সময়ের আলোচিত কবি শহীদ কাদরী। তাঁর কবিতা ক্রমশ:ই নন্দিত হচ্ছেপ্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। তাঁকে নিয়ে, তাঁর কবিতা নিয়ে লিখেছেন নব্বই দশকের একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি , শালুক লিটল ম্যাগ সম্পাদক ওবায়েদ আকাশ । কবিতাপ্রেমী দের উদ্দেশে আমার ব্লগে লেখাটি তুলে রাখলাম।
----------------------------------------------------------------------------------
শহীদ কাদরী ও আমাদের সময়
ওবায়েদ আকাশ
==========================================
‘বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা/মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,/কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা/ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ/প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই/কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না.../একাকী পথিক ফিরে যাবে তার ঘরে/শূন্য হাঁড়ির গহ্বরে অবিরত/শাদাভাত ঠিকই উঠবেই ফুটে তারাপুঞ্জের মতো,/পুরনো গানের বিস্মৃত-কথা ফিরবে তোমার স্বরে/...কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...’ এই হচ্ছে কবি শহীদ কাদরীর দৃষ্টিতে আধুনিকতার মূল অভীষ্ট অন্বেষা এবং এভাবেই শহীদ কাদরী তার সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ কোথাও কোনো ক্রন্দন নেইতেও এক স্বতন্ত্র চিন্তার আধুনিক কবি হয়ে বাংলা কবিতাকে মহিমান্বিত করেন।
সকল প্রাপ্তির ভেতরেও যে একজন আধুনিক মানুষ অতৃপ্তই থেকে যায়, এই যে আধুনিক ও নাগরিক মানব মনের অপূর্ণতা-জটিলতা, সব প্রাপ্তির পরেও যে নাগরিক মন শেষ পর্যন্ত তার শান্তির শ্বেত কপোতটি ওড়াতে বারবার ব্যর্থ হয়ে যায় এ কাব্যগ্রন্থের ‘সঙ্গতি’ কবিতায় কবি তাকে এভাবে সফল ভাষা দেন।
১৯৭৮ সালে স্বেচ্ছানির্বাসিত কবি শহীদ কাদরী বর্তমানে বসবাস করছেন আমেরিকার বোস্টন সিটির কাছাকাছি লীন নামের একটি শহরে। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে তিনি ছেড়ে যান তার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। পরবর্তীতে এক আমেরিকানকে বিয়ে করে ওখানেই থেকে যাওয়ায় আমরা আজকের প্রজন্ম প্রায় কেউই শহীদ কাদরীকে দেখিনি। সে সৌভাগ্য হয়নি আমাদের।
তবে আমরা জেনেছি, পঞ্চাশের তিন আলোচিত কবির একজন ছিলেন শহীদ কাদরী। কিন্তু শহীদ কাদরী যে পঞ্চাশের কবি নন, তা ধীরে ধীরে আমাদের কাছে স্পষ্ট হতে থাকে। শহীদ কাদরী গত শতকের ষাটের দশকের প্রথম পর্বের একজন শক্তিমান কবি হলেও তাকে সাধারণ হিসেবে ষাটের তালিকায়ও রাখা হয় না। শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদের সঙ্গে অতিঘনিষ্ঠতার কারণে তাকে হিশেব করা হয় পঞ্চাশের কবি হিসেবে। মূলত শামসুর রাহমানের সঙ্গে শহীদ কাদরীর সম্পর্ক ছিল বড়ভাই আর ছোটভাইয়ের।
শহীদ কাদরী ছিলেন শামসুর রাহমানের ছোটভাইয়ের ক্লাসমেট। ‘কাউন্টার পয়েন্ট’ নামে একটি ইংরেজি লিটারারি পত্রিকা প্রকাশনার সুবাদে শহীদ কাদরীর বড়ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে শামসুর রাহমানের। বাট হি [শামসুর রাহমান] লাইকড মি ভেরি মাচ, বলেছেন শহীদ কাদরী।
