মানবিক অবহেলা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না
ফকির ইলিয়াস
---------------------------------------------------------------------------
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ হঠাৎ করে ঝলসে উঠেছে। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দি এফেয়ার্স গীতা পাসি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। একই দিনে বিএনপির সাইফুর রহমান গ্রুপের সঙ্গেও তিনি বৈঠক করেছেন। গীতা পাসির বক্তব্য থেকে জানা গেছে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও কথা বলবেন। বিএনপির খালেদা গ্রুপের দেলোয়ার-মান্নানসহ গ্রুপের সঙ্গেও গীতা পাসি বৈঠক করবেন এটাও প্রায় নিশ্চিত।
একটি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেশ ýপষ্ট হয়ে উঠেছে। তা হচ্ছে, দুই নেত্রীর সুবিচার নিশ্চিতকরণ, তাদের মানবাধিকার সুনিশ্চিত করা এবং সুচিকিৎসার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাস্খ্য বিষয়ে দেশে সাতজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা একটি বোর্ড গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন। তারা সবাই একমত যে, শেখ হাসিনার উন্নত চিকিৎসা দরকার।
তা না হলে তিনি মারাত্মক শারীরিক অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেন। এমনকি শ্রবণ প্রতিবী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল খুবই পরিকল্পিতভাবে। কারা এ হামলা করেছিল, কতটা গ্রেনেড আনা হয়েছিল, পরিকল্পনার নেপথ্যে কে ছিল এসব অনেক কথা দেশবাসী ইতোমধ্যেই জেনেছেন। সে ভয়াবহ হামলা সóáূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের রাজনীতি আজ অনেক বেশি নেতৃত্বশন্য হয়ে পড়তো।
বলতে খুবই বেদনাদায়ক শোনালেও প্রকৃত সত্য হচ্ছে শেখ হাসিনাকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার জন্য, বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক শন্যতা সৃষ্টির জন্য আওয়ামী লীগকে সর্বস্বান্ত করার জন্যই এ ভয়াবহ হামলা করা হয়েছিল।
আওয়ামী লীগকে সশস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে, ভয়াবহ হামলা করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। তাতে জাতির জনক বঙ্গবু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের প্রায় সদস্যই নিহত হন, দুই কন্যা ব্যতীত। বাদ যাননি তার নিকটাত্মীরাও। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখে যে মহান নেতা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন এটাই ছিল তার প্রতিদান।
আওয়ামী লীগকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়েছিল খুব প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে। চেষ্টা করা হয়েছিল দলটিকে ভেঙে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলারও। এমনি এক ক্রান্তিলগ্নে দলের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। তারপর এগিয়ে যায় আওয়ামী লীগ নতুন চেতনা এবং সাহস নিয়ে।
তারপরও আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা করা হয় নানাভাবে।
নানা লেভেল লাগিয়ে ধস নামানোর চেষ্টা করা হয় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায়। এর মধ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এবং ‘ভারত অনুগত’ এই দুটি অভিধা নামিয়ে আওয়ামী লীগকে বিভিন্নভাবে অচল করে দেয়ার পাঁয়তারা করে একটি গোষ্ঠী। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে কোন অপশক্তির সঙ্গেই হাত মিলানো হয় এই তত্ত্বটিতে নতুনভাবে শান দিয়ে তা পোক্ত করেন সামরিক শাসকরা। পরে পালাক্রমে ধ্বংস করে দেয়া দেশের গণতন্ত্র।
দুই.
জেনারেল জিয়া পরবর্তী সময়ে তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে বিএনপির হাল ধরেছিল তা কি পরিশুদ্ধ ছিল? না ছিল না।
আর ছিল না বলেই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ প্রতিষ্ঠার মদদ জোগাতে বিএনপির মতো ডানপন্থি দলটি আধুনিক লেবাসে সব প্রচেষ্টাই করে। দেশে বাংলাভাই, শায়খ রহমানের মতো প্রকাশ্যে ঘোষিত জঙ্গিরা বেড়ে উঠেছিল বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের ছত্রছায়ায়। আমার ভাবতে অবাক লাগে সেই ভয়াবহ জঙ্গিবাদকে সে সময়ে মদদ দানের জন্য কেন বিগত জোট সরকারের বিরুদ্ধে একটি সরকারি মামলাও এ পর্যন্ত রুজু করা হলো না? কেন ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সরকার সেসব মদদদাতাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগগুলো দাঁড় করালো না?
যারা ২১ আগস্টের বোমা হামলা করেছিল এরা তো সেই অপশক্তি, যারা বাংলাভাইকে সরকারি মদদ দিয়েছিল। যারা সরকারের ভেতরে গড়ে তুলেছিল মিনি সরকার। ভবনের আদলে ভবন।
আজ আমরা অবাক হয়ে দেখছি ২১ আগস্টের বোমা হামলার শিকার সেই শেখ হাসিনা এবং তার দলকেই সেই ধকল সইতে হচ্ছে অধিকভাবে। তাহলে কি সব ষড়যন্ত্রের যোগসত্র একই বলয়ে নির্মিত? সব কিছু একই সুতোয় গাঁথা?
