ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও একটি শায়েস্তা খাঁ তত্ত্ব
ফকির ইলিয়াস
==========================================
স্খানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে বেশ আশাবাদী বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার। যারা মনোনয়ন দাখিল করেছেন তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। কেউ কেউ স্বতন্ত্রভাবে মনোনয়ন দাখিল করলেও তাদেরও নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচিতি রয়েছে। একটি রাষ্ট্রে স্খানীয় সরকার কাঠামোটি, একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফেডারেশন সরকারের অধীনে, অঙ্গরাজ্যের স্খানীয় সরকারের কার্যক্রম সেভাবেই পরিচালিত হয়।
পরিপূরক হিসেবে স্খানীয় সরকারই সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক ভমিকা রাখে।
বাংলাদেশে সিটি করপোরেশন কিংবা পৌরসভার নামে কোন কোন অঞ্চলের মানুষকে যে ‘নাগরিক সুবিধা’ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয় তার প্রকৃত চিত্র কেমন তা বাংলাদেশবাসীর অজানা নয়। যদিও ‘নাগরিক’ এবং ‘গ্রামীণ’ এই শব্দ দুটির প্রয়োগ সম্পর্কে আমার ভিন্ন মত রয়েছে। রয়েছে নিজেস্ব ব্যাখ্যাও। একটি রাষ্ট্রের অধিবাসী মাত্রই, জন্মসূত্রে কিংবা মাইগ্রেশনসূত্রে সে দেশের নাগরিক।
পর্যটন কিংবা চাকরিসূত্রে অবস্খানরতরা এর আওতায় পড়েন না। তা হলে এখানে ‘নাগরিক’ এবং ‘গ্রামীণ’ শব্দ দুটি আসবে কেন? কেন করা হবে শ্রেণী বিভাজন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা ‘রুরাল’ এবং ‘আরবান’ দুটি শ্রেণী দেখলেও নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তিতে কোন বৈষম্য নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ছোট ছোট অঙ্গরাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেলে দেখা যায় ওসব অঞ্চলে যাতায়াত, খাদ্য, চিকিৎসা সুবিধা বরং শহরগুলোর চেয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে অধিক ভাল।
বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা এর বিপরীত চিত্রই শুধু নয় বরং কোন কোন সিটিতে দুর্বিষহ অবস্খা দেখতে পাই।
একটি বাংলা টিভি চ্যানেলে বরিশাল সিটি করপোরেশনে ওপর একটি সচিত্র প্রতিবেদন দেখলাম। এখনও টিউবওয়েল দিয়ে পানি সাপ্লাই দেয়া হয় বরিশাল মহানগরে। পাঁচ বছরে সেখানে ন্যনতম উন্নয়নের ছোঁয়া পর্যন্ত লাগেনি। অথচ সেই সিটির মেয়র ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে এখন অন্তরীণ য়েছেন।
অন্য বড় সিটিগুলোর অবস্খাও একই।
ঢাকা, চট্টগ্রাম সিলেটের মতো নগরে দেখেছি একদিন মুষলধারে বৃষ্টি হলেই নর্দমার ময়লা রাজপথে উঠে আসে। হাঁটুপানি জমে যায় যত্রতত্র। এই যদি হয় নাগরিক সুবিধার নমুনা তা হলে গ্রামীণ জনপদের মানুষ কেমন আছেন কিংবা কেমন থাকতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়। এই যে চরম দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতার বাহাদুরি, তার প্রধান কারণটি হচ্ছে স্খানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা কোন না কোন ভাবে রাজনৈতিক দলগুলো দ্বারা প্রভাবিত।
বিশ্বের সভ্য গণতান্ত্রিক সবদেশেই মেয়র, কাউন্সিলর স্টেট সিনেটররা দলীয় বলয়ে থেকেই নির্বাচিত হন।
কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে তারা দলীয় স্বার্থের কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেন না। দলও তাদের ওপর প্রভাব খাটায় না।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই আমরা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করার কথাটি শুনে আসছি। কিন্তু সে ব্যবস্খা বাস্তবতার পরশ পায়নি কোন সরকারের আমলেই। বর্তমান সরকার সিটি, পৌরসভা, উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচনের উদ্যোগী হয়েছেন।
আমি মনে করি উপজেলা চেয়ারম্যান, সিটি মেয়র, পৌর চেয়ারম্যানসহ ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, কমিশনারদের সেবা দানের ক্ষমতা বাড়ানো উচিত সরকারের। প্রয়োজন হলে জেলা পরিষদকে আরও বেশি ক্ষমতা প্রদান করে ‘জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান’ পদটি ও নির্বাচনের মাধ্যমে কার্যকর করা যেতে পারে। এতে জাতীয় সংসদ সদস্যদের একক কর্তৃত্ব ও দাপট কিছুটা হলেও কমে আসবে।
বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক সভ্য দেশেই সাংসদ, সিনেটর, কংগ্রেসম্যানরা রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন বিষয়ক জরুরি রাষ্ট্রকার্যগুলো সম্পন্ন করেন। এলাকার উন্নয়নে কাজ করেন মেয়র, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর, মেম্বাররা।
আবার দুটি পক্ষই রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন তাদের কর্মের জন্য। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সব স্খানীয় সরকার নির্বাচন সম্পন্ন করে রাষ্ট্র ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কাজটি বর্তমান সরকার সহজতর করবেন বলেই আমি আশাবাদী।
দুই.
