আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার জীবনের চন্দ্রবিন্দুহীন বছরগুলো : দি যায়যায়দিন ইয়ারস (পার্ট টু)

সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com

শফিক ভাই মাঝে মাঝে খুব ক্ষেপে যেতেন। কোনো বানান ভুল হলে, কোনো নিউজ নিয়ে সমস্যা হলে রেগে অফিসজুড়ে হনহন করে হেঁটে বেড়াতেন। তোমরা কিচ্ছু জানো না। তোমরা কিচ্ছু জানো না বলে হেঁকে উঠতেন।

কারো টেবিল নোংরা দেখলে আগে উনি ছোট একটা নোটিশ ঝুলিয়ে দিতেন। আমার পাশের টেবিলের এরকম বেহাল দশা হয়েছিল। রাতে তিনি লিখে গিয়েছিলেন, তোমার স্থান ডাস্টবিনে হওয়া উচিত। কে যেন নোটিশটা তুলে আমার টেবিলে লাগিয়ে গিয়েছিল। পরদিন সকালে শফিক ভাই এসে বললেন, দেখেছো? আমি বললাম, আমার টেবিল তো গোছানো।

উনি বললেন, তাতে কি পাশের টেবিল নোংরা থাকলে তোমার উচিত সেটা গুছিয়ে রাখা। শোনো তোমাদের ভাগ্য যে, তোমরা আমার সাথে এরকম একটা অফিসে কাজ করতে পারছো। টাইমের সম্পাদক এসে বলে গেছে, এরকম অফিস সে দেখেনি। তোমাদের উচিত আমার কাছ থেকে শেখা। মাঝে মাঝেই অফিস নিয়ে তিনি গর্ব করতেন।

পার্ক, ডরমেটরি, সিনেমা হল, ক্যাফে নিয়ে তার গর্বের অন্ত ছিল না। নিয়ম করে আমাদের সেটা শুনতে হতো। যখন তিন মাসের বেতন বকেয়া পড়ে আছে তখনও শুনতে হতো। যখন উৎসবভাতা বন্ধ হয়ে গেছে তখনো শুনতে হতো। এ কথা ঠিক যে, সব সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে অফিসটা খুব সুন্দর বানিয়েছেন তিনি।

নিজের টাকায় বানান নাই, তাতে কী? অন্যের টাকা দিয়ে এরকম অফিসও বা কয়জনে বানিয়েছে? ভাবতে অবাক লাগে এত বড় অফিস বানিয়েছিলেন তিনি কিন্তু অফিসে উৎপন্ন হওয়া মশা মারার স্প্রে কেনার ব্যবস্থা করতে পারতেন না। কারণ ইনভেস্টররা মশা মারার টাকা দিতে চাইতেন না। মশার অত্যাচারে যখন একেবারে কাহিল দশা তখন আমাদের এক কলিগ প্রতিবাদ হিসেবে কয়েল জ্বালিয়েছিলেন। সেই কয়েল নেবাতে এসে কিচেন কেবিনেটের পুরনো এক সদস্য সেই কলিগের সঙ্গে বাজে আচরণ করলে আমি চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছিলাম। পরে শফিক ভাই এসে সেই চেঁচামেচি থামিয়েছিলেন।

এ ঘটনার কয়েক মাস পর সেই কলিগকে স্যাক করা হয়। অনেকেই বলেছিলেন, কয়েল জ্বালানোর জন্য তার চাকরি চলে গেছে। অবশ্য অনেকে বলেন, সহকর্মীর সঙ্গে প্রেম ও বিয়ের কারণেই তার চাকরি যায়। ইংল্যান্ডের সংবিধানের মতোই শফিক ভাইয়ের সংবিধান অলিখিত। সেই সংবিধান মোতাবেক কলিগদের মধ্যে প্রেম জনিত বিয়ে নিষিদ্ধ।

লাভ রোডের বিখ্যাত লাভার ম্যানের অফিসের এই অবস্থা। ভাবতেই অবাক লাগে। যতোই ভালোবাসা সংখ্যার সেক্সি গল্প ছাপুন, আর সঠিক বানানে ইংরেজি লিখুন, এইসব ব্যাপারে শফিক ভাইয়ের রক্ষণশীলতা ছিল অতুলনীয়। সেক্সি গল্প ছাপা হতো স্রেফ বিক্রির জন্য। পসার বাড়াতে।

বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমানের যৌনজীবন নিয়ে গবেষণা করতে যায়যায়দিনে বিশেষ সংখ্যাগুলো হাতে থাকা উচিত। একেকটা সংখ্যায় গল্প আসতো হাজার হাজার। অধিকাংশই প্রেম, যৌনতা, অবৈধ সম্পর্কের। শফিক রেহমান তো এইভাবে লিখতে বলতেন না। তারপরও এরকম হাজার গল্প আসতো।

গল্প লেখকরা এইটুকু জানতেন যে, এগুলো ছাপা হতে পারে। ব্যস। শফিক রেহমানকে দোষ দিয়ে কী লাভ। যৌবনজ্বাল তো শফিক ভাই চালান না। এইটা কারা টপ রেটেড সাইট বানায়া রাখছে? এখানে জানিয়ে রাখি, শফিক ভাই দৈনিকটাকে পারিবারিক পত্রিকা বানাতে চেয়েছিলেন।

