রিকশাওয়ালার বিরস ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে যে শব্দটা বের হলো তা সম্মতিসূচক না অসম্মতির আমি তার তোয়াক্কা না করেই দুম করে রিকশায় উঠে বসি। ভাবখানা এমন দেখাই যে রিকশাওয়ালার প্যাডেলে চাপ মেরে সামনে চালানো ছাড়া আর যেন কোন উপায়ই নেই।
প্রচণ্ড রোদ উঠেছে। কদিন ধরে রোদ্দুরে দেশটা একবারে পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে। নিউমার্কেট এসেছিলাম কাঁচা বাজার করতে।
আজকাল থলে ভরে টাকা আনলে যা জিনিসপত্তর পাওয়া যায় তা পকেটে ভরেই বাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। তারপরেও আজ আমার দুহাত ভরা মালসামান। শাকপাতা গুঁড়ো চিংড়ি মিষ্টি কুমড়ো কচুঘেঁচু কিছু মুদির পোঁটলা আর একখানা মাদুর ও একটা মুলি বাঁশের আগায় ঝুঁটিবাঁধা ঝাঁটাÑ এইসব নিয়ে আমার জেরবার অবস্থা।
বহুদিন ধরে আমার বউ একটা ঝাড়ন আর বাসার কাজের মেয়েটির জন্য একটা মাদুর কিনতে বলে বলে হদ্দ হয়ে গেছে। তার ধারণা ফেরিওয়ালারা যেসব জিনিস ফেরি করে বেড়ায় তা আপাতদৃষ্টিতে সস্তা হলে কী হবে কদিন পরেই তার তিন অবস্থা হয়ে যায়।
তার চেয়ে পাকাপোক্ত দোকান থেকে কিনলে দাম একটু বেশি পড়লেও টেকসই হয় আর তাতে হিসেব করলে দেখা যায় ফেরিওয়ালাদের চেয়ে বরং সস্তা পড়েছে।
আজ বাজারে বেরুবার সময় বউকে কথা দিয়ে এসেছি আগে মাদুর ঝাঁটা পরে অন্য কথা। কথা না দিয়েও উপায় ছিল না। কারণ সীমা মানে আমার বউ হাসিমুখে ঘাড় কাত করে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে বলেছে আজ ওসব আনতে মিস করলে খবর আছে। আমি এর অনুবাদ করে নিয়েছি, ঝাঁটা না আনলে ঝাঁটার বাড়ি।
মাদুর না আনলে বাদুড় চামচিকা থেকে শুরু করে আরো সব ক্ষুদ্র প্রাণীর মস্তিষ্কের সাথে আমার মাথার মগজ নিয়ে থাকবে বাছা বাছা তুলনা।
নীলক্ষেত বাজমে কাদেরিয়ার পেছনের গলিতে আমার বাসা। অন্য সময় হলে হেঁটেই যাওয়া যেতো। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়। আর এতক্ষণ বাজারে ঘোরাঘুরি করে রোদের তাপে আমার মাথার ভেতরে মগজ গলে যেন তেল হয়ে গেছে।
এক নম্বর গেট দিয়ে বের হতেই দেখি প্রচণ্ড জ্যামে গোটা শহর যেন নীলক্ষেত ক্রসিংএ আটকে আছে। এ জ্যাম ছুটতে লাগবে নির্ঘাত আধ ঘন্টা। হেঁটে ক্রসিং পার হয়ে তারপরে রিকশা নিলে বরং তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। কিন্তু আমার দরকার এখন একটু ছায়া আর বসার মতো জায়গা। আমি জানি এরকম জ্যামের মধ্যে রিকশাওয়ালারা প্যাসেঞ্জার নিয়ে আটকে থাকতে চায় না।
তাই আমি রিকশাওয়ালাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উঠে পড়ি। হুডটা তুলে দিয়ে ওহহোওওও করে আয়েশ করে দম ছাড়ি। তাতে আমার চালক বাবাজী ঘাড় ঘুরিয়ে একটু জরিপের চোখে আমার দিকে এক নজর তাকায়। আমি একটু কৈফিয়তের সুরে কেন যেন বলি, বড় ধকল গেল। উহ্ কী গরম রে বাবা!
