আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সৈয়দ আমিরুজ্জামানের প্রবন্ধ 'জাতীয় শিশুশ্রম নীতি'



সৈয়দ আমিরুজ্জামানের 'জাতীয় শিশুশ্রম নীতি ২০০৮ প্রসঙ্গে' শীর্ষক বিশাল প্রবন্ধটি গত দুইদিন অর্থাৎ ২১ ও ২২ শে এপ্রিল ২০০৮ ইং দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটি পড়ে খুবই ভালো লেখেছে। অবশ্য এর আগে এই ব্লগেও তাঁর এই লেখাটির পড়ার সুযোগ হয়। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, চমৎকার এই লেখাটির ব্যাপারে ব্লগারদের কোনো মন্তব্য নেই। অথচ সৈয়দ আমিরুজ্জামান চমৎকার করে লিখেছেন, "যেখানে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭(ক) ধারায় সকল শিশুর জন্য গণমূখী ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা বা বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে, সেখানে জাতীয় শিশুশ্রম নীতি প্রণয়ন করা কতটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে? এ ব্যাপারে তো প্রশ্ন থেকেই যায়।

সরকারের উচিত ছিল আমাদের দেশের সংবিধানের আলোকে ’জাতীয় শিশুনীতি ২০০৮’ প্রণয়ন করা। তবুও বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য জাতীয় শিশুশ্রম নীতি ২০০৮-এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকসহ বিস্তারিত আলোচনা ও সরকারের বক্তব্যের সাথে সমন্বয় সাধন করে বিকল্প প্রস্তাবনা এবং সুপারিশমালা উপস্থাপন করছি। বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কৌশল প্রধানতঃ সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল এবং সাম্রাজ্যবাদ তথা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই উন্নয়ন কৌশল দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের জন্যে মডেল হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই। আমাদের দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন একদিকে শিল্প বিকাশ ও অপরদিকে ভূমি সংস্কার ও কৃষির গণতান্ত্রিক সংস্কার।

দেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থে ও প্রয়োজনে গোটা সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আমূল পরিবর্তন করা সম্ভব হলে আজকের যে শিশু-কিশোর তাঁরাই হতে পারতো আগামী দিনে গণমূখী উন্নয়ন কৌশলের মূল চালিকাশক্তি। প্রশাসনে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে ও সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি, অস্থিরতা, অব্যবস্থাপনা, অদতা, বিশৃঙ্খলা, অনুন্নয়ন, শোষণ-লুণ্ঠন ও দুঃশাসনের কারণে তাঁদেরকে উপযোগী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ ইতিবাচক ও আশাপ্রদ নয়। সরকারের কর্তাব্যাক্তিরা দাবী করেন যে, স্বাধীনতার পর পরই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে প্রবর্তন করা হয়েছে শিশু আইন ১৯৭৪। পরবর্তীতে প্রণয়ন করা হয়েছে জাতীয় শিশু নীতি ১৯৯৪ এবং গ্রহণ করা হয়েছে শিশুদের জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০০৫-২০১০ সহ বহুবিধ উন্নয়ন প্রকল্প। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার শিশু বিষয়ক অধিকাংশ সনদ অনুসমর্থনসহ শিশু অধিকার সংক্রান্ত বহু আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও দ্বি-পাকি ঘোষণায় বাংলাদেশ অংশীদার বলে দাবী করা হয়।

কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রশ্ন থেকে যায় যে, বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের উল্যেখযোগ্য অংশ এখনও ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত কেন? কৃষিসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক খাতে শিশুদের শ্রমে নিয়োগের হার আশংকাজনক। একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে শিশুশ্রম সংক্রান্ত পরিসংখ্যান নিশ্চয়ই অনভিপ্রেত। প্রতিনিয়ত বিশ্বব্যাপী জ্ঞান-বিজ্ঞানের উত্তরোত্তর বিকাশ, প্রযুক্তিগত নতুন নতুন উদ্‌ভাবন ও বিকাশ এবং জাতীয়স্বার্থে সামগ্রিক উন্নয়ন, শিল্প বিকাশ ও ভূমি সংস্কার এবং কৃষির গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের নিমিত্ত্বে জনকল্যাণকর রাষ্ট্র ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা সামাজিক জীবনে দ্রুত আমূল পরিবর্তনের তাগিদ দিচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে নিত্য-নতুন মানবিক মূল্যবোধের। এ পরিবর্তনের জন্য পুরাতন আইনের সংস্কারের পাশাপাশি প্রণয়ন করতে হবে নতুন নতুন গণমূখী নীতিমালা ও বিধি-বিধান। সমাজ পরিবর্তনের Ëেত্র অবশ্যই সমাজের গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধগুলোকে বিকশিত করতে হবে।

