আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দত্তক

যখন বিকাল হতে থাকে, হতে হতে সূর্যটা ঢলে পড়ে, পড়তে থাকে

না হয় আপনি আমার সাথে বাসায় যাচ্ছেন, তাই বলে আমি আপনার সাথে যাচ্ছি সেটা ঠিক নয়, আমি যাচ্ছি আপনার সন্তানের সাথে। তুলতুলে তিনবছরের জিলানা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে তার বাসায়, তবে আপনার সাথে আমার একটা সম্পর্ক আছে। সেটা এ মুহুর্তে মনে পড়ছে না, হয়তো আপনি হবেন জিলানার বাবা সূত্রের সম্পর্কায়ন। কিন্তু এতে জিলানার সাথে আপনার সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তাকে আমি সংরক্ষণ করতে পারছি না। বাস্তবিক অর্থে আমার দরকার এখন জিলানার জন্য একটা ঘর দেখানো।

এই যে আসুন আমার ঘরে, একটা রুম দেখতে পাচ্ছেন, একদম এক পাশে, দেখেছেন, এটাকে আলোর মধ্যে রেখেছি। একটু নীচু কেন রুমটা? ও যেন উপরে উঠতে শেখে, নীচে যেন না নামে। দেখুন দেয়ালটা, পয়ত্রিশটা রং পাবেন। কালার ব্যংক থেকে নিজের মনের মত রং বানিয়ে নিয়েছি। আশ্চর্য্য, জানেন এক লালেই আছে আঠারোটা শেড! আচ্ছা আপনি কি খেয়াল করেছেন, জিলানার জন্য আমি ছোট একটা পড়ার টেবিল বানিয়েছি।

সেটাতে রং দিয়েছি আকাশনীলা। আপনি কি খেয়াল করেছেন, এই নীলটা বাচ্চাদের বেশ পছন্দের রং, বিশেষত জিলানা তো আকাশ দেখলে মরিয়া হয়ে ওঠে। এত বই কেন? বইগুলো আসলে ওর পড়ার জন্য নয়, দেখার জন্য। ও বইগুলোর রং দেখবে, চেহারা দেখবে, ওজন দেখবে। এই রুমটাতে জিলানা থাকবে পাঁচবছর পর্যন্ত, এর পরে রূমটা আবার পরিবর্তন করে দেব।

দেয়ালে তখন আকাশনীলার বদলে সবুজ রং দেব। ছাদে ঝুলিয়ে দেব ঝাড়বাতি। ছোট্ট একটা মিউজিকপ্লেয়ার থাকবে। কিন্তু কম্পিউটার রেখেছেন দেখছি! এটা গানের জন্য নয়। মিউজিকপ্লেয়ারের দেহসৌষ্ঠব গানের জন্য এক ধরণের অনুভূতি তৈরী করতে পারে।

আপনি যা শুনছেন তার মাধ্যমের শিল্পিত রূপটাও একটা বিষয়। ভাল নাটকের জন্য ভাল মঞ্চও চাই। ভাল বইয়ের জন্য ভাল বাইন্ডিং, ছাপা, ভাল গানের ভাল শিল্পী। তেমনি ভাল গানের জন্য একটা শিল্পীত মিউজিক প্লেয়ার, যার রং হবে একেবারে নীল, কবিতার কথা লেখা থাকবে গায়, তেমন একটা। এই কম্পিউটারে ও আসলে পড়া শিখবে।

অ যখন লিখবে তখন সেটা অজগনরের একটা কার্টুন দেখবে, আরো প্রানী থাকবে। অ শিখবে, তার উচ্চারণও শিখবে। একদম আধুনিক। বাহ বাহ বেশ বেশ। আপনি ফুল রাখেন নি দেখছি! ওটাও আছে।

