সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com
শফিক ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ জমলে তিনি মাঝে মাঝে স্মৃতিচারণ করতেন। জহির রায়হান তার বন্ধু ছিলেন। জহির রায়হানকে নিয়ে তিনি মূল্যবান কিছু তথ্য দিয়েছিলেন। আমি তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম তিনি যেন এগুলো নোট আকারে হলেও কিছু কিছু লিখে রাখেন।
শফিক রেহমানের বাবা সাইদুর রহমান ছিলেন শেখ মুজিবের শিক্ষক। ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে মিছিল ও গাড়ি বহর পথে একটা জায়গাতেই থেমেছিল, সাইদুর রহমানের বাসার সামনে। এটা শফিক ভাই বলেছিলেন। পরে শেখ মুজিব শফিক রেহমানকে ডেকে নিয়েছিলেন। তার সঙ্গে একটা মজার সাক্ষাৎ হয়েছিল শেখ মুজিবের।
সত্তরের দশকে শফিক ভাই হোটেল শেরাটনে অ্যাকাউন্টস সেকশনের দায়িত্বে ছিলেন। তখনকার রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্র ছিল শেরাটন হোটেল। সে সময়ের অনেক কথা বলতেন শফিক ভাই।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি লেখার সঙ্গে শফিক ভাই কীভাবে জড়িত ছিলেন সেটা তিনি নিজেই লিখেছেন। সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে তার দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্বের কথা কোথাও লিখেছেন বলে দেখিনি।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড মুজাফফর আহমদকে নিয়ে কথা বলতেন তিনি। তাদের নিয়েও কিছু লেখেননি।
পঞ্চাশের দশকে নতুন ঢাকা শহরে শিক্ষিত ঘরে যে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ, আইনজীবীরা তৈরি হচ্ছিলেন তাদের একজন শফিক ভাই। বাংলাদেশের এখনকার চেহারা তাদের চোখের সামনেই গড়ে উঠেছে। অনেক বিষয়ে শফিক ভাইয়ের পর্যবেক্ষণ আমার কাছে নিরপেক্ষ মনে হয়েছে।
তার দেখার একটা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
নানা আড্ডার পর আমি তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তিনি যেন আত্মজীবনী লেখেন। এবং সেটার ধরন বিচার করে আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমার সম্পাদিত আর্ট অ্যান্ড কালচারেই যেন সেটা লেখেন। তিনি রাজি হননি।
শুধু বলতেন, এখনও সময় হয়নি। আগে অবসরে যাই তারপর লিখবো। শেষ পর্যন্ত আমি বলেছিলাম তিনি যেন আমাকে একটা সাক্ষাৎকার দেন। নিজের পত্রিকার একজন সাংবাদিককে তিনি কীভাবে সাক্ষাৎকার দেবেন, এই প্রশ্ন তিনি আমাকে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। শফিক ভাইয়ের প্রতি আমার সমস্ত সমালোচনা সত্ত্বেও আমি মনে করি, তার বর্ণাঢ্য জীবনের কাহিনী শুধু নিকটবর্তী মানুষের জানা থাকা দরকার তা-ই নয়, লিখে বই আকারে সেটা প্রকাশ করা উচিত।
শফিক ভাই গল্প লিখতেন। সাহিত্যের প্রতি তার প্যাশন প্রচণ্ড। সম্ভবত সাহিত্যিকই হতে চেয়েছিলেন। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট পেশায় ছিলেন বটে, কিন্তু নেশায় লেখক ছিলেন। সন্ধানী-ইত্তেফাক থেকে শুরু করে সাম্পাহিক যায়যায়দিন দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রতিভাধর মানুষগুলোর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়েছে।
সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের রমরমা অবস্থায় যায়যায়দিনকে কেন্দ্র করে তিনি অনেককে একত্রিত করেছেন। যাদের লেখার কথা ছিল না তাদের লিখিয়েছেন। যাদের বলার কথা ছিল না, তাদের বলিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন যেন কেউই আর তার পাশে থাকেন নি। কেন কে জানে? যখনই কোনো বুদ্ধিজীবী মার্কা লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে দেখেছি তারা শফিক ভাই সম্পর্কে ভাল কথা কেউ বলেননি কখনো।
বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল, আওয়ামী পন্থীরা তাকে সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু তরুণরা খুব সহজেই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। প্রথম আলাপে।
শফিক ভাই শুধু আমাদের নয়, পুরো পত্রিকা জগৎকেই একটা কথা খুব ভালোভাবে শুনিয়েছেন, সেটা হলো : তরুণদের কথা শুনতে হবে। তাদের স্পেস দিতে হবে।