জনগণের স্বার্থে পরিবর্তনের ঐতিহাসিক প্রয়োজনে সৃষ্ট মানবিক মূল্যবোধগুলোকেও যেন টেকসই করা যায়, তার জন্যে চাই একটি সামাজিক ঐকমত্যের সংগ্রাম। এই সামাজিক ঐকমত্য তথা এই গণমূখী নীতিমালার ভিত্তিতেই মূলতঃ আবর্তিত হতে থাকবে সমাজ পরিবর্তনের রীতি-নীতিগুলো। বাংলাদেশের শিশুশ্রম পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্যে একটি গণমূখী নীতিমালার প্রয়োজনীয়তার কথা বাম প্রগতিশীলদের নেতৃত্বে আপামর জনসাধারণ দীর্ঘদিন যাবৎ সংগ্রাম করে আসছিলেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জীবন, সমাজ-সংস্কৃতি এবং সাম্প্র্রতিককালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনসমূহের আলোকে শিশুশ্রম পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বলা হলেও ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ গণ মানুষের স্বার্থে প্রয়োজনীয় উপাদান এ নীতিমালায় সন্নিবেশ করা হয়েছে কি? শিশু এবং শিশুশ্রম সংক্রান্ত দেশে প্রচলিত আইন ও বিধি-বিধানগুলো গণমূখী করা হয়েছে কি? নীতিমালাকে পর্যায়ক্রমে সমন্বিতভাবে গণমূখী করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি? এবং ভবিষ্যতে সরকারি ও বেসরকারি খাতে শিশু এবং শিশুশ্রম সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধান প্রণয়নকালে কার স্বার্থ দেখা হবে? জাতীয় শিশুশ্রম নীতি ২০০৮ যে ঘোষিত হলো, তাতে জনগণের প্রত্যাশায় নীতি-নির্ধারক ও পথপ্রদর্শকরা কতটুকু গুরুত্বারোপ করেছেন? সরকার কর্তৃক ঘোষিত নীতিমালায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ জনস্বার্থের প্রতিফলন কি আছে? বাংলাদেশের শিশুশ্রম পরিস্থিতিঃ সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর আমলা মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া শ্রেণীস্বার্থের শোষণ-লুণ্ঠনমূলক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির কারণে স্বাধীনতার পর বিগত ৩৭ বছরে দেশের অর্জন, অগ্রগতি, উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, জনগণের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, ভূমি সংস্কারসহ কৃষির গণতান্ত্রিক সংস্কার, শিল্পায়ন ও সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়েছে পদে পদে। ফলে বাংলাদেশের শিশুশ্রম পরিস্থিতিও নাজুক।

যে বয়সে একটি শিশুর বই, খাতা পেন্সিল নিয়ে স্কুলে আসাযৈাওয়া, আনন্দচিত্তে সহপাঠীদের সাথে খেলাধুলা করার কথা, সেই বয়সে ঐ শিশুকে নেমে পড়তে বাধ্য হয় জীবিকার সন্ধানে। অনুন্নয়ন, শোষণ-লুণ্ঠন ও দুঃশাসনের কারণে সৃষ্ট দারিদ্র্যের কষাঘাতে একজন পিতা যখন তার পরিবারের ভরণপোষণে ব্যর্থ হয় তখন ঐ পিতার প েতার সন্তানদের পারিবারিক বন্ধনে আর আবদ্ধ রাখা সম্ভব হয় না। আর এভাবে একটি শিশু একবার পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হবার পর সে বাধ্য হয়ে হারিয়ে যায় বিপর্যস্থ হয়। পরিস্থিতির শিকার হয়ে এদের কেউ অপরিণত বয়সে তখন হোটেল-রেস্টুরেন্টে, কেউ ফ্যাক্টরি-ওয়ার্কশপে, কেউবা বাসা-বাড়ির কাজে যুক্ত হতে বাধ্য হয়। কোন কাজ না পেয়ে কেউ আবার ‘টোকাই’ এ পরিণত হয়েছে।

তাও তো এক বাধ্যবাধকতা আর কি। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এ সকল শিশুরা ভালমন্দ কাজ পাক্‌ আর নাই পাক্‌, সকল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সুযোগ-সুবিধা আর সাংবিধানিক মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের অভাবে এদের মানসিক সুকুমার বৃত্তিগুলো আর প্রস্ফুটিত হয় না। পরবর্তী যুগ যুগান্তরের জন্যে এরা কেবল অতল গহবরে তলিয়ে যেতেই থাকে। বাংলাদেশে শিশুশ্রমের আর একটি অমানবিক দিক হলো, কর্মের প্রলোভন দেখিয়ে এক শ্রেণীর চিহ্নিত প্রতারক একটি শিশুকে ঘর থেকে বের করে গ্রাম থেকে শহরে এবং অবশেষে শহর থেকে বিদেশে পাচার করে। এভাবে পাচার হওয়া মেয়ে শিশুদেরকে পতিতাবৃত্তি ও পর্ণোগ্রাফী এবং ছেলে শিশুদের বিভিন্ন অসামাজিক ও অমর্যাদাকর কাজে ব্যবহার করা হয়।

