হিন্দুগো, কাদিয়ানীগো বাড়ীঘর দখল করছেন, হেইডাও লিখছি।
- না লিখলে অইতো না?
- আমারে সত্য কথা লিখতে কইছে আব্বা।
বলেই আরো জোরে কান্না শুরু করলো মেয়ে। মেয়েকে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে মন খারাপ করে আবার আরাম কেদারায় এলিয়ে পড়লেন জনাব মাশরাফ রাহমান।
পিঠের নীচে আরাম কেদারা নরম গদি আর আগের মতো কোমল মনে হলোনা। এত বদ পৃথিবীর মানুষগুলো! শিক্ষা আর অশিক্ষার মাঝে যে বৈষম্য আর অবিচার, তা উপলব্ধি করে তার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। সে জল আলবেলার কলকিতে পড়ে আগুন নিভে যাওয়ায় হারামজাদা বলে আবার গালি দিলেন সচিবকে।
সুপ্রিয় ব্লগারবৃন্ধ। আসুন আমরা জনাব মাশরাফ রাহমানের অন্তরের ব্যথায় নিজেরাও ব্যাথিত হই!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।