আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাদাকালো ইউনিফর্মের অন্তরালে রঙ্গীন দিনগুলি: বন্ধু নজরুলকে... /ইমন

জ্বলে উঠার অপেক্ষায় নিভু নিভু প্রদীপ।

আজ বাইরে মেঘলা আকাশ। সাদা মেঘগুলোকে নগ্ন নারীর একপায়ে লেপ্টে থাকা মোজার মতো দেখাচ্ছে। জানালার ফাঁক দিয়ে থিরথির বাতাস এসে গায়ে লাগছে। বৃষ্টি নামবে নামবে করছে কিন্তু এখনো নামছে না।

মাঝে মাঝে হঠাৎ আবার রুপালী রোদের ছটা এসে মেঘ তাড়ানো খেলা খেলছে। মেঘলা আকাশ আমার অনেক অনেক প্রিয়। এ দেশের বৃষ্টির আওয়াজে টিপটপ শব্দ পায় না। কাদা মাখামাখির সুযোগও সে দেয় না। তাই প্রিয় বৃষ্টির সাথে ছয় বছর পূর্বে আড়ি দিয়েছিলাম এখনো ফিরিয়ে নিতে পারিনি।

এখানের ছাদে এক ধরণের অপার্থিবতা থাকে বটে কিন্তু দেশের মতো কোন পার্থিবতা নেই। চিরুনির মতো এন্টিনা, রেলিঙের গায়ে সারি সারি কাকের বিষ্ঠা, ভেজা লাল কালো ব্লাউজ, শিশুর মূত্রসিন্চিত হরেক রকমের রঙ্গীন কাপড় কোনটিই নেই। তাই ঘরে বসে আপাতত কাব্যিক মনটাকে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করাটাই শ্রেয়। না, সেটাও আজ হবে না। আজ যা ইচ্ছে তা লিখতে ইচ্ছে করছে।

আমার মহামূল্যবান ড্রয়ার খুলে কিছু পুরোনো জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করতে ইচ্ছে হলো। তাই করলাম। মহামূল্যবান ড্রয়ার বলাতে কি আছে সেখানে সেটা জানার ইচ্ছে হচ্ছে তাইনা? আসলে এই ড্রয়ারে কিছু পুরোনো চিঠিপত্র আর বন্ধুদের পাঠানো জন্মদিনের কার্ড সযত্নে রেখেছি। ড্রয়ার খুলে মাঝে মাঝে সাদাকালো ইউনিফর্মের অন্তরালের সেসব রঙ্গীন দিনগুলোকে খুঁজি। হলুদ খামের একটি চিঠিতে চোখ আটকে গেলে খুলে পড়তে শুরু করি..... 'দোস্ত, আমার শুভেচ্ছা নিস।

তারপর কেমন আছিস? সুজন, আরাফাত, সুমনা, নাজনীন ওদের খবর কি? আমি ঢাকায় এসেছি প্রায় ছয়মাস হয়ে গেলো অথচ তুই আমার কোন খবর নিস নি। মাঝখানে মার্কশীট আনতে চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। ব্যস্ততার জন্য ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও তোর বাসায় যেতে পারিনি। তারপরও যতদিন চট্টগ্রামে ছিলাম প্রতিদিনই কলেজে যেতাম কারণ মার্কশীট নিতে হয়ত তুই কলেজে আসবি কিন্তু তাও আসলি না। তোর রেজাল্টের খবর শুনলাম।

তুই নাকি অনেক ভালো করেছিস। আমি কোনভাবে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়ে এই যাত্রায় পাশ করেছি। তারপর এখন কি করবি ভাবছিস? কোথায় এ্যডমিশন নিবি? নাকি দেশের বাইরে চলে যাবি? তোরা তো ভাই 'পয়সাওয়ালার পোয়া'। আমাকে দেশেই থাকতে হবে। খুব ইচ্ছে আছে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার কিন্তু মনে হচ্ছে আমার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে রে।