রাহমান (১৯২৯) ও কাদরীর (১৯৪২) মধ্যে বয়সের ফারাক ১৩ বছরের। বলা যায় শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ শহীদ কাদরীর কবিতা লেখার গাইড লাইন হিসেবে কাজ করেছেন।
কাদরীর কবিতা তারা কাটাকাটি করে ঠিক করে দিয়েছেন, ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন। ছোটভাইয়ের মতো করে গড়ে তুলেছেন তারা শহীদ কাদরীকে।
মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থের কবি হলেও আজকের বাংলা কবিতায় শহীদ কাদরী এক অনন্য উজ্জ্বল নাম। কবিতায় অতিমাত্রায় নগর কেন্দ্রিকতার কারণে, কিংবা সহজে নাগরিক চেতনাধারায় প্লাবিত হয়ে শহীদ কাদরী এককথায় ‘নাগরিক কবি’ বলে বিবেচিত। কিন্তু কাদরীর কবিতার গভীর তল-অন্বেষণে দেখা যায়, তিনি শুধু একজন নাগরিক কবিই নন, তার কবিতা বহুবিচিত্র।
সুদূরসানী। কিন্তু তার রচনার পরিমাণ সে তুলনায় যথেষ্টই কম। শহীদ কাদরীও স্বীকার করেন তা। এই অভিযোগের জবাবে শহীদ কারদী নিজের আড্ডাপ্রিয়তাকে দায়ী করেছেন। আড্ডা তার প্রাণের নেশা হওয়ায় যেমন তিনি যখন তখন প্রিয় মানুষদের সঙ্গে আড্ডায় জড়িয়ে পড়েন, তেমনি সময় অসময়ে প্রচণ্ড আলসেমি তাকে জাপটে ধরায়, লেখালেখিতে যে সময় দিয়েছেন তা ভয়াবহভাবেই কম।
এক্ষেত্রে তিনি শার্ল বোদলেয়ার, যাকে বলা হয় প্রফেট অব মডার্নিজম এবং জাঁ আর্তুর র্যাবোঁর মতো বিশ্বসাহিত্যের দুই পথিকৃৎ কবির কথা উল্লেখ করে বলেন, এরাও খুব কম লিখেছেন।
শহীদ কাদরী লেখালেখি শুরু করেন নিতান্তই ছোট্ট বয়সে, যখন তিনি মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। শুরু করেছিলেন নাটক দিয়ে। তারপর প্রবেশ কবিতায়। শহীদ কাদরীর লেখা পঞ্চম কবিতা ‘এই শীতে’ ছাপা হয় বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায়।
সেখান থেকেই অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে তিনি লিখতে শুরু করেন। এরপর বাংলা কবিতায় মাইকেল ও তিরিশের আধুনিকতাকে মনেপ্রাণে ধারণ করে শহীদ কাদরী তার কাব্যযাত্রা শুরু করলেও, বিশ্বপ্রেক্ষাপটে তার কাব্যদর্শনকে মিলিয়ে নিতে অভিলাষী হন। টিএস এলিয়ট, এজরা পাউন্ড, ডব্লিউ এইচ অডেন, শার্ল বোদলেয়ার, ব্রায়ান প্যাটেন, আড্রিয়ান হেনরি, এ্যালেন গিনসবার্গ তাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। গিনসবার্গ সম্পর্কে শহীদ কাদরী বলেন, ‘গিনসবার্গ কবিতার এমন এক প্রদেশে ঢুকেছিলেন যা আগে কেউ পারেননি। আমাদের সময়ের আর্তনাদ গিনসবার্গের কবিতায় পাওয়া যায়।
’ শহীদ কাদরীকে প্রভাবিত করেছিল ফন্সয়েড, হিউম, এরিক ফন্সমের মতো জগতখ্যাত দার্শনিকেরা। দর্শন, নৃতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব এগুলোর পাশাপাশি শহীদ কাদরী বিজ্ঞান ও ইতিহাসচর্চায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন। ২০০১ সালের ২৯ আগস্ট হাসানআল আব্দুল্লাহকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “যেমন ধরো ইতিহাস পড়তে গেলে তুমি হেরোডাটাসের বই অবশ্যই পড়বে। পৃথিবীর প্রথম চিন্তাবিদ যিনি ইতিহাস লেখেন। সর্বকালের সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ ইতিহাস গিবনের ‘দ্য ডিকলাইন এন্ড ফল অব রোমান এম্পায়ার’।