দ্বিতীয় জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০০৩ অনুসারে বাংলাদেশে ৫-১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৪২·৩৯ মিলিয়ন অর্থাৎ ৪ কোটি ২৯ ল ৯০ হাজার। এর মধ্যে ৩·১৮ মিলিয়ন অর্থাৎ ৩১ ল ৮০ হাজার শিশু শিশুশ্রমে নিয়োজিত হতে বাধ্য হয়। সামগ্রিকভাবে শ্রমজীবী শিশুদের মধ্যে কৃষিকাজে ৫২·৭ শতাংশ অর্থাৎ ১৬ ল ৭৫ হাজার ৮৬০ জন, শিল্প উৎপাদন কর্মে ১৪·৬ শতাংশ অর্থাৎ ৪ ল ৬৪ হাজার ২৮০ জন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ১৪·২ শতাংশ অর্থাৎ ৪ ল ৫১ হাজার ৫৬০ জন, চা বাগানসমূহে ১·৫৭ শতাংশ অর্থাৎ ৫০ হাজার জন এবং বাকী প্রায় ১৭·৪২ শতাংশ অর্থাৎ ৫ ল ৫৩ হাজার ৯৫৬ জন অন্যান্য পেশায় কর্মরত রয়েছে। কর্মরত শিশুদের মধ্যে ১·৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ৪১ হাজার ৩৪০ জন শিশু নিয়োজিত আছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। শিশুশ্রমের কারণঃ বাংলাদেশে শিশুশ্রমের প্রধান ও প্রথম কারণটি হচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় তীব্র শোষণ-লুণ্ঠনমূলক ব্যবস্থা।

তীব্র শোষণ-লুণ্ঠনমূলক ব্যবস্থাপনার কারণেই আর্থিকভাবে কোন পরিবার যখন সচ্ছল থাকে না তখন তাদের প েপরিবারের ভরন-পোষণ মিটিয়ে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগান দেয়া আর সম্ভব হয় না। ফলে তাদেরকে স্কুলে পাঠাতে অভিভাবকদের আগ্রহ থাকলেও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এ পরিস্থিতিতে, পিতার পেশায় বা অন্য কোন পেশায় সন্তান যুক্ত হতে বাধ্য হলে পিতামাতারাও সুবিধাজনক মনে করেন। স্কুলে না যেতে পারা বা স্কুল থেকে ছিট্‌কে পড়া কোন শিশু ক’দিন ইতি-উতি ও এদিক সেদিক বিচরণ করার পর কোন পারিবারিক আর্থিক দুরবস্থার কারণে কাজে যোগ দিতে বাধ্য হলে এবং এ কাজ থেকে নিম্ন মজুরীতে যখন কোন সামান্য অর্থ প্রাপ্তি হয় তখন ঐ সামান্য কিছু নগদ অর্থের আশায় তার প েআর বিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। শিশুদেরকে ঠকিয়ে স্বল্প মজুরীতে দীর্ঘণ কাজে খাটানো হয়।

নিয়োগকারী মালিক, ম্যানেজারেরা ও কর্তৃপও শিশুদেরকে সহজেই ঠকানো যায় বলেই কাজে নিয়োগে বিশেষ উৎসাহী থাকে। বাংলাদেশের সামাজিক বৈষম্য-শোষণ ও লুণ্ঠণমূলক ব্যবস্থাও শিশুশ্রমের অন্যতম একটি কারণ। আমাদের সমাজে পরিবারের প্রধান তথা পিতার মৃত্যু ঘটলে তবে ঐ পরিবারের সদস্যদের লেখাপড়া তো দূরের কথা, ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করাই দায় হয়ে পড়ে। পারিবারিক ভাঙ্গন ও বিচ্ছিন্নতায় পিতা-মাতা এক এক জন যখন এক এক দিকে ছিট্‌কে পড়ে তখন তাদের সন্তানদের খবর আর কেউ রাখে না। গ্রামে কাজের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি না করা, সামাজিক অনিশ্চয়তা, মৌলিক চাহিদা পূরণের পরিকল্পিত ব্যবস্থার অভাব ইত্যাদি কারণে গ্রাম থেকে মানুষ শহরমুখী অভিবাসন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

নদী ভাঙ্গন, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্পের মত প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে অহরহ। এ জাতীয় প্রতিটি বিপর্যয় আর প্রাকৃতিক দুর্ঘটনাসহ অর্থনীতিতে ও সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি, অনুন্নয়ন, শোষণ-লুণ্ঠন ব্যবস্থার কারণেই প্রতিনিয়ত শিশুদের ঠেলে দিচ্ছে কায়িক শ্রমের দিকে। আমাদের সংস্কৃতি ও কৃষ্টিও বহুলাংশে শিশুশ্রমের অনুকুলে। বিপুল সংখ্যক শিতি যুবক-যুবতীর বেকারত্ব বা কর্মসংস্থানের অভাব, পিতামাতার স্বল্প শিা এবং অদূরদর্শিতার কারণে তারা শিাকে একটি অলাভজনক কর্মকাণ্ড মনে করে। সন্তানদের ১০/১৫ বৎসর ধরে লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাওয়ার ধৈর্যø আর সামর্থø তখন তাদের থাকে না।