আচ্ছা, বলতো এতোদিন হয়ে গেলো অথচ তুই আমাকে চিঠি লিখিস নি কেন? আমি ভেবেছিলাম আর কেউ না হোক অন্তত তুই আমার সাথে যোগাযোগ রাখবি। মোয়াজ্জেমের সাথে চিঠিতে মাঝে মাঝে যোগাযোগ হয়। ওকে বলেছিলাম তোর খোঁজখবর জানাতে কিন্তু ছাগলটা তোর বাসায় যায়নি। আর তুই ব্যটা গাধা আমার এতো প্রিয় বন্ধু হয়েও কোন যোগাযোগ করিস না। সামনে পেলে তোকে একটা লাথি দিতাম।

এবারের মতো বেঁচে গেলি। তারপর ঈদ কেমন কাটালি? সুজন, সুমনা, নাজনীন আর তোর পারভীনের সাথে তোর যোগাযোগ আছে কি? ওদের আমার শুভেচ্ছা জানাস। সুজন বলদটাকে বলিস আমাকে চিঠি লিখতে। তোর বাবা মাকে আমার শ্রদ্ধাপূর্ণ সালাম জানিয়ে দোয়া করতে বলিস। যাইহোক, তোর অনেক সময় নষ্ট করলাম।

অবশ্যই আমার কাছে লিখবি। সবশেষে ভালো থাকিস। ইতি, তোর সেই পুরোনো বন্ধু নজরুল। এই চিঠি ছিলো আমার বন্ধু নজরুলের শেষ চিঠি। এরপর তার সাথে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল।

আমার বাসার কাছে এসেও বাসায় আসেনি বলে সেদিন অনেক রাগ করেছিলাম। প্রথমে কিছুক্ষণ তো ওর সাথে কথাই বলি নি। কিন্তু তখনো জানতাম না ওর সাথে আমার আর কোনদিন কথা হবে না। ভিসা পাওয়ার তিন দিন পরেই আমি নির্বাসিত হতে পাড়ি জমালাম বিলেতে। ওর সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব ছিল না বলে বলতে ও পারিনি আমি পরবাসে যাচ্ছি।

ওর বাবা সেনাবাহিনীতে ছিলো বলে সময় অসময়ে ওদের স্থানান্তরিত হতে হতো। বন্ধু, কত কথা কতো গান মনে পড়ে গেলো। তুই ভালো আছিস তো? তুই কি এখনো গীটার হাতে গলা ছেড়ে গান গাস? মনে আছে একদিন তুই আর আমি ভাটিয়ারীর একটা ব্রীজে বসে গলা ছেড়ে গান গাচ্ছিলাম। তারপর এক মানুষ পকেট থেকে বের করে পাঁচটা টাকা দিয়েছিল। এটা দেখে আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

পরে টাকাটা নিতে অস্বিকৃতি জানালে তিনি বলেছিলেন ' বাবা আমি খেটে খাওয়া মানুষ, আপনাদের গান শুনে ভালো লাগল। সামর্থ্য নেই বলে আপনাদের দুটি চায়ের দাম দিচ্ছি, নেন চা খাবেন। ' এরপর আমরা আর কিছু বলতে পারিনি। সেই খেটে খাওয়া ভাটিয়ালী হাসির মানুষটির পাঁচটাকার মূল্য আজকের পাঁচশত কোটি টাকার লোভী যন্ত্রমানবরা কি দিতে পারবে? যাক সে কথা বাদ দে। ছোট ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম আমি চলে আসার পরে তুই নাকি বাসায় গিয়েছিলি।

কিন্তু তুই ব্যাটা গাধা যোগাযোগের কোন নাম্বার রেখে আসিস নি। আর আমার ভাইকে তো চিনিসই। সেও তোর কোন নাম্বার চেয়ে নেয়নি। এরপর থেকে যতবারই বাসায় ফোন করতাম তোর কথা জিগ্গেস করতাম। যদি একবার এসে ফোন নাম্বারটা দিয়ে যাস এই আশায়।

কিন্তু এরপর তুই আর বাসায়ই যাস নি। তোকে খুব মনে পড়ে দোস্ত। তোর মতো খুব কম বন্ধুকে এই জীবনে পেয়েছি। তোর কবিতা লেখালেখি কেমন চলছে? আর আঁকাআঁকি কি এখনো করিস? নাকি ব্যস্ততার অজুহাতে এসব ছেড়ে দিয়েছিস? মনে আছে একবার তোর কিছু পেন্সিল স্কেচ আমি করেছি বলে ক্লাসে চালিয়ে দিয়েছিলাম। তোর এসব দেখে আমার খুব ঈর্ষা হতো।