আমার কথায় রিকশাওয়ালারও বোধ হয় চৈতন্য হয়।
সে তর্জনী দিয়ে নিজের কপাল থেকে বড় বড় ফোঁটায় জমে থাকা ঘাম কাঁচিয়ে ফেলে। সেই সঙ্গে কিছু একটা সে বিড়বিড় করে বলে।
কী বলছে ও? মুখের ভাবে বোঝা যায় অন্তত আমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলেনি। তা হলে মরুগগে।
এদিকে সামনে দেখা যাচ্ছে কিলবিল করা যানবাহনের ফাঁক থেকে এঁকেবেঁকে আশ্চর্য কৌশলে লাঠি হাতে এক বুড়ো এগিয়ে আসছে এদিকেই।
মানে বুড়ো আমাকেই টার্গেট করেছে। জ্যামে জিম্মি এখন আমি। ভিক্ষুকটি এক হাতে লাঠির ভর দিয়ে লেংচে লেংচে ক্ষিপ্রগতিতে আমার দিকে আসছে আর এক হাতে চেপে ধরে রেখেছে তার পাঞ্জাবীর ঝোলা পকেট। নিশ্চয়ই ওখানে আছে তার রোজগারের টাকা পয়সা। আমার খুব বিরক্ত লাগতে থাকে।
মাঝে মাঝে আমি একটা ইউটোপিয়ান চিন্তাবিলাসে ডুবে গিয়ে ভাবি, আমি যদি একদিনের জন্যও প্রধানমন্ত্রিত্ব পেতাম, তবে প্রথমেই দেশ থেকে ভিক্ষুক ব্যবসাটা ব্যান করে দিতাম।
বুড়ো এসে হাত পেতে দাঁড়ায়। রমযানের চাঁদের দেখা পেতে যাচ্ছি। অতএব আমার কাছ থেকে বুড়োর নাকি অবধারিতভাবে কিছু পাওনা হয়েছে। আমি মুখ বেঁকিয়ে বলি আপাতত শাবানের চাঁদ থেকে আমার জন্য কিছু খুচরো পয়সা ঝরে পড়ার আগ পর্যন্ত বাবাজী আপনাকে আমি কিছু দিতে পারছি না।
মাফ করবেন।
বুড়ো মিয়ার মনে হয় আমার রসিকতাটুকু হৃদয়ঙ্গম করতে একটু সময় লাগে।
সে আবার বলে, বাবা রে, গরীবেরে দয়া করেন।
আমি আর তার কথার জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করি না। এর মধ্যে রিকশা একটু আগাতে শুরু করছে।
বুড়ো মিয়া এখন নীরবে হাতটা বাড়িয়ে রেখেই রিকশার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে থাকে।
এবার আমার রিকশাওয়ালা ব্রেক কষে তার লুঙ্গির গিঁট খুলে বুড়োর হাতে একটা কয়েন তুলে দেয়।
ব্যাপারটা কী হলো? এ তো আমাকে একরকম ইনসাল্ট করা হলো! বুড়ো কয়েনসহ হাতটি আকাশের দিকে তুলে দাতার জন্য দোয়া মাঙতেই আমার রিকশাওয়ালা বেশ ক্ষুব্ধ স্বরে বলে, মুরব্বি, আপনে এক ফকির আমি আর এক ফকির, তবে আমাগো চায়াও বড় ফকির আছে। এই যে দেখতে আছেন সাট পেন্ট পিন্দা যাইতাছে কত মানুষ, হেরা আমাগো চায়াও ফকির। হেগো জন্য দোয়া করেন।
বুড়ো এবার লাঠিসহ দুহাত তুলে দোয়া মাগে।
তা তো হলো। কিন্তু রিকশাওয়ালাকে কি করে এই অপমানের জন্য শিক্ষা দেওয়া যায়? ব্যাটা বড় টাকাওয়ালা হয়েছে!