শিা উপকরণ ও সুযোগের অভাব এবং শিশুশ্রমের কুফল সম্পর্কে অভিভাবকদের অসচেতনতা ও উদাসীনতাও শিশুশ্রমের পথকে সুগম করে দিচ্ছে। শহর জীবনে গৃহস্থালির কাজে কাজের লোকের উপর অতি মাত্রায় নির্ভরশীলতার গতানুগতিক সংস্কৃতির কারণে গ্রামে লেখা পড়ায় মগ্ন শিশুটিকেও নিয়ে আসা হয় শহরে বাসার কাজের জন্যে। শিশুশ্রম- সাংবিধানিক ও আইনগত অবস্থানঃ বাংলাদেশের সংবিধানে শিশুসহ সকল মানুষের মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯ এবং ২০ অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিাসহ শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগের উপর জোর দেয়া হয়েছে। মৌলিক অধিকার অংশের অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮, ২৯, ৩১, ৩৪, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ এবং ৪১ অনুচ্ছেদএৈ মানুষ হিসাবে সকল ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।

বিশেষতঃ জবরদস্তিমূলক শ্রম পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং অধিকার ুণ্ন হওয়ার Ëেত্র আইনগতভাবে প্রতিকার পাওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর পরই শিশু এবং শিশুর অধিকার সংরণে প্রবর্তিত হয় শিশু আইন ১৯৭৪ (১৯৭৪ সালের ৩৯ নং আইন)। এ আইনের শিরোনাম থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, এ আইনে কেবল শিশুদের সর্ম্পকেই আলোচনা করা হয়েছে। শিশুর সংজ্ঞা, শিশুর বয়স, তার অধিকারের পরিধি, নাবালকত্ব অভিবাবকত্ব শিশুর সম্পদের হেফাজত, দেওয়ানী-ফৌজদারী মামলার Ëেত্র শিশুর রাকবচ, ইত্যাদি বিষয়গুলো ব্যাপক বিস্তৃত পরিমণ্ডলে আলোচিত হয়েছে এ আইনে। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (২০০৬ সনের ৪২ নং আইন)এৈ শিশু ও কিশোর এর সংজ্ঞা ও ৩য় অধ্যায়ের ধারা ৩৪-৪৪ এ কিশোর এবং শিশু নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় উল্লেখ করা আছে।

এ আইনে আনুষ্ঠানিক কর্মËেত্র কোন শিশুর নিয়োগ রহিত করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, সরকার কতৃêক সময় সময় গেজেট বিজ্ঞপ্তির দ্বারা ঝুঁকিপূর্ণ (যধুধৎফড়ঁং) কাজের তালিকা প্রকাশ করবে; যে কাজে শিশুদের নিয়োগ দেয়া চলবে না। যদিও কতিপয় Ëেত্র চিকিৎসক কতৃêক প্রত্যয়নকৃত হলে শিশু বা কিশোরকে নির্দিষ্ট সময়ঘন্টার জন্য শর্তাধীনে নির্ধারিত হালকা কাজ দেয়া যেতে পারে। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ (২০০৪ সনের ২৯ নং আইন) শিশু ও শিশু অধিকার অর্জনের আর একটি সফল রাকবচ। এ আইনে শিশুর জন্ম নিবন্ধনের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করে দেয়ায় বয়স জটিলতার বেড়াজালে শিশুকে জড়িয়ে ফেলার এখন আর কোন সুযোগ নেই।

শিশু নীতি ১৯৯৪ শিশু ও শিশু অধিকার অর্জন ও সংরণের আর একটি মাইল ফলক। এ নীতিমালায়ও শিশুর সংজ্ঞা, শিশুর বয়স, তার অধিকারের পরিধি, নাবালকত্ব অভিবাবকত্ব শিশুর সম্পদের হেফাজত, দেওয়ানী-ফৌজদারী মামলার Ëেত্র শিশুর রাকবচ, ইত্যাদি বিষয়গুলো ব্যাপক বিস্তৃত পরিমণ্ডলে আলোচিত হয়েছে। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও শিশুশ্রম নিরসনে বাংলাদেশের উদ্যোগ ও প্রয়াস সর্বজনস্বীকৃত। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (টঘঈজঈ), আইএলও কনভেনশন ১৮২-সহ শ্রম সংক্রান্ত তেত্রিশটি কনভেনশন বাংলাদেশ সরকার অনুসমর্থন করেছে। যদিও শিশুশ্রম নিরসনের Ëেত্র সরকারের প্রচেষ্টা প্রশংসিত নয়।

জাতীয় শিশু নীতির ল্যসমূহঃ আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে হলে প্রতিটি শিশু-কিশোরকে শিার অধিকার ও সুযোগ দিতেই হবে। আর তাই বাংলাদেশে শিশুশ্রম প্রতিরোধ ও নিরসন করার কার্যকর কৌশলগত কাঠামো নির্ধারণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে কর্মরত শিশুদের জন্য শিার অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ (যধুধৎফড়ঁং) এবং নিকৃষ্ট ধরণের (ড়িৎংঃ ভড়ৎস) শিশুশ্রম নির্মূল করার নিমিত্ত সময়ভিত্তিক স্বল্পমেয়াদি পদপে গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ হতে চূড়ান্তভাবে সকল শ্রেণীর শিশুশ্রম নিরসনকল্পে দীর্ঘমেয়াদি পদপে গ্রহণ করতে হবে। শিশুশ্রমের সংজ্ঞা ও বয়সঃ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দলিলে, এমন কি বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনী দলিলেও ‘শিশু’, ‘কিশোর’এর সংজ্ঞা এক এক দলিলে এক এক ভাবে বর্ণিত আছে।