তবে ফুলগাছটাকে তার নিজে লাগাতে হবে। এজন্য আমি টব নয়, একটুকরো জমি রেখেছি। আমি ভেবেছি ওর ঘর থেকে লনের দিকের দরজাটা সবসময় খোলা থাকবে। কেবল একটা মসকিউটো নেট লাগনো থাকবে দরজায়। আলগা।

আমদানী করা ফুলের চারা নয়, একটা ওয়েব আছে, দেশি ফুলের, সেগুলো দেখে জিলানা পছন্দ করবে কোন ধরণের ফুল নেবে, গাছ লাগবে। চারা লাগানোর সব নিয়ম দেয়া আছে সেখানে। জিলানা দারূণ সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছে। আমি তো ওকে এত কিছু দিতে পারছি না। আমার ছোটবেলায় কেটেছে মানিকগঞ্জের গ্রামে।

নদীর পাশে ঘর ছিল। আমি তো ভাবতেই পারছি না, এখন এত কিছু পাচ্ছে জিলানা! জিলানার বাবা মনে হলো এখন একটু ভাবাবেগে অস্থির হলেন। আমি তার সন্তানটিকে পয়সা দিয়ে কিনে নিচ্ছি। এবং তিনি সানন্দেই রাজী হয়েছিলেন। অথচ এখন রুম ঘুরে ঘুরে দেখছেন বেশি মনযোগ দিয়ে, আমি তাকে অভিভূত করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি ভাবাবেগী হয়ে পড়েছেন।

এটা আমার উদ্দেশ্যকে বিঘ্নিত করতে পারে। ‘আচ্ছা আপনার এত প্রস্তুতি কেন? আমার সন্তান কিন্তু আমি ওর জন্য তেমন বোধ করি না। ’ এমন কথা বলে আমাকে পাগল করে ফেললো। ইচ্ছে হচ্ছে বলি, মেয়েটা বোধহয় তোমার নয়, দেখো এসো স্ত্রী কার কার সাথে শুয়েছে! কিন্তু মুখ সামলে বলি, সম্ভবত আমার সন্তান নেই বলেই এই অনুভূতি তৈরী হয়েছে। ওহ! জিলানার বাবা এখন ছোট্ট খাটটাতে পা দুলিয়ে বসেছে।

তার নাকে বিন্দু বিন্দু জল। জিলানারও এই একই বিষয় ঘটে। আমি জিলানার রক্ত মাংস সব টের পাই, কিন্তু এই অভদ্র, কুৎসিত লোকটির সাথে জিলানের সবকিছু মিলে যায়। জিলানা আমাকে বোধ করে না। অথচ জিলানার শরীরে হয়তো আমার রক্তই।

আমি নিশ্চিত নই, তবে জিলানার মা বলেছে, যখন তার সাথে শুয়েছি, সেই মাসেই সে জিলানাকে ধারণ করেছে। কিন্তু এখন ভদ্রলোকটি আচরণ করছে বাচ্চার মত। দেয়ালের রং এ হাত দিয়ে দেখছে। বইয়ের গন্ধ শুকে দেখছে। আমি তাকে সেখানে থাকতে বলে বের হয়ে গেলাম।

কিছু একটা তো খাওয়াতে হবে, কফি বানানো যায়। আর চেকটিও লিখতে হবে। মাত্র তিনলাখ টাকা দাম জিলানার, এর পরে সে আমার হয়ে যাবে। আমার নামের শেষের চৌধুরী লেগে যাবে তার নামের শেষে। ডিএনএ টেস্ট করিয়ে নেব কিনা ভাবছি, যদি জিলানার মা মিথ্যে কথা বলে, যদি জিলানা ঐ পাগল, অভদ্রলোকেরই সন্তান হয়।