যা-ই ভাবি না কেন, রিকশাওয়ালাকে শিক্ষা দেওয়া আসলে আমার জন্য ডিফিকাল্ট। কারণ টাকা থাকুক আর না থাকুক তার তো আছে ব্যক্তি স্বাধীনতার ঝাণ্ডা! তার যা খুশি তা-ই করেছে, যা মন চেয়েছে, তা-ই বলেছে। কাজেই আমি একটা চিপাকলে আটকা পড়ে পেঁচামুখ করে বসে থাকি।
কোঁ কোঁ করতে করতে রিকশা আগাতে থাকে। যে রকম জ্যাম লেগেছে, নির্ঘাত তিন ধাক্কা লাগবে সিগনাল পার হতে। তাতে এই হাজী মোঃ মহসীন সাহেব আমার কাছে কত ভাড়া হাঁকবেন, মনে মনে তার চিন্তা করতে থাকি। আমার মনে হতে থাকে এ ওর একটা কৌশল। ভিক্ষুককে দুটাকা খয়রাত করে আমাকে একটু নীরব শিক্ষা দেওয়া যে, একবার পুঁটি মাছের আত্মার পরিচয় দিয়েছ দিয়েছ, আমাকে ভাড়া দিতে গিয়ে যেন আর সেটা করো না।
রিকশার ক্যাচম্যাচ শব্দের সাথে সাথে দেখছি হাজী মহসীন সাহেব বিড়বিড়ও করছেন! কী কী সব বলে যাচ্ছে! এ তো আর সহ্য করা যায় না। একবার ঝিকে মেরে বউকে শিখিয়েছে, ভদ্দরলোক বলে মুখ বুঁজে তখন সয়েছি, তাই বলে সারা রাস্তা ওর গজর গজর শুনতে শুনতে যাবো না কি এ্যাঁ?
গলাটা সাফ করে নিয়ে আমি একটু তেজের সাথে বলি, কি তখন থেকে গজর গজর করছো, কী হয়েছে?
আমার কথায় রিকশাওয়ালা এক ঝলক একটু পেছন ফিরে তাকিয়েই আবার মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাতে আমার রাগ আরো বেড়ে যায়। কোন পাত্তাই দিল না আমার কথায়?
রিকশা খানিকটা এগিয়ে আবার থেমে গেছে। পাঁচ মিনিট আটকে রাখার পর পাঁচ সেকেন্ডের জন্য সিগনাল ছেড়েছিলো।
রিকশাওয়ালা এখন মাথায় পেঁচিয়ে রাখা গামছাটা খুলে নিয়ে ঘসে ঘসে মুখের ঘাম মুছছে। খানিকক্ষণ চোখের ওপর চেপে ধরে রাখে গামছাটা। সে মুহূর্তে আমি টের পাই, ঘাম নয় চোখ মুছছে সে। আমি একটু ভড়কে যাই। সত্যিই কাঁদছে না কি?
রিকশাওয়ালা আমারই বয়সী।
আমার পঞ্চাশ। ওর হয় তো বাহান্ন তেপ্পান্ন হবে। আমি তাকে একটু সহানুভুতির স্বরে ডাক দিই, বলি, ও ভাই, তোমার কী হয়েছে?