রোমান এম্পায়ারের ডিকলাইন সম্পর্কে যখন গিবন লিখছেন, তিনি এমন আবেগ তাড়িত হয়ে গেছেন যে, গোটা প্যাসেজকে কবিতায় স্ক্যান করলে পারফেক্ট কবিতা হয়ে যায়। আবার আর্নল্ড টুয়েনবির ‘দ্য স্টাডি অব হিস্ট্রি’ বারো ভলিউমের এগুলো সব আমরা পড়েছি। এগুলো হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্ভার। কিংবা স্পিংলারের ‘ডিকলাইন অব দ্য ওয়েস্ট’। আবার আমাদের দেশের আর সি মজুমদারের ভারতের ইতিহাস, ড. নিহাররঞ্জন রায়ের বাংলার ইতিহাস... এরা হলো গ্রেট রাইটারস।
... তারপর ইজমগুলোও পড়তে হবে, যেমন ফ্যাকচুয়ালিজম, সিন্ডিক্যালিজম, এনারকিজম, সোশ্যালিজম এসব। ” তবে সব ইজমকেই আবার পাত্তা দেন না শহীদ কাদরী। যেমন পোস্টমডার্নিজম সম্পর্কে তার ধারণ মোটেও ইতিবাচক নয়। তিনি মনে করেন, পোস্টমডার্নিজম মডার্নিজমের আর একটি মাত্রা। কারণ মডার্নিজম কোন সীমা মানে না।
পূর্বাপর মার্কসিজমে বিশ্বাসী কবি শহীদ কাদরীর ব্যক্তি ও কবিজীবন বলতে গেলে অনেক বেশিই ঘটনাবহুল। প্রবাস জীবন, বিদেশী স্ত্রী, বিরামহীন অসুস্খতা বারবার তাকে লেখালেখি থেকে বিচ্যুত করতে চাইলেও প্রকৃত কবি কখনো লেখার কলম ফেলে অন্য কিছুতে পুরোটা মগ্ন হতে পারেন না। পারেননি শহীদ কাদরী। তবে দেশ ছেড়ে যাবার পর তার লেখালেখি যে অবিস্মরণীয়ভাবেই কমে গেছে, তার প্রমাণ গত তিরিশ বছরে তার একটিও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। এবং একটি বই করার মতো লেখাও তিনি সংগ্রহ করতে পারেননি।
এর অন্যতম কারণ তার মারাত্মক অসুস্খতা। অনেকেই জানেন যে, শহীদ কাদরীর দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে, সপ্তাহে তিনবার রক্ত পরিশোধনের মাধ্যমে বেঁচে আছেন তিনি। গত দুমাস আগে গুরুতর অসুস্খ হয়ে তিনি আবার হাসপাতালে ভর্তি হন। দীর্ঘদিন তাকে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়। এরপর কিছুটা সুস্খ হয়ে উঠলেও এখন তিনি কিছুই করতে পারছেন না।
তবে প্রবাস জীবনে লেখা ৪০/৫০টি কবিতা তার হারিয়ে গেছে, যেটি দিয়ে তিনি একটি বই করতে চেয়েছিলেন।
শহীদ কাদরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’, প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে; দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’, প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে; এবং তৃতীয় বা সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’, প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে।
এই তিনটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ দিয়েই শহীদ কাদরী বাংলা কবিতার গভীরে তার শেকড় প্রথিত করেছেন। শহীদ কাদরীর কবিতা গভীর অনুসানী দৃষ্টির দূর দিকনির্দেশনা। সবসময় সময়কে ধারণ করে স্বাদেশিকতা, আন্তর্জাতিকতা এবং আন্তর-ভূগোলের চৌকস উপস্খাপনে শহীদ কাদরী নির্মাণ করেছেন তার কবিতার নিজের এলাকা।