তারপর তুই এখন কোথায় আছিস? তুই এভাবে উধাও হয়ে যাবি ভাবতেও পারিনি। জানলে তোর সাথে বন্ধুত্বই করতাম না। সেটাই ভালো হতো। এখন সেসব দিনের কথা মনে করে চোখের কোণে নোনাজল জমা হতো না। গতবার দেশে গিয়ে সবার সাথে দেখা হলো।

শুধু তোর সাথে দেখা হলো না। তোর খবরও কেউ জানে না যে যোগাযোগ করব। জানিস, আরাফাত ছ্যাঁকা খেয়ে মাঝখানে দাড়ি টাড়ি রেখে দেবদাস হয়ে গিয়েছিল। পরে মামার ব্যবসা দেখতে ঢাকায় গিয়ে সে ব্যাটাও উধাও হয়ে গেলো। তারপরও দেশে গেলে তাকে খুঁজে বের করা যাবে।

যে লাকির জন্য বেচারা পড়ালেখা মাথায় তুলেছিল সে নাকি এখন ফার্ষ্ট ক্লাস সিটিজেনকে বিয়ে করে আমেরিকাতে সংসার করছে। হায়রে ভালবাসা রে। আর সুজন তো এখন পুরোদুস্তর ব্যবসায়ী। ঐ শালা নাকি আমি দেশে গেলে বিয়ে করবে। আর পারভীনের বিয়ে হয়ে গেছে সেই কবেই।

এতোদিনে হয়তো দু তিনটে বাচ্চাও আছে। মনে আছে, তোরা ওকে আমার বউ বলে চেতাতিস। নাজনীনের কথা জানি না। স্বামী সংসার নিয়ে সুখেই আছে হয়তো। মনে আছে তোর, কলেজের ফেয়ারওয়েল এর দিনে আমরা সবাই মিলে 'কফি হাউসের সেই আড্ডাটা' গেয়েছিলাম।

তখনও এই গান ভিতরে নাড়া দিতো না। এখন শুনলে সেসব দিনের কথা চোখে ভেসে আসে। তোর কি মনে আছে সেসব কথা, ক্যান্টিনে গিয়ে সিঙ্গারা সমুচা নিয়ে কতো হাতাহাতি করেছি। কিনে খাওয়ার সামর্থ্য সবার ছিলো কিন্তু কাড়াকাড়িতে কতো আনন্দই না পেতাম। একবার তো এ নিয়ে তোর সাথে সুজনের রাগারাগি ও হয়েছিল।

খুব ইচ্ছে করে একটা সিঙ্গারা কিনে দু তিনজনে ভাগাভাগি করে খেতে। আমরা যখন হুমায়ুন স্যারের বাসায় পড়তে যেতাম, আমি স্যারের বাসার ফ্রিজ থেকে বীরের মতো চুরি করে সন্দেশ মিষ্টি নিয়ে এসে তোদেরকে খেতে দিতাম। তোর কি সেসব কথা মনে আছে? তুই আমার বাসায় গেলে মোটর বাইকে চড়তে চাইতিস। একবার বের হলে সন্ধ্যা করে বাসায় ফিরতাম। আমার মোটরবাইক ছিল দেখে তোর কতো ঈর্ষা হতো।

আমার বাসায় তুই যতবারই আসতিস মা তোর সাথে প্রথমে আন্চলিক ভাষায় কথা বলে ফেলতো। তুই আমার দিকে আর আমি তোর দিকে তাকিয়ে হাসতাম। তোর কথা মা মাঝে মাঝে জিগ্গেস করতো। মার শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। মার জন্য দোয়া করিস।

তোর সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। এভাবে কতো কথা বলা যায়? দুটি বছর একই ছাদের নিচে বসে ক্লাস করতাম। আমাদের মধ্যে যে ক্লাসে আগে যেতাম পাশের সিটটা বই রেখে একজন আরেকজনের জন্য বরাদ্দ করে রাখতাম। এতো সব কথা কি এক চিঠিতে শেষ করা যায়? যায় না। তুই যেখানে থাকিস ভালো থাকিস রে দোস্ত।

ইতি, তোর প্রিয় বন্ধু ইমন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।