আমার ডাক শুনে সে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকায়। রোদে পোড়া ঘর্মাক্ত ভাঙাচোরা ক্লান্তশ্রান্ত একখানা মুখ। চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে তখনও চিকচিক করছে পানি।
বুকটা আমার ভয়ে কেঁপে ওঠে। ওর কি কেউ মারা টারা গিয়েছে? একবার আমি এমন একজনের রিকশায় চড়েছিলাম, যে হাসপাতালে মেয়ের লাশ রেখে রিকশা চালাতে এসেছিলো। টাকা রোজগার না হলে মেয়েকে দাফন করবে কী দিয়ে! তার মুখটা যেন এমনই ভাঙাচোরা মনে হয়েছিলো।
অবশ্য এখন আমরা নিপুণভাবে আমাদের মানবিক বোধগুলোকে অসাড় করে ফেলতে চেষ্টা করি। এ ধরনের ঘটনাকে আমরা বিশ্বাস করতে চাই না।
মনে করি সবই চালাকি। মিথ্যা। আমাদের দোষ কী, চারপাশে প্রতারণা আর ঠকবাজীর এতরকম কৌশল যে আমরা ধরতে পারি না কোনটা আসল আর কোনটা নকল।
আমার দিকে তাকানোর পর রিকশাওয়ালার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে শুরু করেছে। পুরুষমানুষ হলে কী হবে, কান্না আমাকে খুব সংক্রমিত করে।
এ ক্ষেত্রে আমার মন আবার মেয়েদের মতো নরম। বন্ধুমহলে এ নিয়ে আমাকে অনেকেই হাসিতামাশা করে। কী করবো, সমাজ বানিয়েছি আমরা Ñ মানে আমাদের পূর্বপুরুষেরাই। পূর্বনারীরা যদি বানাতেন তা হলে নিশ্চয়ই ‘মেয়েদের মন’ কোন অবজ্ঞার টার্ম হিসেবে ব্যবহৃত হতো না। আর আমার মতে, সব পুরুষের যদি মেয়েদের মন থাকতো তবে আল্লা মিয়াকে আর সাতখানা দোজখ নির্মাণ করার কষ্ট করতে হতো না।
চোখের পানি মুছতে মুছতে রিকশাওয়ালা যে কাহিনী বর্ণনা করলো তা শুনে সত্যি বলতে কি আমারও চোখের কোনা শিরশির করে উঠলো।
ক’দিন ধরে তার রিকশার চাকায় সমস্যা দেখা দিয়েছিল। আজ সে গ্যারেজে গিয়ে প্রথমে রিকশা মেরামত করিয়েছে। যে কটা টাকা ট্যাকে ছিল তা দিয়ে মেরামত খর্চা দেওয়া গেছে। তারপর গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে।
সকাল দশটার সময় সে রামপুরা ক্লিনিক থেকে এক প্যাসেঞ্জার তুলেছে ঘণ্টায় একশ টাকা হিসেবে। লোকটার বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। সে বলেছে, তের বছর ধরে সে মালয়েশিয়া প্রবাসী। স¤প্রতি ঢাকায় এসেছে। ঢাকা শহরের সব কিছুই এখন অনেক বদলে গেছে।
পথঘাট চিনতে পারছে না ইত্যাদি। সেই লোক তার রিকশায় চড়ে দু ঘণ্টারও বেশি সময় ঘুরেছে। মৌচাক টিকাটুলি মতিঝিল সেগুনবাগিচার বিভিন্ন অফিসের সামনে রিকশা থামিয়ে কাজ সেরে আবার রিকশায় এসে বসেছে। সব শেষে এই নিউমার্কেট এসে তাকে পাঁচ মিনিট দাঁড়াতে বলে লোকটা হাওয়া হয়ে গেছে। রিকশাওয়ালা তার অপেক্ষায় ঘণ্টাখানেক বসে থেকে আশা ছেড়ে দিয়ে এখন আমাকে ‘খ্যাপ’ নিয়েছে।
ঝকমকে জামাকাপড় পরা সিনেমার নায়কের মতো চেহারার সেই লোক কী করে একজন গরীব রিকশাওয়ালার সাথে এত বড় প্রতারণা করতে পারলো! আধা বেলার রোজগার হারানো আর ভদ্রবেশী মানুষের কাছে প্রতারিত হওয়ার দুঃখে রিকশাওয়ালা আবার ডুকরে কেঁদে ওঠে।
