`সারারাত দখিনা বাতাসে
আকাশের চাঁদের আলোয়
এক ঘাইহরিণীর ডাক শুনি-
কাহারে সে ডাকে!
...............................
কোথাও অনেক বনে- যেইখানে জ্যোৎস্না নাই আর
পুরুষ-হরিণ সব শুনিতেছে শব্দ তার;
.................................................
জীবনের কোনো এক বিস্ময়ের রাতে
আমারেও ডাকেনি কি কেউ এসে জ্যোৎস্নায়- দখিনা বাতাসে
ওই ঘাইহরিণীর মতো?
................................................
বসন্তের জ্যোৎস্নায় ওই মৃত মৃগদের মতো
আমরা সবাই। '
(ক্যাম্পে : জীবনানন্দ দাশ)
ক্যাম্পে কবিতাটি যতবারই পড়ি, সমূহ প্রশ্ন ডানা মেলে উড়তে থাকে চিন্তার আকাশে-বাতাসে। চাঁদের আলোয় এক ঘাইহরিণীর ডাক- কাহারে সে ডাকে? কেন ডাকে? নিজে ঘাই হয়ে (শিকারকে ফাঁদে ফেলার জন্য সজাতীয়ের ঘাই বা টোপ দেওয়া হয়) শিকারীর জালে অন্যকেও বন্দি করাতেই কি ঘাইহরিণীর এত ডাকাডাকি- কোন সে শিকারী- সে কি নিষ্ঠুর- সে কি উন্মাদ প্রেমিক-হন্তারক- না চাঁদের আলোয় জ্যোৎস্নায় চঞ্চল হরিণী-মন প্রেমিকের প্রেমাস্পদের সান্নিধ্য লাভে ব্যাকুল হয়ে ওঠে? না এই ডাকাডাকির মাঝে লুকিয়ে আছে কোনো ছলনা, মিথ্যাচার? এ যজ্ঞে কে তবে দায়ী? ঘাইহরিণী, না জ্যোৎস্না-দখিনা বাতাস-চঞ্চলমন, নাকি ওই শিকারী, সমাজযন্ত্র?
আবার দেখা যায়, কোথাও অনেক বনে- যেখানে জ্যোৎস্না নেই, ওইখান থেকে পুরুষ-হরিণ তার কাঙ্ক্ষিত ঘাইহরিণের ডাক শুনছে। এবং ছুটে যাচ্ছে তার দিকে! মানে ওই জ্যোৎস্নাস্নাত ঘাইহরিণীর দিকে। তাহলে যেখানে জ্যোৎস্না নেই, সেইখানেই কি পুরুষ-হরিণেরা থাকে? পুরুষ-হরিণদের জন্য কি কোনো ব্যক্তিগত জ্যোৎস্না নেই? জ্যোৎস্নার মায়াময় বিভ্রম ও ছলনা শুধু! তবু কেন জ্যোৎস্নায় লালসা- আকাঙ্ক্ষা-সাধ-প্রেম স্বপ্ন স্ফুট হয়ে ওঠে?
অন্যত্র দেখি, কবিকেও ডেকেছিল কেউ এমনিভাবেই, ওই ঘাইহরিণীর মতো, জ্যোৎস্নায়- দখিনা বাতাসে।
যে ডেকেছিল, সে কে? কেনই-বা ঘাইহরিণীর মতো? সত্যিই কি তেমন কোনো নারী ডেকেছিল তাঁকে, গোপনে বসন্তরাত্রিতে জ্যোৎস্নায় প্রেমের উৎসবে? আর কবিও চিতার চোখের ভয়- চমকের কথা সব পিছে ফেলে ধরা দিতে চেয়েছিলেন, সেই ঘাইহরিণীর মতো কেউ একজনকে। হয়তো ধরা দিতে পারেননি তিনি। তাই বুকের প্রেম মৃত মৃগদের মতো ধুলোয় রক্তে মিশে গেছে। প্রেমের সাহস- সাধ-স্বপ্ন নিয়ে ব্যথা, ঘৃণা-মৃত্যু পেয়ে তবু কবি বেঁচে থাকেন মৃত মৃগদের মতো।
এখানে `ঘাইহরিণী' রূপকের আড়ালে লুকিয়ে আছে কি জীবনের কোনো এক গূঢ় বিস্ময় জড়ানো ক্ষত, যে ক্ষতের কোনো সেবা হয় না, শুশ্রূষা হয় না, কেবলি বয়ে বেড়ানো ছাড়া।
কবিকে সেই কেউ একজন ডেকেছিল জীবনের কোনো এক `বিস্ময়ের রাতে'। তা-ও আবার জ্যোৎস্নায়! জ্যোৎস্নায় কি তবে বিস্ময়? জীবনে কি বিস্ময় অপরিহার্য? কোনো এক ক্ষত? যে ক্ষতের যে বিস্ময়ের ঘোরে কবি ঘাইহরিণীর ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে মৃত মৃগীদের যন্ত্রণার মাঝে নিজের অন্তর্বেদনাকে প্রকাশিত হতে দেখেছেন।
প্রতিটি জীবনেই কি তবে এরকম বিস্ময়ের রাত আসে? আর ওই রাতে ঘাইহরিণীর মতো কেউ একজন ডেকে যায়- জ্যোৎস্নায়- দখিনা বাতাসে। কেন সে ডাকে? জ্যোৎস্নায়ই বা কেন? তার কাছে ধরা দিতে চাইলেই কি ধরা দেওয়া যায়? না তার কাছে গেলে আর তাকে পাওয়া হয় না, বন্দি হয়ে পড়তে হয় অন্য কোনো এক শিকারীর জালে। যে শিকারের জাল ছেড়ে আর বের হওয়া যায় না কোনোদিনই।
তবু নিরন্তর এই যে ডাকাডাকি, ইশারা-সংকেত, এই যে কারো কাছে গিয়ে ধরা দিতে চাওয়ার বাসনা, না পাওয়ার বেদনা- এই নিয়েই তো চলছে জগত-সংসার, মানুষের জীবন- ওই মৃত মৃগদের মতো! তারপরও জ্যোৎস্না এলেই প্রেমমন উত্তাল হয়ে ওঠে, সমস্ত ডরভয় পেছনে ফেলে ছুটে যায় ঘরবাহিরে, বনে, কাঙ্ক্ষিত কারো সান্নিধ্য লাভের আশায়। হয়তো কেউ পায় তাকে, কেউ পায় না। যে পায় না, যার পাওয়া হয়ে ওঠে না, হয়তো তার মনঘরেই চুপিসারে ঢুকে যায় কোনো এক বিস্ময়, বিমূর্ত ও আশ্চর্য ক্ষত। যাকে তাড়ানো যায় না কখনো। কেননা সেই ক্ষতটিকে আমরা নিজের অজান্তেই মৃত মায়ের মুখের মতো আগলে রাখি সারাজীবন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।