দাগ খতিয়ান নাইতো আমার/ঘুরি আতাইর পাতাইর...
বৃহত্তর সিলেটের গ্রামাঞ্চলে নাসির উদ্দিন বিড়ি অন্যান্য ধুমপানের চেয়ে ক্ষতিকর হলেও এই অঞ্চলের ধুমপাযীদের রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। পাশাপাশি এই অঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে এই অঞ্চলের বিরাট জনগোষ্ঠি ধুমপানজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগছে।
সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রায় বিনা বাধায় ইনডিয়া থেকে এই নাসির উদ্দিন বিড়ি অবৈধভাবে এদেশে আসছে। জানা গেছে প্রতিদিন সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে কয়েক কোটি টাকার নাসির উদ্দিন বিড়ি চোরাচালানের মাধ্যমে আসে।
তবে প্রায় ৫ বছর আগে বিড়িতে বিষ থাকায় গুজব চড়িয়ে পড়লে মাঝে কিছু দিন এর চাহিদা কমে যায়। কিন্তু কিছুদিন পূর্বে আবার নিজের জায়গায় ফিরে এসে তার অবস্থান নিয়েছে।
প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নাসির উদ্দিন বিড়ি বৃটিশ আমলের শেষ দিক থেকেই এই অঞ্চলের ধুমপায়ীরা পান করে আসছে। তখন থেকে এই তামাক পাতার বিড়ি সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠে। এটা অল্পমূল্য এবং সহজলভ্য হওয়ায় এর প্রতি ধুমপায়ীরা সহজেই আসক্ত হয়।
বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও এই নাসির বিড়ি দিয়ে মেহমানদের আপ্যায়ন করতে দেখা যায়। গ্রাম এলাকায় কোনও বিচার হলে অথবা কোনও বৈঠক হলে নাসির উদ্দিন বিড়ি এবং ইনডিয়ান খাসিয়া পানের সঙ্গে সুপাড়ি দিয়ে উপস্থিতিদের আপ্যায়ন করা হয়। গ্রামের গৃহস্তরা নিজেদের কামলাদের এবং গরুর রাখালদের চাকরিতে রাখার সময় মজুরির সাথে দৈনিক কয়েক প্যাকেট বিড়িও দিয়ে থাকেন। হাওরে ফসল লাগানোর আগে কামলাদের এবং ফসল কাটার সময়ও তাদেরকে এই বিড়ি দেয়া হয়ে থাকে। গৃহস্থ এবং মজুররা কাজের সময় কথার মাধ্যমে এটা নির্ধারন করে থাকেন মাইনের সঙ্গে নাসির বিড়ি রোজ কয় প্যাকেট দেয়া হবে।
কখনও এই অঞ্চলের লন্ডনে বসবাসকারী লোকজনও দেশে আসলে শখ করে এই বিড়ির প্যাকেট সঙ্গে নাসির বিড়িরি প্যাকেটও নিয়ে যান। ভালো ব্রান্ডের সিগােেরটের চেয়ে এই বিড়ি আরও কড়া সাধ এনে দেয় বলেই তারা সূদুর লন্ডনে সঙ্গে নেন। এভাবেই এই অঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে ও চুমুকে এই তামাক পাতার নাসির উদ্দিন বিড়ি মিশে গেছে।
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বৃটিশ আমল থেকেই এই বিড়ির বিশাল বাজার সৃষ্টি হয়েছে। তাই বৃহত্তর সিলেটের প্রত্যন্ত এলাকায় নিষিদ্ধ থাকা সত্তেও এর প্রকাশ্য বিক্রি হয়।
জানা গেছে ইনডিয়া থেকে এই দেশের একদল চোরা কারবারি থানা পুলিশ আইন শৃংখলা রাকারী বাহিনীকে ম্যানেজ করে এই বিড়ি বাজারজাত করেন। এ েেত্র সীমান্ত এলাকার থানা গুলো চোরাকারবারিরা প্রতি বছর নাসির বিড়ি ও ইনডিয়ার খাসিয়া পানের জন্য নির্দিষ্ট হারে অলিখিতভাবে ইজারা নেন। আর এই ইজারার টাকা থানার ক্যাশিয়ার নামের লোকজন নিয়ে আসেন। ক্যাশিয়ারদের সিভিল পোশাকে মফস্বল এলাকার হাটবাজারে গিয়ে এর বখরা আনতে দেখা যায়। এই সিস্টেম প্রায় নিয়মেই পরিণত হয়েছে।
কয়েক যুগ ধরে নাসির উদ্দিন বিড়ি এই অঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। বিশেষ করে গ্রাম এলাকার প্রায় ৯৫ ভাগ লোক এই বিড়ির প্রতি আসক্ত। গত এক দশক আগে ২৫ কাটির এক প্যাকেট বিড়ি ২ টাকায় বিক্রি হলেও এখন এক প্যাকেট বিড়ি বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকায়। সিগারেটের চেয়েও দ্রুত বাড়ছে এর মূল্য। মূলত ব্যাপক চাহিদার কারণেই এর মূল্য ক্রমাগত বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