এই দুঃখে তাকে আমি কীভাবে সান্ত্বনা দেবো ভেবে পাই না। আমার পুরুষ মনটা অবশ্য আমাকে চটজলদি সাবধান করে দিয়ে বলে, বেশি দরদ দেখাতে যেও না। তা হলে আবার বিদেশওয়ালার কাছে ধাপ্পা খাওয়ার ক্ষতিটা পুষিয়ে নেবার জন্য তোমার কাছে হাতটাত পেতে বসতে পারে। তাই আমি সব দিক বাঁচিয়ে তাকে বলি, কী আর করবে।
তোমার ভাগ্য খারাপ। আল্লার কাছে বিচার দিয়ে রাখো।
আমার কথায় রিকশাওয়ালা গর্জে উঠে বলে, হ্যাহ্, আল্লার বিচার! সেডা কি আমাগো জন্য? আমাগো জন্য আল্লার কাছে একটা জিনিসই আছে তা অইলো অবিচার।
এর পরে আর কথা চলে না।
মনে মনে ভাবি, ভদ্রবেশী লোকটা কী পরিমাণ বদমাশ! আহা রে, এমন গরীব খেটে খাওয়া মানুষকে কীভাবে এমন ঠকাতে পারলো? আবার ভাবি এ তো কেবল দুতিনশো টাকার প্রতারণা।
তথাকথিত ভদ্র আর বড়লোকেরা যে আকছার কোটি কোটি টাকার ঋণ খেলাপ করছে, নানারকম প্রকল্পের নামে মিলিয়ন বিলিয়ন টাকা আত্মসাৎ করছে, বিদেশে চাকরি দেবার নাম করে গরীবের ভিটেমাটি বিক্রি করা লাখলাখ টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে!
এ সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চলেছি। এরই মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়ে, এক মধ্যবয়সী পথচারীকে দেখে উল্টো দিক থেকে হেঁটে আসা আর এক ব্যক্তি দ্রুত এগিয়ে তার দুহাত জড়িয়ে ধরে ভারি ঝাঁকুনি দিয়ে হেসে হেসে কথা বলছেন। মনে হচ্ছে বহুদিন পর যেন কোন পরিচিতজনের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। হঠাৎ আমার মনে হয়, এমন তো ঐ মালয়েশিয়া প্রবাসী ব্যক্তিটির ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে! হয় তো নিউমার্কেটে ঢোকার পরপরই তের বছর পরে কোন বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গিয়েছে। অনেক জমে যাওয়া কথা বলতে বলতে তারা হয়তো কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসেছে।
খাবারের অর্ডার দিয়েছে। তারপর সত্যিই বেমালুম ভুলে গেছে রিকশাওয়ালার কথা। বিদেশে সে নিশ্চয়ই রিকশা চড়ে না। তাই ব্যাপারটি তার অভ্যাসের সাথে যুক্ত হয়নি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, অসাড় বোধকে জাগিয়ে তুলতে হবে।
আমি কেন শুধু শুধু লোকটিকে প্রতারক ভাবছি? আমার চিন্তা তো প্রথমেই ইতিবাচক হওয়া দরকার ছিলো! লোকটি হয়তো রিকশাওয়ালাকে ফাঁকি দেবার কথা তার মাথাতেই আনেনি। সঙ্গে সঙ্গে আরও দুএকটি সম্ভাবনার কথা মাথায় আসে।
কিছুদিন আগেই তো, একদিন বিকেলে আমি অফিস থেকে ফিরে আমার বাসার গলির মুখে রিকশা থেকে নেমেছি, দেখি ওখানে আর একটি রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। আমার বাসায় ঢোকার গলিটি খুব অপরিসর। কোনমতে গায়ে গায়ে লেগে দুজন মানুষ হেঁটে যেতে পারে।
আমাকে দেখে অপেক্ষমাণ রিকশাওয়ালা বলে, এক তরুণ তার রিকশায় এসেছে, বাসা থেকে ভাড়া আনার কথা বলে গলির ভেতরে ঢুকেছে, কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেল সে আর ফিরে আসেনি। সে আমাকে বলে, বাবা, কয়জনারে বললাম, কিন্তু তারা বলে তাগো বাসায় ঐ বয়সের কোন পোলা নাই। আইচ্ছা কন তো বাবা, আমি এখন কার কাছে ভাড়াটা পাই?
