৭১ এ ছোট ছিলাম, যুদ্ধে যেতে পারি নাই, এই আক্ষেপ ফুরাবার না
কিন্তু তখনও জানতাম না, কুকুরের লেজ আসলেই সোজা করা যায় না।
দেশে ফিরে বাসায় ঢুকেই কিছুটা অবাক হলাম।
ছয়তলার এই ফাটটি আমিই সাজিয়ে রেখে গিয়েছিলাম আমার ফার্নিচার দিয়ে। এবার এসে দেখি সেখানে আরও অনেক কিছু যোগ হয়েছে। এসেছে প্রচুর ফুলের টব, যেসব ফুল আমার পছন্দের সেগুলোই বেশি।
গুলশানের বাসায় এরশাদের ব্যক্তিগত কর্মচারী যারা ছিল, তারাও এখন এখানে।
মাসখানেক বেশ ভালই কাটলো।
পাল্টে গেল কেবল একটা ব্যাপার। আমি এরশাদকে নিয়ে একান্তে বসলাম, দীর্ঘ আলোচনা হলো। এক সময় মেডিসিনের ছাত্রী ছিলাম।
তাকে বুঝালাম। যাদের হার্টের সমস্যা আছে তাদের জন্য ভায়াগ্রা কতটা ভয়ংকর হতে পারে- তাও বললাম তাকে।
বাধ্য ছাত্রের মত সে বুঝার ভান করলো।
তারপর শর্ত দিলাম- আর ভায়াগ্রা খেতে পারবে না।
দ্রুতই রাজী হয়ে গেল সে।
নীল ট্যাবলেটের অনুপস্থিতিতে পরাক্রমশালী প্লেবয় রাতারাতি ‘যে কোন বৃদ্ধে’ পরিণত হলো।
তবে মনের সেই বিকৃতি কিন্তু রয়েই গেল। তার বয়স হয়েছে, বয়স যে মানুষের অনেক মতাই কেড়ে নেয়- এটা সে মানতে রাজী না। নিজের বাহাদুরী আমার কাছে প্রমাণের জন্য এ সময় চেষ্টা করতো সে বিচিত্র উপায়ে।
প্রায়ই দেখতাম নীল ট্যাবলেটের বিকল্প হিসাবে নির্ভর করতে চাইছে নীল ছবির উপর।
বেডরুমেই ছিল টেলিভিশন, মুভি প্লেয়ার। আমি বিছনায় শুয়ে থাকতাম, সে সোফায় বসে বসে দেখতো সেসব। নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করতো। কিন্তু মনের ডাকে সাড়া দিত না শরীর। বিড়বিড় করতে থাকতো, “গেট আপ, গেট আপ।
প্র“ভ দ্যাট- আই এ্যাম এ ম্যান। ফর গডস্ সেক, গেট আপ, গেট আপ। ”
হয়তো এত প্রবল আকুতিতে একসময় জেগেও উঠতো, কিন্তু সোফা থেকে উঠে বিছানা পর্যন্ত আসার আগেই ‘ম্যান’ পরিণত হতো ‘ওল্ড ম্যান’ এ।
মাঝে মাঝে আমার কাছে ভেঙ্গে পড়তো আকুতিতে। বলতো, “বিদ, বিলিভ মি, স্টিল আই ক্যান ডু ইট।
জাস্ট গিভ মি এ চান্স। আই নিড ইউর লিটল কো-অপারেশন। প্লিজ, প্লিজ। ”
‘লিটল’ নয়, ‘লট অফ কো-অপারেশন’ করেও দেখেছি কাজ হয় না। আর হলেও সেটা বরং বিরক্তিরই কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আমি বলতাম, “দেখো, বাদ দাও এইসব প্রচেষ্টা। আমি তো এর জন্য লালায়িত নই। এর বাইরেও জীবন আছে। আমি তোমাকে ভালবাসি। আমাদের সন্তানকে নিয়ে সুখে থাকতে চাই।
”
কিন্তু কে শোনে কার কথা। আগের সেই খুটে খাওয়ার স্বভাবে তার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না।
মাঝে মাঝে ফোন পেতাম, বলতো অচেনা কেউ, “ম্যাডাম, স্যার কে একটু দেখে রাখবেন। অফিসে নানা ধরণের মেয়ে মানুষ নিয়ে আসে। ”
কে ফোন করতো, কোন পরিচয় দিত না।