গভীর শিল্পবোধ ও বিশিষ্ট কাব্যভঙ্গি তার অপার কাব্যপ্রতিভাকে অনন্য করে তুলেছে। শহীদ কাদরী তার কবিতার শব্দ নির্বাচন থেকে শুরু করে ভাষাভঙ্গি, উপস্খাপনা, বিন্যাস কৌশলে সবসময় নিজেকেই অতিক্রম করতে চেয়েছেন। নতুন নতুন চিত্রকল্পের নির্মাণ, নব নব উপমা উৎপ্রেক্ষার প্রয়োগে শুরু থেকেই তিনি দক্ষতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। দৃষ্টিভঙ্গির সুদূরতা, গভীর দর্শনবোধ, সময় ও প্রবৃত্তি চেতনা তার কবিতায় সাবলীলভাবে রেখাপাত করে। অভাবনীয়ভাবে শহীদ কাদরীর কবিতা রাজনীতি ও পরাধীন জাতির শোষণ ও বঞ্চনা তাড়িত হয়ে পাঠকের কাছে উপস্খাপিত হয়।
নগর যান্ত্রিকতার গভীর ধোঁয়াশার মধ্যেও তিনি নান্দনিক নৈসর্গিক বর্ণনায় সিদ্ধহস্ত কুশীলব। শহীদ কাদরী তুমুল বৃষ্টিতে নগরে বসে এইভাবে আলোড়িত হন :
উৎফুল্ল আঁধার প্রেক্ষাগৃহ আর দেয়ালের মাতাল প্ল্যাকার্ড,
বাঁকা-চোরা টেলিফোন-পোল, দোল খাচ্ছে ওই উঁচু
শিখরে আসীন, উড়ে আসা বুড়োসুড়ো পুরনো সাইনবোর্ড
তাল দিচ্ছে শহরের বেশুমার খড়খড়ি
কেননা সিপাই, সান্ত্রী আর রাজস্ব আদায়কারী ছিল যারা,
পালিয়েছে ভয়ে।
[বৃষ্টি, বৃষ্টি]
রাজপথ, রাজত্ব, প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, শহর, এভিনিউ, মাতাল, জুয়াড়ি, ভিখারি, লম্পট, বেশ্যা, সিপাই, সান্ত্রী, বুলেট, বেয়নেট, মিছিল, পার্ক, ফুটপাত, মার্চপাস্ট, সেনাবাহিনী ইত্যাদি শব্দ বারবার ঘুরেফিরে আসায় তার গভীরতর নগর ও রাজনীতি চেতনা ভাস্বরিত হয়। পরক্ষণেই আবার তিনি উচ্চারণ করেন :
রয়ে যাই ঐ গুল্মলতায়,
পরিত্যক্ত হাওয়ায় ওড়ানো কোন হলুদ পাতায়,
পুকুর পারের গুগ্গুলে,
একফোঁটা হন্তারক বিষে, যদি কেউ তাকে পান করে ভুলে,
[মৃত্যুর পরে]
এ রকম আরো অসংখ্য আবহমান বাংলার নিসর্গবর্ণনা শহীদ কাদরীর কবিতায় সার্বজনীনতা এনে দেয়।
১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণ করেই শহীদ কাদরী প্রত্যক্ষ করেন ’৪৭-এর দেশভাগ।
তারপর বাঙালি জাতির একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধও সংঘটিত হয়েছে তারই চোখের সামনে। তিনি প্রত্যক্ষ করেন একটি পরাধীন জাতির নির্মম শোষণ-বঞ্চনার কত করুণ নির্মম কাহিনী।
শৃঙ্খলিত, বিদেশী পতাকার নীচে আমরা শীতে জড়োসড়
নি:শব্দে দেখেছি প্রেমিকের দীপ্ত মুখ থেকে জ্যোতি ঝরে গেছে
ম্লানমুখো ফিরেছে বালক সমকামী নাবিকের
মরিয়া উল্লাস ধ্বনি আর অশ্লীল গানের কলি
নীর পালকের মত কানে গুঁজে, একা সাঁঝবেলা।
যীশুখৃষ্টের মতন মুখে সৌম্য বুড়ো সয়ে গেছে
ল্যান্টর্নের ম্লান রাত্রে সৈনিকের সিগারেট, রুটি, উপহার
এবং সঙ্গম-পিষ্ট সপ্তদশী অসতর্ক চিৎকার কন্যার।
[উত্তরাধিকার]
শহীদ কাদরীর কবিতার উচ্চারণ যে কতটা তীব্র ও দ্ব্যর্থহীন রাজনীতি বিষয়ক কবিতাগুলোতে তা যথার্থ ফুটে উঠেছে।
প্রকৃত কবি যেমন প্রতিটি শব্দকে অস্বাভাবিক গতি এনে দিতে পারেন, তেমনি শহীদ কাদরী উচ্চারণ করেন :
রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে রেসকোর্সের কাঁটাতার,
কারফিউ, ১৪৪ ধারা,...