অপু? চকিতে আমার মাথায় সম্ভাবনাটা আসে। দ্রুত বাসায় ঢুকে অপুকে পেয়ে যাই, মোবাইল ফোন কানে লাগিয়ে কার সাথে যেন হা হা করে হাসছে। আমি তাকে রিকশা দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছে কি না জিজ্ঞাসা করতেই এক হাত লম্বা জিভ কেটে ডবল ভাড়া নিয়ে ঝড়ের বেগে দৌড় দেয়।
আচ্ছা, আর মোবাইল ফোনও তো একটা কারণ হতে পারে ঐ লোকটার ক্ষেত্রে? হয়তো নিউমার্কেটে কাজ সারার এক পর্যায়ে এমন জরুরি কোন সংবাদ এসেছে, কোন দুর্ঘটনা, আপনজন কারো মুত্যু সংবাদ বা মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অন্য কোন খবর Ñ যা শুনে লোকটির কোন হুঁশ ছিল না, আর একটা গেট দিয়ে বের হয়ে চলে গেছে।
হয় তো সে খবর পেয়ে লোকটি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে, হয় তো বা তার হাটর্ এ্যাটাক হয়েছে। আশেপাশের কোন সহৃদয় ব্যক্তি তাকে পৌঁছে দিয়েছে কোন ক্লিনিকে।
এই সম্ভাবনাগুলোর কথা বললে কি আমার রিকশাওয়ালার মনটা একটু শান্ত হবে? ভুল তো মানুষ মাত্রেরই হয়। আর দুর্ঘটনার ওপরে তো কারো হাত নেই! না থাক, ব্যাপারটা আবার গোড়া কেটে আগায় জল ঢালার মতো না হয়ে যায়।
ওর ভাবনা ও-ই ভাবুক।
এর মধ্যে আমার রিকশাও অনেকখানি চলে এসেছে। নীলক্ষেত ক্রসিং পার হয়ে যাবার পর আর তেমন আটকে থাকতে হয়নি। বাজমে কাদেরিয়ার পেছনের গলিতে ঢোকার মুখে আসন্ন রমযানের জন্য রকমারি ইফতারির লালশালু ব্যানার দেখে রিকশাওয়ালা একবার সহজ গলায় মন্তব্যও করে। বলে, রোজা আইতে এহনো বাকি বার চৌদ্দ দিন আর ইছতারির পাল্লা লাইগা গেছে।
রোজা যেন আসে খালি খাওয়ার জন্য!
বাঃ বেশ। টাকার শোকটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে ওর।
রিকশাটা গলির মুখে এসে দাঁড়ায়। এখানে আমাকে নামতে হবে। তারপর চিপা গলি দিয়ে গজ বিশেক হেঁটে গেলে পর আমার বাসা।
আমি মালসামানগুলো রিকশাওয়ালাকে একটু ধরতে বলে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করি। এ পর্যন্ত রিকশাওয়ালা আমার কাছে কোন সাহায্য চায়নি। সাহায্য নিতে নিশ্চয়ই তার আত্মসম্মানে বাঁধবে। তাই আমি তাকে এ রাস্তার যা সর্বোচ্চ ভাড়া তা দেবো বলেই ঠিক করি।
মানিব্যাগ খুলে দেখি ওতে দুটো একশ টাকা আর কয়েকটা ছিন্নভিন্ন দু টাকার নোট পড়ে আছে।
আমি একশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে ধরে বলি, নাও, তিরিশ টাকা রাখো।
রিকশাওয়ালা বাড়িয়ে ধরা টাকাটার দিকে একবার উদাস চোখে তাকায় তারপর কিছু না বলে গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে থাকে।
আমি বলি, কী হলো, ভাড়া পছন্দ হলো না? এর বেশি ভাড়া তো এখানে হয় না!