জানা গেছে এই নাসির উদ্দিন বিড়ি ইনডিয়ার ৪২ স্ট্রান্ড রোড কলকাতায় প্রস্তুত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা শেখ নাসির উদ্দিন। ইনডিয়ায় এর মাজার খুবই মন্দা। মূলত এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে টার্গেট করেই এর বাজারজাত করা হয়েছিল। এই বিড়ির বিক্রি বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলে বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেটের ৪ টি জেলায় এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারের আইন শৃংখলা বাহিনীর সহযোগিতায় এটা বাজারজাত হচ্ছে। তাই অনেকে অন্যান্য সিগারেটের মতো এই বিড়িকেও আমদানী করার কথা বলেছেন। আর তা করা হলে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব পাবে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বৃহত্তর সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, ছাতক, দোয়ারাবাজার, তাহরিপুর, জকিগঞ্জ, কানাইঘাটসহ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এই বিড়ি আসে। এর সঙ্গে যুগযুগ ধরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট সৃষ্টি হয়েছে।
তারা অধিকাংশরাই এখন কোটিপতি। এর সঙ্গে একটি শ্রমিক শ্রেণীও গড়ে উঠেছে। তারা ভারকাধে করে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে সীমান্ত থেকে এটা নির্দিষ্ট চোরাই সিন্ডিকেটর ম কাছে জমা দেয়। কখনও ককনও এই শ্রমিকরা আইন শৃংখলা বাহিনীর কাছে ধরা খেলেও সিন্ডিকেটের মূল হোতারা ধরা ছোয়ার বাইরেই রয়ে যায়। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোকদের সঙ্গে এবং ধুমপায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এই বিড়ির চোরাই বাজারজাত রোধ করা সম্ভব নয়।
বরং এই বিড়িকে বৈধভাবে আমদানী করার কথা বলেলেছেন অনেকেই। সদর থানার জয়নগর বাজারে সাধু দাস জানান, তিনি বংশানুক্রমিকভাবে এই নাসির বিড়ি সেবন করছেন। তার আগের প্রজন্ম এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মও এই বিড়ির প্রতি আসক্ত। এটা তিকর জেনেও তারা তা সেবন করছেন। তিনি বলেন, সরকারের উচিত এই বিড়ির উপর ভ্যাট আরোপ করা।
তার বক্তব্য হলো বিদেশ থেকে সিগারেট আমদানী করা গেলে এই নাসির বিড়িও আমদানি করা উচিত। এতে সরকার রাজস্ব পাবে। কিন্তু চোরাচালানের মাধ্যমে এটা বাজারজাত হওয়ায় সরকার তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, পাশাপাশি ইনডিয়ার কোম্পানি এদেশের টাকায় লাভবান হচ্ছে। খোজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রায় ৫ কোটি কোটি টাকার নাসির বিড়ি আসে। এর সঙ্গে চোরাকারবারিরা মদ, গাজা, ইনডিয়ান কাপড়, চিনি, অস্ত্রসহ বিভিন্ন অবৈধ পণ্যও নিয়ে আসে।
এ প্রসঙ্গে সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপার মোঃ শফিকুল ইসলাম জানান, বৃহত্তর সিলেটের লোকজন তিকর ও অবৈধ জেনেও এই বিড়ির প্রতি বেশি আসক্ত। সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে এ দেশে আসে এটা ধ্রুব সত্য। তিনি বলেন, আইন শৃংখলা রাকারী বাহিনী প্রতি মাসে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ল ল টাকার বিড়ি পোড়ায়। তবে সাধারণ লোকজন এটা আমদানি করার যে কথা বলেছেন তার সাথে আমি একমত নয়। কারণ এটা অবৈধ।
তা করা হলে চোরাকারবারিরা আরো উৎসাহিত হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।