রাষ্ট্র মানেই স্ট্রাইক, মহিলা বুর সঙ্গে
এনগেজমেন্ট বাতিল,
রাষ্ট্র মানেই পররাষ্ট্র নীতি সংক্রান্ত
ব্যর্থ সেমিনার
রাষ্ট্র মানেই নিহত সৈনিকের স্ত্রী
রাষ্ট্র মানেই ক্রাচে ভর দিয়ে হেঁটে যাওয়া
[রাষ্ট্র মানেই লেফ্ট রাইট লেফ্ট]
শহীদ কাদরীর কবিতার শব্দবাণ কতটা মারাত্মক, কতটা প্রচণ্ড, কতটা আক্রমণাত্ম তার জাজ্বল্য প্রমাণ এ প্রকার বাক্য ও শব্দ নির্বাচন।
বলা হয়ে থাকে শামসুর রাহমানের কবিতা প্রাচুর্যে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা উথান-পতনে এবং শহীদ কাদরীর কবিতা গাম্ভীর্যে বিশিষ্ট। ওপরের উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলো সে প্রমাণ দিয়েছে নি:সন্দেহে। এত কঠোরতা, এতটা গাম্ভীর্য, এতটা অহাস্য-বদনে যে কবির বেড়ে ওঠা, সে কবিও যে প্রেমের কাছে তার নিজেকে উৎসর্গ করে দিতে কার্পণ্য করেন না, তা তার কবিতার ভেতর দিয়েই আমরা অনুধাবন করি :
একবার শানানো ছুরির মতো তোমাকে দেখেছি
হিরন্ময় রৌদ্রে জ্বলজ্বলে
যেখানে মাংসের লালে
শিউরে উঠেছে আমার সত্তার সখ্যতা
সেইখানে, সোনালি কিচেনে তুমি
বসন্তের প্রথম দিনেই হত্যা করেছিলে আমাকে তোমার
নিপুণ নিরিখে
[একবার শানানো ছুরির মতো]
কখনো গম্ভীর কখনো প্রেমিক শহীদ কাদরী স্পর্শ করেছেন জীবনের বিচিত্র এলাকা। অত্যাচারী শাসকের দম্ভের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেমন দ্ব্যর্থহীন সত্যোচ্চারণে দ্বিধা করেননি, পরাধীন জাতির শৃঙ্খল ছেঁড়ার সাধনা করেছেন কবিতায়, তেমনি তিনি দাঁড়িয়েছেন অসহায় ছিন্নমূল মানুষের পাশে।
শহরের অসহায় গণিকাদের নিয়ে তার অন্তর্বেদনাকে তিনি সাবলীলভাবে তুলে আনেন তার কবিতায়। তিনি তাদের ভূষিত করেন ‘রুগ্ণ গোলাপ’ অভিধায়। এখানে তিনি না-নাগরিক, না-আধুনিক হয়ে, হয়ে ওঠেন এক মানবিক কবি শহীদ কাদরী :
শহরের ভেতরে কোথাও হে রুগ্ণ গোলাপদল
শীতল, কালো, ময়লা সৌরভের প্রিয়তমা,
অস্পৃশ্য বাগানের ভাঙাচোরা অনিদ্র চোখের অïসরা,
দিকভ্রান্তের ঝলক তোমরা, নিশীথসূর্য আমার!