রিকশাওয়ালা মুখ থেকে গামছাটা একটু তুলে ধরে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলে, সাব, কইলাম না আল্লার একটা জিনিসই আছে আমাগো জন্য আর তা অইলো অবিচার। আপনেরে আমার আইজকার দিনের সব হিস্টোরি খুইলা কইলাম আর এহন আপনে আমারে কন একশ ট্যাকা ভাঙাইয়া দিতে! যারে দিয়া বউনি করছিলাম সে তো ঠক দিলো। এহন আপনেরে দিয়াই আমার বউনি! আর আপনে কন....
এবার আমার দ্বিতীয় গালটায় চড় পড়লো।
তাই তো। ওর কাছে তো কোন টাকাই নেই! ভাংতি দেবে কোত্থেকে?
তা হলে?
তা হলে আর কী! আমার তো এখন বাসায় ঢুকে ভাংতি টাকা নিয়ে আসা ছাড়া উপায় নেই। কাজেই বাজারের জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে হাতে নিয়ে বলি, তো ভাই, তুমি একটু দাঁড়াও, তিন মিনিটের মধ্যে আমি টাকা নিয়ে আসছি।
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো আমি যেন সেই মালয়েশিয়া প্রবাসী যাত্রীটির স্বরেই কথা বললাম। আর হ্যাঁ, রিকশাওয়ালাও কেমন দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
এবার আমার চেহারায় নিশ্চয়ই একটা অপরাধীর ভাব ফুটে ওঠে। আমি কেমন কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলে উঠি, ভয় নেই, আমি তোমার ঐ প্যাসেঞ্জারের মতো পালিয়ে যাবো না। এই গলিতে ঢুকেই বিশ গজ সামনে এগিয়ে গেলেই আমার বাসা। বাম দিকে, লাল গেট। আমি কৌশলে রিকশাওয়ালাকে আমার বাসার লোকেশনটা বলে দিই।
যাতে তার মনে কোন সন্দেহ না থাকতে পারে।
রিকশাওয়ালা এবার কোন কথা না বলে রিকশার পা দানিতে বসে গামছায় হাওয়া খেতে থাকে। অর্থাৎ সে আমার জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করলো। সে মুহূর্তে আমার মনে হলো এবারও যেন আমারই হার হলো। এত কথা বলার কোন দরকার ছিল না।
বেশি কথা বলে আমি আমার মনের দীনতাকেই যেন ওর কাছে প্রকাশ করে দিলাম।
অগত্যা আমি মালসামান হাতে ঝুলিয়ে বড় বড় পা ফেলে বাসার দিকে হাঁটা দিলাম।
বাসা থেকে খুচরো টাকা নিয়ে গলির মুখে ফিরে আসতে আমার লাগে তিনের জায়গায় পাঁচ মিনিট। কিন্তু কোথায় আমার রিকশাওয়ালা? সে তো নেই! নেই মানে রিকশাসহই সে নেই হয়ে গেছে। আশ্চর্য! গেল কোথায়? টাকা হাতে নিয়ে আমি একটু এগিয়ে যাই।
এখান থেকে যে গলিটা বাজমে কাদেরিয়ার দিকে চলে গেছে তার প্রায় মাথা পর্যন্ত দেখা যায়। সেখানেও কোন রিকশা নেই। এটুকু সময়ের মধ্যে রিকশাটি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
রিকশাওয়ালা কি আমাকে শেষ পর্যন্ত ফাঁকি দিল? আবার কয়েকটি সম্ভাবনার কথা আমার মাথায় উঁকি দিয়ে যায়। তবুও গলির মুখে দাঁড়িয়ে আমি তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।