স্খানীয় সরকার নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক সাড়া পড়েছে দেশের সব অঞ্চলে। আওয়ামী লীগ জোরেশোরে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপির কিছু প্রার্থীও বিচ্ছিন্নভাবে মনোনয়ন পত্র দাখিল করেছেন।
জামায়াত বলেছে তারা কোন প্রার্থী দেবে না। জামায়াত মলত বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের আজ্ঞাবহ হিসেবেই এসময়ে দিন পার করে দেবে বলে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে। যদিও ভেতরে ভেতরে তারা অন্য কোন মিত্র পেলেও গাঁটছাড়া বাঁধতে দেরি করবে না।
এদিকে ‘সেক্টর কমান্ডারর্স ফোরাম’ ঘোষণা দিয়েছে, রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, আলবদর যে কোন প্রার্থীকে স্খানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিহত করা হবে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের তিরোধানের পর এই ফোরামই ঘাতক দালালদের রুখতে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করছে দেশে বিদেশে।
স্খানীয় সরকার নির্বাচনের প্রতিটিতে জনগণ এসব হায়েনা চক্রকে রুখে দেবেন বলে আমার বিশ্বাস।
এদিকে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ১৪ জুলাই ’০৮ এর পর কোন প্রার্থী দলীয় পরিচয় দিতে পারবেন না। দলীয় পরিচয় দিয়ে প্রচারণা করলে তার প্রার্থিতা নির্বাচনী আচরণ বিধি মোতাবেক বাতিল হয়ে যাবে। বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রে প্রার্থী এবং ভোটারকে দলীয় প্রভাব ও নিয়মমুক্ত করা খুবই কঠিন কাজ। কারণ এখানে দলীয় একটি ইজম এতো শক্তভাবে প্রতিষ্টিত হয়েছে যে এর টুঁটি চেপে ধরলে পুরো নির্বাচনী আমেজই হয়তো বিনষ্ট হয়ে যাবে।
অতীতেও বিভিন্ন ভোটার বিহীন নির্বাচন বেশিদিন স্খায়িত্ব পায়নি। গ্রহণযোগ্যতাও পায়নি দেশে-বিদেশে।
অবশ্য এজন্য ভোটারদের সচেতন করে তোলার বিষয়টিও অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। যে দেশে দু’বেলা অন্ন সংস্খান কিংবা দুটি মোটা কাপড়ের জন্য ভোট বিক্রি হয়ে যেতে পারে সে দেশে সচেতন ভোট প্রয়োগ কীভাবে সম্ভব হতে পারে? দারিদ্র্যবিমোচন মানুষকে অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলা এবং স্বাবলম্বী প্রকল্পের শক্তিশালী হাত নির্মাণের মাধ্যমেই এই কাজটির শুভসূচনা ঘটানো সম্ভব হতে পারে। কিন্তু খুবই দু:খজনক হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের কোন সরকারই আন্তরিকভাবে চায়নি।
এদেশের মানুষ সুশিক্ষিত, অধিকার সচেতন হয়ে গড়ে উঠুক।
তিন.
রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন পক্ষের অসংলগ্ন বক্তব্য দেশের জনগণকে শুধু হতাশই করে না, কখনও কখনও চরম ভোগান্তির দিকে ঠেলে দেয়। সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের একটি বক্তব্য দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেছেন, এই যুগে কেউ যদি শায়েস্তা খাঁর আমলের দ্রব্যমল্য আশা করে তা হলে তা কি মানা যাবে? ২০০৮ সালে কেউ শায়েস্তা খাঁর আমলের দ্রব্যমল্য আশা করেন তেমন কোন কথা দেশের কোন ভোগ্যপণ্য ক্রেতাই বলেননি। এটা আমরা জানি, প্রযুক্তি, যোগাযোগ, চিকিৎসা, বাসস্খান এবং সামাজিক ক্ষেত্রে এখন অনেক সুবিধা আছে যা শায়েস্তা খাঁর সময় ছিল না।
জিনিসপত্রের দাম বাড়বে ক্রমানুপাতিক হারে। সইকিছুর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। বাজারে কেউ মগের মুল্লুক প্রতিষ্ঠা করুক তা কোন নাগরিকই মেনে নিতে পারেন না। অথচ আমরা দেখলাম জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মনগড়া হারে ভাড়া আদায়ের হিড়িক পড়ে যায়। চাল, তেল এবং ডালের দাম বাড়তে থাকে লাগামহীনভাবে।
যারা কাঁচামাল বাজারে আনতে যানবাহনের সাহায্য নেয় না তারাও বাড়িয়ে দেয় শাকসবজির দাম। বাজারগুলোতে মনিটরিংয়ের ব্যবস্খা না থাকার কারণে এক ধরনের পেশাশক্তি কায়েম হয়ে যায় রাতারাতি। পরে জিনিসপত্র পর্যাপ্ত হওয়ার পরও দাম আর কমে না।
বর্তমান অর্থ উপদেষ্টার এই ‘শায়েস্তা খাঁর তত্ত্ব’ বিতরণের পর এক ধরনের অশুভ ব্যবসায়ী প্রশ্রয়ই পাবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্খার তীর্যক ব্যবস্খাদি না থাকলে বাংলাদেশে নতুন নতুন চক্র লাই পেয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠে তা বারবার আমরা দেখেছি।
এবার স্বয়ং অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্যের পর এর সঙ্গে নতুন উপসর্গ যোগ করবে ব্যববসায়ীরা। মুনাফাখোররা হামলে পড়বে জনগণের ওপর।
আমরা একটি বিষয় স্পষ্ট লক্ষ্য করছি, তা হচ্ছে সরকার যে কোনভাবে জনগণের কাছে আসার চেষ্টা করছে। আর এজন্য তারা কখনও রাজনৈতিক রোষানলের কিছুটা পক্ষে, কখনও বাজার বাণিজ্যের কিছুটা পক্ষে অবস্খান নিয়ে সময় পার করতে চাইছে।
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার মি. সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত যারা আপিল করবে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে।
এটা বলার মাধ্যমে প্রকারান্তরে প্রত্যেক দুর্নীতিগ্রস্খ ভিআইপিকে আপিল করতে আগ্রহী করে তোলা হবে বলে আমি মনে করি। আপিল গ্রাহ্য হোক আর না হোক পিটিশন দাখিল করেই তারা মনোনয়ন দাখিল করবে কিংবা করাবে। সিটি নির্বাচনে অন্তরীণ ব্যক্তির পক্ষে মনোনয়ন দাখিল করতেও তো দেখছি আমরা। আপিল নিষ্পত্তিতে যদি পাঁচ বছর লেগে যায় তবে ওই পাঁচ বছর কি ক্ষমতায় থাকবে কেউ?
প্রচলিত আইনের মারপ্যাঁচ সবার জন্যই সমান। এই সত্যকে অনুধাবন করে সরকারকে নীতিনির্ধারণ করতে হবে।
মানবাধিকার বিষয়টির পাশাপাশি সুশাসন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে প্রাধান্য দিতে হবে সর্বত্তোভাবে। নবনিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশন স্টিফেন ইভান্স তার প্রথম প্রেস কনফারেন্সে সে কথাটি আবারও সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। জরুরি অবস্খার মধ্যে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না সে কথা বলেছেন ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদত মি. জেমস মরিয়াটিও। শেখ হাসিনা, আরাফাত রহমান কোকোর পর এবার তারেক রহমানকেও একটি মামলায় সশরীরে আদালতে হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন মাননীয় আদালত। এই ধারাবাহিকতা কি ভবিষ্যৎ বহন করছে তা স্পষ্ট নয়।
নিউইয়র্ক, ৮ জুলাই, ২০০৮
----------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ১১ জুলাই ২০০৮ শুক্রবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।