শিশু-কিশোরদের সংজ্ঞা নির্ধারণে বয়সের বিষয়টিই মুখ্য বিধায় সরকারি দলিলে শিশু-কিশোরদের একটি অভিন্ন বয়স নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশের শিশুদের সাথে উন্নত দেশের শিশুদের শারীরিক ও মানসিক গঠন এবং শিশুদের শিার অধিকার ও সুযোগসহ বহুমাত্রিক অধিকারকে নিশ্চিত করার দায়িত্ব ও শর্ত যুক্ত করে সকল দলিল ভেদে বাংলাদেশের শিশুদের অভিন্ন বয়স নির্ধারণ বর্তমান যুগের মানবিক ও গণতান্ত্রিক দাবী। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (২০০৬ সনের ৪২ নং আইন)-এ ‘শিশু’ ও ‘কিশোর’এর সংজ্ঞাও বয়সভিত্তিক। এ আইনের ২(৮) নং ধারায় ‘চৌদ্দ বৎসর বয়স পূর্ণ করিয়াছে কিন্তু আঠার বৎসর বয়স পূর্ণ করেন নাই’ এমন কোন ব্যক্তি “কিশোর” এবং ২(৬৩) নং ধারায় ‘চৌদ্দ বৎসর বয়স পূর্ণ করেন নাই’ এমন কোন ব্যক্তিকে “শিশু” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। তবে “শিশুশ্রম” বা “শিশুশ্রমিক” এর কোন সংজ্ঞা সরকারি-বেসরকারি কোন দলিলে পরিলতি হয় না।

এমতাবস্থায়, শিশুশ্রম সংক্রান্ত যাবতীয় আলোচনায় ‘শিশু’ ও ‘কিশোর’ এর সংজ্ঞা নির্ধারণের Ëেত্র বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (২০০৬ সনের ৪২ নং আইন)এৈ ‘শিশু’ ও ‘কিশোর’এর বয়সভিত্তিক সংজ্ঞাটিও গ্রহণযোগ্য নয়। এ সংজ্ঞা অনুযায়ী কোন শিশু দ্বারা সম্পাদিত শ্রম ‘শিশুশ্রম’ হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে “শিশুশ্রমিক” বলে কোন ব্যক্তি-শ্রমিক এর অস্তিত্ব থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। শ্রমে নিয়োজিত শিশুর বিশেষণ হিসেবে “শিশুশ্রমিক” এর স্থলে ‘শ্রমে নিয়োজিত শিশু’ বা ‘শ্রমজীবী শিশু’ ইত্যাদি বাক্য বা বাক্যসমূহ ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। শিশুশ্রমের শ্রেণীবিভাগঃ প্রধানতঃ দু’টি সেক্টরে বাংলাদেশে শিশুশ্রম বিরাজমানঃ ১· আনুষ্ঠানিক সেক্টর যেমন চা বাগানসহ শিল্প-কারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা।

২· অনানুষ্ঠানিক সেক্টর যেমন কৃষি, পশুপালন, গৃহকর্ম, নির্মাণকর্ম, ইটভাঙ্গা, রিকশাভ্যান, যৌনকর্ম, ইত্যাদি। বিদ্যমান আইনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বা কর্মে শিশুরা সাধারণতঃ ছয় (৬) ভাবে নিয়োজিত থাকে, যেমন প্রশিণার্থী, বদলী, নৈমিত্তিক, শিানবিশ, সাময়িক এবং স্থায়ী কর্মী। শিশুশ্রম বিনিময় মজুরি ও কর্মঘন্টাঃ বাংলাদেশের প্রচলিত শ্রম আইনে প্রায় নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবিক অর্থে অন্যায়ভাবে অল্প মজুরিতে অধিক কর্মঘন্টায় নিযুক্ত করা হয়। অল্প মজুরিতে অধিক কর্মঘন্টায় কাজ আদায় করা সম্পূর্ণ অমানবিকও বটে। শিশুদের শ্রমে নিয়োগ করা মালিকদের জন্য সব সময়ই অধিক লাভজনক।

এ ধরনের ব্যবস্থা শিশুদের প্রতি চরম অবিচার, অন্যায্য আর জুলুমই তো বলতে হয়। কাজ যদি করাইতে হয় সেËেত্র আমার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা হচ্ছে, শিার অধিকার ও সুযোগসহ বহুমাত্রিক অধিকারকে নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালন ও শর্ত যুক্ত করে শিশু-কিশোরদের জন্য বয়স্কদের সমান নিম্নতম মজুরি সংক্রান্ত বিধান প্রণয়ন করতে হবে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, শিশু-কিশোরদের নিম্নতম মজুরি সংক্রান্ত কোন বিধান আমাদের দেশে নেই। ফলে অধিকাংশ Ëেত্রই কোন মজুরি ছাড়া পেটেভাতে বা স্বল্পতম শ্রমবিনিময় মজুরি নিয়েই শিশু বা কিশোরদের সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হয়। এ অবস্থার নিরসনকল্পে শিশু ও কিশোদের নিম্নতম শ্রম বিনিময় মজুরি আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক উভয় সেক্টরেই নির্ধারণ করার প্রয়াশ সরকারকে নিতেই হবে।