ফলে, সেক্সি গল্প ছাপতে নিষেধ করতেন। আমি বহু গল্প ছেপেছি। চুমোটুমো কেটে দিয়ে। শফিক ভাইয়ের গর্বের মিডিয়াপ্লেক্সকে তার বাল্যবন্ধু আবদুল গাফফার চৌধুরী নাম দিয়েছিলেন শাদ্দাদের বেহেশত। আমরা এই দুজনকে শত্রু ভাবতেই অভ্যস্ত।

কিন্তু গত বছর মি. চৌধুরী দেশে এসে যায়যায়দিনে এলে দেখা গেল, এইসব বানানো শত্রুতার চেয়ে তাদের বন্ধুত্ব অনেক মধুর। শফিক ভাই বললেন, গাফফারের বিরুদ্ধে লেখা আমার একটা লাইনও কেউ খুঁজে দেখাতে পারবে না। যায়যায়দিনে অনেক কথা লেখা হয়েছে, কিন্তু সে লেখাগুলোর একটাও শফিক ভাই লেখেন নি। গাফফার চৌধুরীকে শফিক ভাই অনেক বড় কলামিস্ট মনে করেন। আর উনিও শফিক ভাইকে অনেক বড় সম্পাদক মনে করেন এইটাই সেদিন দুজনের কথায় মনে হয়েছিল।

গাফফার চৌধুরীকে ধরে ধরে সেদিন তিনি পুরো মিডিয়াপ্লেক্স ঘুরিয়েছিলেন। যে কেউ এলেই ঘোরাতেন। সব দেখাতেন। এমনকি টয়লেটও। সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন টয়লেটের দিকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।

মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে যেতাম যে, অন্যের টাকায় গড়া এই ভবন নিয়ে তার এত গর্ব স্বাভাবিক কি না। বহু ভেবে যায়যায়দিন প্রজেক্ট সম্পর্কে একটা কথাই আমার মনে আসে। ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট। ভবন, প্রেস, ডেকোরেশনের সব টাকাই বসুন্ধরা দিয়েছে। সাংবাদিকদের বসিয়ে দুইবছর বেতন দিয়েছে।

পত্রিকা চালুর পর সব খরচ জুগিয়েছে। সাতটা ম্যাগাজিন বের করার বিপুল ব্যয় নির্বাহ করেছে। অথচ কোথাও তাদের কোনো নাম নেই, ক্রেডিট নেই। শুধু কিছু বিজ্ঞাপন ছাপা হতো। প্রিন্টার্স লাইনে তাদের নাম নেই।

তারা প্রকাশক না। অথচ সবাই ভাবতো তারা দিনের পর দিন বেতন-ভাতা দিয়ে যাবে। কী অবাক এক চুক্তি? এর চেয়ে রহস্যময় ডিল বাংলাদেশের ব্যবসা জগতে আর হয়েছে কি না জানা যায় না। ফলে, বিপদে পড়ে বসুন্ধরা যখন যায়যায়দিন ছেড়ে দিল। যায়যায়দিনও বসুন্ধরাকে ছেড়ে দিল তখন কেউ অবাক হননি।

এটা ঘটার ছিল। আর রহস্যময় এই ডিলে গড়া মিডিয়াপ্লেক্সও যে শফিক ভাই রাখতে পারবেন না এটাও জানা ছিল। শুধু ঘটনা ঘটার অপেক্ষা। ভিতরে আমরা যারা কাজ করতাম তাদের জন্য এটা ছিল অসহনীয় এক পরীক্ষা। শফিক ভাই বাংলাদেশের সংবাদজগতের উজ্জ্বলত ১০৪ জন সাংবাদিককে বরখাস্ত করেছিলেন সংবাদপত্র জগতের এক সংকটময় সময়ে।

নতুন কোনো ইনভেস্টমেন্ট বা উদ্যোগ আসার সম্ভাবনা তখন ছিল না। ফলে, এই সাংবাদিকরা তাদের অতীতের উজ্জ্বল ক্যারিয়ার নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন। শফিক ভাইয়ের এই কীর্তি সব সাংবাদিককে কোনো না কোনো ভাবে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু শফিক ভাইয়ের কাছে, এটা স্রেফ ছেলেখেলার মতো বিষয় ছিল। তার অভিব্যক্তিতে কখনো এর জন্য অপরাধবোধ দেখা যায়নি।

যাদেরকে তিনি বড় অফার দিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে ডেকে এনেছেন তাদেরকে এক রাতের নোটিশে চাকরিচ্যুত করে বৃটেন পাড়ি জমানোর উদ্যোগ কেমন? লোকে বিষয়টিকে কোনোদিনই ভালভাবে নেয়নি। ওই রাতে শফিক ভাই চূড়ান্ত অপদস্ত হয়েছিলেন। হিরো থেকে জিরোতে পরিণত হয়েছিলেন। জিরোতে পরিণত হওয়ার বোধটা তাকেও আচ্ছন্ন করেছিল। পরের দেড় বছর একবারের জন্য বিদেশ না গিয়ে অনেক অসুবিধার মধ্যেও তিনি যায়যায়দিনে পড়ে ছিলেন শুধু জিরো থেকে পয়েন্ট জোগাড় করে উপরে উঠতে।

কিছু পয়েন্ট জোগাড় করতে পেরেছেন বলেই এখন মনে হচ্ছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.