আমি একটু উদার হতে চেষ্টা করি, হলে হবে, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, তাহলে জিলানা আমার হয় কিভাবে! কফি আর চেক নিয়ে ঢুকতেই দেখি ভদ্রলোক দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে। রুমের এক কোনে একটা লোহার দোলনাও রেখেছিলাম। ভদ্রলোকের ভারে সেটা দিব্যি দেবে গেছে, কিন্তু ছিড়ছে না। আমি তার হাতে কফির মগ দিতেই তিনি বললেন, জিলানা বেশ আরামে থাকবে বোঝা যাচ্ছে! আমিও তাই ভাবছি, আচ্ছা আপনার কিসের চাকুরী যেন? সে আর বলবেন না, কাজ করতাম একটা কোম্পানীতে, চলছিলো ভালই, কিন্তু হঠাৎ দেশ উত্বপ্ত হয়ে উঠলে তাদের ব্যবসা ভাল যাচ্ছিল না। দিল ছাটাই করে, চারবছর যাবত ইন্সুরেন্সে কাজ করি।

মানুষের বাসায়, অফিসে সারাদিন গিয়ে পড়ে থাকি! কেমন আয় হয়? কোনমতে বাসা ভাড়া আর খেয়ে চলা যায়। আপনার স্ত্রী কিছু করে না? আমি জানি তার স্ত্রী ভাল আয় করে। আমিই তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছি অনেক মাসে। আমার মত তার আরো বেশ কয়েকজন প্রেমিক পুরুষ আছে। স্বামী’র না জানার কথাই না।

জিলানার মা আমাকে বলেছিল, তার স্বামীর আয়ে বাসা ভাড়া দেয়া যায় না। সেজন্য স্বামীকে বলেই সে এই লাইনে এসেছে। না, আর কি করবে, পড়ালেখা তো বেশি দূর করে নি, মাত্র কলেজে উঠেছিল! সেজন্যই তো জিলানাকে আপনার কাছে দিয়ে দিতে চাচ্ছি! তা বটে, তবে আমার আগ্রহটাই বেশী ছিল, আচ্ছা আপনি কি জানেন, আমি বিয়ে করি নি! জিলানার বাবা আশ্চর্য্য হয়। সে বলে, তাহলে, জিলানাকে কিভাবে আপনি লালন পালন করবেন? কেন, পুরুষরা কি বাচ্চা পালন করতে পারে না! এই রুমটা দেখে কি মনে হয় আমার কোন উৎসাহ বা চেষ্টা কম আছে? না, সে নয়! বলেছিলাম, ওর মা ওকে নিয়ে এটা সেটা করতে করতে সময় পায় না, সারাদিন অস্থির করে রাখে! আপনি চিন্তা করবেন না, মাঝে মাঝে মাকে এখানে পাঠিয়ে দেবেন, এসে দেখে যাবে! ভদ্রলোকের মুখে মুচকি হেসে ফুটে ওঠে। তারপরে হাসি নিভে যায়।

একসময় আমার হাত ধরে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, স্যার আমাকে একটা চাকুরী দিন, তাহলে বউটাকে দিয়ে আর বেশ্যাগিরি করাবো না! আমি থ হয়ে যাই। সে বলে, আপনি জানেন না স্যার, জিলানা আপনার ঔরসজাত বলে ও মিথ্যা কথা বলেছে, আপনাকে প্রভাবিত করার জন্য। যেন জিলানাকে আপনার কাছে দিয়ে সংসারের খরচ বাচানো যায়, আর সে বেশ্যাগিরি ছাড়তে পারে। আপনার সাথে যেদিন শুয়েছে তারও তিনমাস পড়ে ও প্রেগনেন্ট হয়েছে।

জিলানাকে নিয়ে আমার সব সাধ মুহূর্তে উবে যায়। সত্যিই উবে যায়। একধরণের বিরক্তি তৈরী হয় এই ছোটলোকদের জন্য, আমার মহত্ব দিয়ে মেয়েটির জন্য কত সুন্দর একটা ভবিষ্যত তৈরী করে দিতে চাইলাম, কিন্তু বোকার হদ্দ, সব নষ্ট করে দিল। পুনঃপ্রকাশিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।