শ্রমে নিয়োজিত শিশুর শিা, স্বাস্থ্য (শারীরিক ও মানসিক) ও পুষ্টিঃ শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের জন্য শিা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত যে সমস্ত উদ্যোগ ও কার্যক্রম ইতোমধ্যে সরকার কতৃêক গ্রহণ করা হয়েছে তার বাস্তবায়ন নাই বললেই চলে। জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন তথা ইউনিসেফ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)সহ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সকল সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসমূহের শিা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত বিদ্যমান উদ্যোগসমূহের কার্যকর ও বাস্তবায়নের নিমিত্ত সমন্বিত ফলপ্রসূ উদ্যোগ ও কার্যক্রম গ্রহণ করা আবশ্যক। এ ছাড়াও, শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের শিা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রম অনতিবিলম্বে গ্রহণপূর্বক তা কার্যকর ভাবে বাস্তবায়নের কর্মকৌশল নির্ধারণ করাও প্রয়োজন। শ্রমে নিয়োজিত শিশুর কর্মপরিবেশঃ শিশুদের শ্রমে নিয়োগে ব্যাপক বিধি-নিষেধ থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর বিগত ৩৭ বছরে দেশের অর্জন, অগ্রগতি, উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, জনগণের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, ভূমি সংস্কারসহ কৃষির গণতান্ত্রিক সংস্কার, শিল্পায়ন ও সুশাসন বাধাগ্রস্ত হওয়ার পারিপার্শিòক অবস্থা ও পরিস্থিতির বিপাকে কোন কোন শিশু এক সময় শ্রমে নিয়োজিত হয়ে যায়। এই Ëেত্র শিশুর কর্ম পরিবেশ যেন অনুকুলে থাকে সেদিকে কড়া নজরদারী ও সজাগ দৃষ্টি রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

শ্রমে নিয়োজিত একজন শিশু যদিঃ দৈনিক সর্বোচ্চ তিন কর্মঘন্টার অতিরিক্ত সময় কাজ করে; এমন কাজ করে যা তার শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক অবস্থার উপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করে; নিরাপত্তাহীন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকে; বিনামজুরি, অনিয়মিত মজুরি, স্বল্প মজুরিতে কাজ করে; সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে; শিা জীবনকে ব্যাহত করে; বাধ্য হয়ে কাজ করে; ব্যক্তি মর্যাদাকে হেয় করে দাসের মত কাজ করতে বাধ্য হয়; শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচার এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়; এবং বিশ্রাম বা বিনোদনের কোন সুযোগ না পায়; তাহলে উক্ত পরিবেশ শিশুর জীবন, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং অমর্যাদাকর। শিার অধিকার ও সুযোগসহ বহুমাত্রিক অধিকারকে নিশ্চিত করাসহ উক্ত পরিবেশ থেকে শিশুকে উদ্ধারে সর্বাত্মক আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শ্রমে নিয়োজিত একজন শিশুর কর্মপরিবেশ উন্নয়নের জন্য নিয়োগকারী বা মালিক কতৃêক শিশু এবং শিশুর অভিভাবকের সাথে আলোচনা সাপে েনিম্নবর্ণিত শর্তাবলী প্রতিপালন করতে বাধ্য থাকবেঃ শিশুর সামর্থø অনুযায়ী ঝুঁকি বিহীন কাজঃ শিশুকে আইনের দ্বারা কর্মে নিয়োগের নির্ধারিত বয়স অনুযায়ী কাজে নিযুক্ত করা এবং ১০ বছরের কম বয়সী শিশুকে সার্বণিক কর্মী হিসেবে নিয়োগ না করা; গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুরা সাধারণতঃ সার্বণিক কর্মী হিসেবে নিযুক্ত হয় বিধায় তার লেখা-পড়া, থাকা-খাওয়া, আনন্দ-বিনোদন নিশ্চিত করার পাশাপাশি তার দৈনিক কর্মঘন্টা তিন ঘন্টার মধ্যে সীমিত রাখা এবং তাকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো থেকে বিরত রাখা; শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন না করা। কাজের শর্তঃ বিধিমোতাবেক শিশুদেরকে কাজে নিয়োগের পূর্বে নিয়োগকারী বা মালিকগণ শিশু এবং শিশুর অভিভাবকের সাথে আলোচনা সাপে েকাজের সুস্পষ্ট শর্ত তৈরি করবেন। এ তালিকায় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আইন অনুযায়ী অন্তর্ভুক্ত থাকবে যা সেক্টর অনুযায়ী প্রযোজ্য হবেঃ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ থেকে বিরত থাকা; দৈনিক কর্মতালিকা থাকা; দৈনিক কর্মঘন্টার উল্লেখ; সপ্তাহে কমপ েদেড়দিন সবেতন ছুটির ব্যবস্থা; লেখাপড়া বা শিার অধিকার ও সুযোগসহ বহুমাত্রিক অধিকারকে নিশ্চিত করাসহ দতা বৃদ্ধি বিষয়ক প্রশিণের সুযোগ; নির্দিêষ্ট হারে নিয়মিত বেতন প্রদান; চাকুরিচ্যুতির কমপ েএক মাস পূর্বে অবহিত করা, ইত্যাদি।