যখন রুদ্ধ হয় সব রাস্তা, রেস্তোরাঁ, সুহৃদের দ্বার,
দিগন্ত রাঙিয়ে ওড়ে একমাত্র কেতন, তোমাদেরই উন্মুক্ত অন্তর্বাস,
... ... ...
আলিঙ্গনে, চুম্বনে ফেরাও শৈশবের অষ্ট আহ্লাদ!
বিকলাঙ্গ, পঙ্গু যারা, নষ্টভাগ্য পিতৃমাতৃহীন,
কাদায়, জলে, ঝড়ে নড়ে কেবল একসার অসুস্খ স্পন্দন
তাদের শুশ্রূষা তোমরা, তোমাদের মুমূর্ষু স্তন!
... ... ...
কানাকড়ির মূল্যে যা দিলে জীবনের ত্রিকূলে তা নেই
[আলোকিত গণিকাবৃন্দ]
শহীদ কাদরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’-এ নি:সঙ্গতা, অসহায়ত্ব, জুলুম, নির্যাতন তথা নগর জীবনের বিধ্বস্ত পরাধীনতা ঈর্ষণীয়ভাবে ভাষা পেয়েছে। ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কাব্যগ্রন্থে তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের ঘটনাপ্রবাহে অনেক বেশি বর্ণনাত্মক হয়ে ওঠেন। ‘কোথাও কোন ক্রন্দন নেই’তে তিনি সমসাময়িকতা ও অতিমাত্রায় আধুনিকতাকে ধারণ করেন।
আজকের একুশ শতকে দাঁড়িয়ে আজকের প্রজন্ম কবি শহীদ কাদরীকে কে কতটুকু স্মরণ করছেন, তার কবিতা এ প্রজন্মের কাছে কীভাবে গ্রহণীয় বা বাতিল হয়ে যাচ্ছে তা নি:সন্দেহে গুরুত্বের সঙ্গেই ভেবে দেখার বিষয়। শহীদ কাদরী যিনি পোস্টমডার্ন ধারণা সম্পর্কে এমন শানানো মন্তব্য করেছেন এবং উত্তর-আধুনিক ধারণাকেই বাতিল করে দেন, এবং নিজেকে যিনি বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যের প্রায় সর্বশেষ গতি প্রকরণের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত রাখতে চান, সে-নিরিখে আজকের একজন তরুণ সাহিত্যকর্মীর সঙ্গে তাকে বিভাজন করে খুব দূরে রাখার কোনো সুযোগ নেই। বরং শহীদ কাদরী তার কবিতার তারুণ্যেই প্রায় আজকের নতুন কবিতাকর্মীর সমসাময়িক হয়ে ওঠেন। অনেক অগ্রজকেই তো আগামী দিনের পাঠক মুহূর্তে ভুলে যাবেন সময়ের প্রবাহধারায়, আবার অনেককেই রেখে দেবেন তার সার্বক্ষণিক পাঠের তালিকায়। তেমনি আমার বিশ্বাস, আরো দীর্ঘদিনই কবি শহীদ কাদরী আলোকিত করে যাবেন আগামী দিনের পাঠক তথা তরুণ কবির পাঠের তালিকা।
তার কবিতার তারুণ্য আরো দীর্ঘদিন বাংলা কবিতাকে অদম্য শক্তি এনে দেবে, সাহস দেবে, সন্দেহ নেই। আমরা কবি শহীদ কাদরীর দীর্ঘায়ু ও সুস্খ জীবন কামনা করি। ----------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ। সাময়িকী। ১০ জুলাই২০০৮ প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।