বর্তমান সরকার খুব দৃঢ়ভাবে বলে যাচ্ছে তারা কোন পক্ষপাত করছে না এবং করবে না। কিন্তু তারপরও বর্তমান সিইসি ড. শামসুল হুদা বিএনপির একপক্ষকে মৌন সমর্থন দিচ্ছেন তা ইতোমধ্যে ýপষ্ট হয়ে উঠেছে। বিএনপির হান্নান শাহ গ্রুপ সিইসির পদত্যাগও দাবি করেছে। সিইসি বেশ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন বলে মনে করছে গোটা দেশবাসী।
সরকার এগুচ্ছে নিজস্ব রোডম্যাপ নিয়ে। আর বর্তমানে বিভিন্নভাবে শঙ্কিত-আক্রান্ত রাজনৈতিক দলগুলো অগ্রসর হচ্ছে তাদের নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে। সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী দলগুলোকে নিষিদ্ধ না করলে কিছু দল নির্বাচনে অংশ না নিতে পারে। বিএনপির ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হলে একপক্ষ নির্বাচন থেকে বিরত থাকতে পারে। এমন বেশ কিছু বিষয় নিয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে।
‘সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম’-এর দেশব্যাপী গণসংযোগ বেশ সাড়া জাগিয়েছে জনমনে। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে দাতা সংস্খা, কূটনীতিকদের উদ্বেগ বাড়ছে। সব মিলিয়ে দেশের জনগণ ভোটার তালিকা, ভোটার লিস্ট তৈরি এবং নির্বাচন নিয়ে বেশ সংশয়ে আছে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সাধারণ মানুষের ‘পাবলিক রিএকশন’ দেখে আমার সে ধারণাটি খুবই ýপষ্ট হচ্ছে ক্রমেই।
তিন.
স্বাস্খ্যসেবা বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক নীতি সর্বত্রই সমানভাবে প্রচলিত।
বিদেশে আমরা লক্ষ্য করি, একজন রোগী যদি একজন চিকিৎসক কর্তৃক অসুস্খ নির্ণীত হন তবে তিনি ‘সেকেন্ড ওপিনিয়ন’-এর জন্য অন্য চিকিৎসকের দ্বারস্খ হতেই পারেন। বিষয়টি যদি কোন ল’ স্যুটের (ক্ষতিপরণ মামলা) আওতায় থাকে তবে বিবাদি পক্ষের ডাক্তারও এ বিষয়ে কোন চ্যালেঞ্জ করেন না। কারণ কারও কোনও ইনজুরি থাকলে তা তো লুকানো বা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে রোগীর চিকিৎসার প্রধান লক্ষ্য হয়ে যায়। বিবাদি-বাদি পক্ষের চিকিৎসকের তর্কযুদ্ধ কোন মতেই প্রাধান্য পায় না।
কিন্তু আমরা খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করছি, শেখ হাসিনার চিকিৎসা বিষয়টি নিয়ে বর্তমান সরকার নানা দীর্ঘসত্রতা তৈরি করতে চাইছে। এই মানবিক কারণের প্রতি রাষ্ট্রীয় অবহেলা কোন মতেই গ্রহণযোগ্য নয়। হতে পারে না।
কৌশল যতই বদল করার চেষ্টা করা হোক না কেন, কাউকে প্রতিবী জীবনের প্রতি ঠেলে দেয়ার দায়িত্বব কি নিতে পারে কোন রাষ্ট্র? কোন সরকার?
খালেদা জিয়া তার দু’ছেলেকে রেখে বিদেশে যাবেন না তা তিনি বারবারই জানিয়েছেন আকারে-ইঙ্গিতে, বক্তব্যে, ঘোষণায়। তারপরও আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, চিকিৎসার প্রয়োজন তারও দরকার হলে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করানো উচিত।
চিকিৎসার বিষয়ে কোন শর্তই যুক্ত হতে পারে না। সময়, জনগণ এবং ইতিহাস তা মেনে নেবে না।
কিন্তু বেগম জিয়া যাবেন না তাই শেখ হাসিনাকেও যেতে দেয়া হবে না এমন মানসিকতা কোন মতেই কাম্য নয়।
দুর্নীতিগ্রস্তরা হাইকোর্ট থেকে জামিন পাবেন না। স্খানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সংসদ নির্বাচনের আগেই।
এমন বেশকিছু কৌশল নিয়ে বর্তমান সরকার তাদের অবস্খান সুসংহত করতে চাইছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সামনে নির্বাচন রেখে নেপথ্যে একটি অনুকূল ছায়া সরকার গঠন করার চেষ্টাও করা হচ্ছে। সরকার তার কৌশল বদলে নতুন পথ অবলম্বন করতেই পারে।
কিন্তু কোন মতেই কোন নাগরিকের মানবিক দিকগুলো যেন আক্রান্ত না হয়। আমার মনে হয়, সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই গীতা পাসি নতুনভাবে তৎপর হয়েছেন।
আমরা জানি জেমস এফ মরিয়ার্টি নতুন রাষ্ট্রদত হিসেবে খুব শিগগিরই ঢাকার দায়িত্ব নেবেন। ২০০৮-এর নির্বাচন বাঙালির বাঁচামরার লড়াই। নতুন করে অস্তিত্ব খোঁজার প্রশ্ন জড়িত এ নির্বাচনের সঙ্গে। কারণ তা নির্ধারণ করে দেবে, কেমন হবে আগামীর বাংলাদেশ। কেমন হবে প্রজন্মের ভবিষ্যৎ।
সে পরিবর্তনের সড়কে সবাইকে দাঁড়ানোর সুযোগ দিতে হবে। আবারও বলি কোন মানবিক অবহেলা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যারা একটি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্খা রাষ্ট্রেরই করা উচিত। কোন আইনি অভিযোগ যেন সুচিকিৎসার পথ ব না করে।
নিইইয়র্ক, ১১ মার্চ ২০০৮
------------------------------------
দৈনিক সংবাদ ।
১৫ মার্চ ২০০৮ শুক্রবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।