কর্মস্থলের পরিবেশঃ কর্মস্থলের পরিবেশ অবশ্যই শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অনুকুল হতে হবে; কর্মস্থলের পরিবেশ কখনই এমন হবে না, যা শিশুকে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হতে বাধ্য করে অথবা উৎসাহিত করে; অমর্যাদাকর বা মানহানিকর কোন কাজে শিশুকে নিয়োগ বা লিপ্ত করা যাবে না। শিা ও বিনোদনঃ যেহেতু শিা ও বিনোদন শিশুর মৌলিক অধিকার, সে কারণে কর্মঘন্টার অর্থাৎ দৈনিক তিন ঘন্টার পর একটি নির্দিষ্ট সময় অর্থাৎ কমপ েএক ঘন্টা হতে দুই ঘন্টা বিরতি দিয়ে যথাযথ শিা ও বিনোদনের সুযোগ ও সুব্যবস্থা রাখা; শিশুরা যে কাজেই নিযুক্ত থাকুক না কেন, কর্মঘন্টা অতিক্রান্ত হওয়ার পর উক্ত শিশুর যথাযথ শিা ও বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি মালিক বা নিয়োগকর্তাগণ নিশ্চিত করতে বাধ্য থাকবেন। চিকিৎসাঃ কর্মকালীন সময়ে শিশু কোন দুর্ঘটনায় পতিত হলে অথবা অসুস্থ হলে মালিক বা নিয়োগকর্তাগণ যথোপযুক্ত চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবেন; অসুস্থতার সময় শিশুদের পরিবারের সাথে নিয়মিত সাাতের বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবারের সাথে সাাতের সুযোগঃ গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের নিয়মিত পিতা-মাতা বা আত্মীয়-স্বজনের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ প্রদান করতে হবে; অন্যান্য কর্মে নিয়োজিত শিশুদের Ëেত্রও প্রতি মাসে কমপ েএকবার পিতা-মাতা বা আত্মীয়-স্বজনের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ প্রদান করতে হবে। শিশুর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার ব্যবস্থাঃ কোন শিশু ক্রমাগত ছয় মাস কাজ করলে সাধ্য অনুযায়ী শিশুর ভবিষ্যত আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে, যেমনঃ বীমা, সঞ্চয়, ইত্যাদি।

শিশুরা সহজেই কারিগরি বিষয় রপ্ত করতে পারে। শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের প্রচলিত আইনের আলোকে উন্নততর প্রযুক্তিগত প্রশিণের ব্যবস্থা করতে হবে যেন আগামী দিনে তারা বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে নিজেদেরকে দ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে; কর্মমেয়াদ শেষে এককালীন আর্থিক সুবিধা প্রদান করা। প্রতিবন্ধী, বিশেষ অসুবিধাগ্রস্ত, পথশিশু, অনগ্রসর ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর শিশুদের জন্য বিশেষ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণঃ শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু, পথশিশু, পরিত্যক্ত অনাথ শিশু এবং বিভিন্ন নৃতাত্তিক গোষ্ঠীর শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই শিশুদের জন্য পৃথক আইন প্রণয়ন ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এই শিশুদের কেউ যদি কোন আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক শ্রমে নিয়োজিত হয় তবে তাদের চাকুরির শর্তাবলী স্বাভাবিক শিশুশ্রমিকের চেয়ে শিথিলতর করা এবং বিশেষ কর্মপরিবেশ সৃষ্টির জন্য ঐসব প্রতিষ্ঠানের মালিক বা নিয়োগকর্তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

শিশুশ্রম নিরসন- বাস্তবভিত্তিক কর্মকৌশল নির্ধারণঃ সকল ধরণের শিশুশ্রম, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে কার্যকর বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যদিও এ সকল উদ্যোগ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, শ্রম পরিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন পরিদপ্তর, সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও মাঠ পর্যায়ের সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে বলে সরকার দাবী করছেন। আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সাথে যৌথ উদ্যোগে শিশুশ্রম নিরসনে যে সকল প্রকল্প গ্রহণ করেছে সেগুলো বাস্তবায়নে সরকার তৎপর রয়েছে বলে সরকার দাবী করছেন। কর্মকৌশল নির্ধারণঃ নীতি বাস্তবায়নে কর্মকৌশলের ত্রে নির্ধারণ, উদ্দেশ্য ও ল্য নির্ধারণ, কার্যক্রম নির্ধারণ, সময়সীমা নির্ধারণ, দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা নির্ধারণ, সহায়তাকারী সংস্থা নির্ধারণ। উপরোক্ত ছয়টি কর্মকৌশলকে বাস্তবে রূপদান করার Ëেত্র নিম্নবর্ণিত পদপেসমূহ বাস্তবায়ন করতে হবেঃ নীতি বাস্তবায়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নঃ সার্বিকভাবে শিশুশ্রম নিরসনের জন্য সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা এবং স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক কার্যক্রম নিশ্চিত করা।