বাংলাদেশের পুরনো আমলের সাংবাদিকতা, চিন্তচর্চায় সাপ্তাহিক যায়যায়দিন বড় ধরনের একটা বাড়ি দিয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। না যায়যায়দিনের বিশেষ সংখ্যায় গল্প লিখে গত পনের বিশ বছরে কেউ বড় লেখক বা উপন্যাসিক হয়েছেন বলে আমার জানা নেই। কিন্তু কলাম লিখে অনেকেই বড় কলামিস্ট হয়েছেন এটা নিশ্চয় করে বলা যায়। শফিক ভাই তরুণদের কথা শুনতেন, আইডিয়াগুলো নিতেন। স্পেস দিতেন।
নতুন চিন্তা ও আইডিয়ার জন্য তিনি সর্বদা প্রস্তুত থাকতেন। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু একথাও পাশাপাশি বলে রাখতে হবে, তিনি মুদ্রদোষের মতো প্রায় সবাইকে বলতেন, আমার কথা তোমাদের শুনতে হবে। তোমরা কিচ্ছু জানো না। আমি জানি।
আমি দেখেছি।
ভাগ্য বলে কি কোনো ব্যাপার আছে। কখনো কখনো আমার মনে হয়েছে, দৈনিক পত্রিকা শফিক ভাইয়ের ভাগ্যে নেই। প্রথমবার তার সম্পাদিত দৈনিক যায়যায়দিন প্রতিদিন চলেছিল ৩৪ দিন। তিনি লিখেছিলে, তার আইডিয়ার পরাজয় হয়েছে।
এবার দৈনিক যায়যায়দিন তো বেরই হচ্ছিল না। আর বের হওয়ার পর সপ্তাহে সপ্তাহে বন্ধ হওয়ার জল্পনা শোনা যেত।
মনে আছে, যায়যায়দিন প্রকাশের দুইদিন আগে আমি আর রাইসু ভাই সিএনজি করে শাহবাগ যাচ্ছিলাম। হঠাৎ রাইসু ভাইর মনে হলো অমঙ্গলজনক ৬/৬/৬ তারিখে যায়যায়দিন প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। তিনি বললেন, আপনার কি মনে হয় এই বিষয়টা নিয়া শফিক ভাইরে সাবধান করা উচিত? আমি হাসতে হাসতে শেষ।
রাইসু ভাই সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে শফিক ভাইকে ব্যাপারটা জানালেন। যথারীতি শফিক ভাই সে কথাটায় কোনো গুরুত্ব দেননি। না দেয়াটাই ভালো হয়েছে। কিন্তু আমরা যারা যায়যায়দিনে দুই বছর কাজ করলাম তাদের জন্য অমঙ্গলময় দুটো বছর গেছে নিশ্চয়ই। প্রতিটি মাসের বেতন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
কেউ এমন একটা মাসের কথা বলতে পারলে কৃতার্থ হবো যে, ওই মাসের বেতন হওয়া নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা ছিল না। ঈদের বন্ধের ছুটিতে ১০৪ জনের চাকরি যাওয়ার পর, ঈদের বন্ধগুলো ছিল বিভীষিকার মতো। আমরা ভাবতাম, এইবার এই ছুটিতেই পত্রিকা বন্ধ হবে। অথবা বড় ধরনের চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটবে। অথবা শফিক ভাই পদত্যাগ করে লন্ডনে পাড়ি জমাবেন।
অঘটন অনেক ঘটেছে। একের পর এক। একজন এসেছে। আবার চলে গেছে। শফিক ভাইকে দেখেছি সংকট ঘনায়ে এলেই লিখতে বসেছেন।
দীর্ঘ দীর্ঘ লেখা তৈরি করতেন। শফিক ভাই প্রতিদিনই গাদাগাদা লেখা লিখতেন। প্রচুর অনুবাদ করতেন। লেখা এডিট করতেন এবং নিজের হাতে ভাল প্রুফ দেখতেন। এত সক্রিয় এত প্রোঅ্যাকটিভ সাংবাদিক বাংলাদেশে আর একজন দুইজন আছেন কি না সন্দেহ।
প্রতিদিন সকাল বেলা ব্যাগ ভরে বাইরের পত্রিকার কাটিং এনে তিনি সহকর্মীদের টেবিলে টেবিলে গিয়ে বিতরণ করতেন। আলাপ করতেন। তার রুমে যাওয়ার প্রবেশাধিকার অবারিত ছিল। মতাদর্শিক ব্যাপারে তিনি কট্টরপন্থী ছিলেন না। বিএনপিকে সমর্থন করলেও মনেপ্রাণে আবহমান বাঙালি চেতনায় বিশ্বাস করতেন।
বলতেন, আমার আর প্রগতিশীল হওয়ার দরকার নেই। আমি জন্ম থেকেই প্রগতিশীল। শফিক ভাইয়ের লেখা আমি পছন্দ করি কলেজ জীবন থেকে। সহজ ভাষায়, প্রচুর তথ্য-উপাত্ত ঘটনা দিয়ে গল্পের আকারে রাজনৈতিক কলাম লেখার একটা দারুণ কৌশল রপ্ত তার। হিউমার আর উইটে পরিপূর্ণ।
এ রকম করে কেউ কেউ কলাম লেখার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত পারেননি। তার গদ্য কনভিন্সিং। পড়লে একমত হতে ইচ্ছা করে।
ভাল কলামিস্ট, ভাল সাংবাদিক অবশ্যই তিনি। কিন্তু চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হওয়া সত্ত্বেও মানেজমেন্টে তিনি ভয়ানকভাবে ব্যর্থ।
দেশ-বিদেশের অনেক কিছু জানলেও ভাল প্রতিষ্ঠান গড়ার শর্তগুলো তিনি জানেন না। সফল সাপ্তাহিক চালালেও ভাল দৈনিক কিভাবে গড়ে ওঠে সে খবর তিনি নেননি। কিন্তু ওভার কনফিডেন্ট ছিলেন যে তিনি সফল হবেন। না, তিনি সফল হননি। শফিক ভাইয়ের সাফল্য থেকে যেমন আমাদের শেখার আছে।
তার ব্যর্থতা থেকেও তেমনি শেখার আছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।