সুপারিশঃ ২০১০ সালের মধ্যে কার্যকর কর্মকৌশল নির্ধারণপূর্বক নিকৃষ্ট ধরণের শিশুশ্রম (ড়িৎংঃ ভড়ৎস) নির্মূল করতে হবে। শিাঃ শ্রমে নিয়োজিত হতে পারে এমন শিশুদের বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিার ব্যবস্থা করা এবং শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের জন্য শিার অধিকার ও সুযোগসহ বহুমাত্রিক অধিকারকে নিশ্চিত করার প্রয়োজনে আনুষ্ঠানিক বা উপানুষ্ঠানিক শিাসহ বাস্তবভিত্তিক শিা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা। সুপারিশঃ ২০১২ সালের মধ্যে শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের জন্য অবৈতনিক, বাধ্যতামূলক ও মানসম্পন্ন শিা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য ও পুষ্টিঃ শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সংরণের নিমিত্ত জাতীয় স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নীতির আওতায় তাদের গৃহে ও কর্মস্থলে পৃথক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং যথাযথভাবে তার বাস্তবায়ন। সুপারিশঃ ২০১২ সালের মধ্যে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের জন্য জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ক সামগ্রিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে।

সামাজিক সচেতনতাবৃদ্ধি ও উদ্বুদ্ধকরণঃ আপামর জনসাধারণের মাঝে শিশুশ্রম সংক্রান্ত সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণগত পরিবর্তন সাধন। সুপারিশঃ শিশু ও শিশুর অভিভাবক, নিয়োগকর্তা বা মালিকসংঘ, ট্রেড ইউনিয়ন, পেশাজীবী সংগঠন, মিডিয়াসহ সমাজে প্রতিনিধিত্বকারী সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের মাঝে শিশুশ্রম সংক্রান্ত সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ও সমাজের সকল স্তরের মানুষকে শিশুশ্রমে নিরুৎসাহিত করা। আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগঃ বিদ্যমান আইন সংস্কার, আইন কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন, আইন ও বিধির সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ শিশুশ্রম নিরসন করা। সুপারিশঃ শিশুশ্রমের আনুষ্ঠানিক ত্রে ছাড়াও অনানুষ্ঠানিক ত্রেগুলোকে আইন ও বিধির আওতাভুক্ত করা এবং বিদ্যমান আইনের সংশোধন করে আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক, ঝুঁকিপূর্ণ, নিরাপদ, হালকা এবং ভারী কাজের পৃথক পৃথক তফশিল সংযোজন করতে হবে। কর্মসংস্থান বা শ্রমবাজারঃ ট্রেড ভিত্তিক প্রশিতি শিশু-কিশোরদের আইন অনুযায়ী কাজের উপযুক্ত হওয়া মাত্র তাদের জন্য দেশে বিদেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান করা এবং প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করা।

সুপারিশঃ আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক উভয় সেক্টরে শ্রমে নিয়োজিত শিশু বা কিশোররা কোন নির্দিষ্ট কাজে দতা অর্জন করলে, উপযুক্ত Ëেত্র প্রয়োজনীয় কারিগরি প্রশিণের মাধ্যমে তাদের জন্য দেশে-বিদেশে যথাযথ ও পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মসংস্থান করা এবং শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। শিশুশ্রম প্রতিরোধ এবং শ্রমে নিয়োজিত শিশুর নিরাপত্তাঃ শিশুদের শ্রমে নিয়োজিত হতে না হয়, কর্মরত শিশুদের জীবনকে পরবর্তী সম্ভাব্য তি থেকে রার সুব্যবস্থা করা, গ্রাম থেকে শিশুদের শহরে অভিবাসন রোধ করা এবং শিশুদের কর্মপরিবেশের উন্নয়ন ঘটিয়ে শিশুদের জীবনের ঝুঁকি কমানো। সুপারিশঃ দারিদ্র্য, নদী ভাঙ্গন, পারিবারিক ভাঙ্গন, পাচার ইত্যাদি কারণে যেসমস্ত শিশু গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে তাদের গ্রাম পর্যায়েই অর্থাৎ তৃণমূল পর্যায়ে মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং প্রয়োজনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং তাদের পরিবারের সম ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান ও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে নিরাপদে রাখা, কর্মঘন্টা, মজুরিসহ সকল ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শিশু পাচার রোধ করতে হবে। সামাজিক ও পারিবারিক পুনর্মিলনঃ সকল প্রকার ঝুঁকিপূর্ণ ও্ত নিকৃষ্ট ধরনের কাজ থেকে শিশুদের উদ্ধার করে সামাজিক ও পারিবারিক পুনর্মিলনের ব্যবস্থা গ্রহণ। সুপারিশঃ যেসব শিশু অল্প বয়স হতে দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সাথে জড়িত আছে তাদেরকে সেসব আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সেক্টর থেকে ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহারপূর্বক সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসতে হবে। সম্ভাব্য Ëেত্র পারিবারিক পুনর্মিলনের ব্যবস্থা করা; শারীরিক ও মানসিকভাবে তিগ্রস্ত শিশুদের জন্য বিভাগ, জেলা, উপজেলা এমন কি ইউনিয়ন পর্যায়ে সংশোধন কেন্দ্র, পুনর্বাসন কেন্দ্র, ড্রপ-ইন-সেন্টার, হেল্পলাইন, সাইকোসোশ্যাল কাউন্সেলিং, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, খাদ্য ও বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।

"

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.