উড়ো এইসব ফোন সম্পর্কে এরশাদকে জিজ্ঞাসা করেছি। সে বলেছে, “শোন আমার তো শত্র“র অভাব নেই। তোমার-আমার মধ্যেকার এত মধুুর সম্পর্ক অনেকেই সহ্য করতে পারছে না। মানুষ আছে খালি ঝামেলা তৈরিতে। তুমি ওই সবে কান দিয়ো না।
”
আমি কান দিতে চাইতাম না।
আবার একদিন এলো উড়ো ফোন। আমি েেপ গেলাম। বললাম, “আমি বিশ্বাস করি না এসব। ”
“ঠিক আছে, আপনি তাহলে এখনই অফিসে যেয়ে দেখুন।
দেখবেন স্যার কাদেরকে নিয়ে বসে আছেন। ”
আমি বাসা থেকে বের হতেই এরশাদের ফোন পেলাম। সে জানতে চাইলো আমি এখন কোথায়।
জবাবে বললাম, “ধানমন্ডিতে। রেষ্টুরেন্টে।
”
ধানমন্ডির ৫ নম্বর রোডে আমার সাভেরা রেষ্টুরেন্ট তখন দারুন জমজমাট। প্রায়ই সেখানে যেতাম, হিসাব নিকাশ নিতে। বন্ধুরাও অনেকে আসতো। আড্ডা হতো। এরশাদ এসব জানতো।
তাই সে আমার কথা বিশ্বাস করলো।
পাল্টা আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কোথায়? ব্যস্ত?”
“হ্যাঁ, খুব ব্যস্ত। সিনিয়র লিডারদের নিয়ে একটু বসেছি। এটা শেষ হতে সময় লাগবে। বাসায় ফিরতে দেরী হতে পারে।
”
আর কিছু বললাম না। প্রেসিডেন্ট পার্ক থেকে জাতীয় পার্টির অফিসে যেতে মোটেই সময় লাগে না। ৫ মিনিটের মধ্যেই চলে গেলাম। বেশ রাত হয়ে গেছে তখন। অফিসে লোক সমাগম একেবারেই নেই।
নিচে দেখা সিকিউরিটি গফুরের সঙ্গে। এরশাদের খুবই বিশ্বস্ত। আমাকে দেখে কেমন যেন একটা আতঙ্কের ভাব ছড়িয়ে পড়লো ওর চেহারায়। অন্য কর্মচারীদের মধ্যে শুরু হলো ফিসফিসানি। কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা উঠতে থাকলাম এরশাদের রুমের দিকে।
দরজা ভেজানো ছিল। ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ে নিজেই ধাক্কা খেলাম।
ঘরে এরশাদ আছে, কিন্তু কোন সিনিয়র লিডার নেই। তবে আছে দু’জন মহিলা। জর্জেটের পাতলা শাড়ি পরা মহিলা দু’জনের গায়ে হাতাকাটা ব্লাউজ।
একজনের শাড়ির আঁচল আর গায়ে নেই, হঠাৎ করেই যেন পড়ে গেছে, আর সে সেটা তুলতে ভুলে গেছে। মুখে তাদের আমন্ত্রণের সস্তা হাসি। আর এরশাদের হাতে ১০০ টাকার নোটের দু’টি বান্ডিল, দশ আর দশ- বিশ হাজার টাকা!
আমাকে দেখে এরশাদ যেন ভূত দেখলো। “তুমি? তুমি এখানে কী করছো?”
“কিছু না। হঠাৎ তোমার কথা মনে পড়লো, তাই তোমাকে দেখতে এলাম।
একটু পাশের ঘরে আসো, কথা আছে। ”
এরশাদকে নিয়ে আমি পাশের ঘরে গেলাম। সেখানে আমাকে কোন প্রশ্ন করতে হলো না, সে নিজে থেকেই হড়বড়িয়ে আত্মপ সমর্থন করতে লাগলো। “মহিলা দু’টি আমার পার্টির কর্মী। ”
“কিন্তু আমি তো দেখলাম, তুমি টাকা নিয়ে বসে আছ।
ঠিক ডিলিংয়ের সময় আমি এসে পড়েছি। ”
“না, না, ওরা বিপদে পড়ে আমার কাছে এসেছে। সাহায্যের জন্য। ”
“কিন্তু ওরা তা’হলে দৌড়ে পালালো কেন? সাহায্যের জন্য হলে তো বসে থাকতো। আমি যখন তোমাকে নিয়ে এই ঘরে ঢুকলাম, ওরা পালালো কেন?”
এরশাদ তখন মনে মনে হয়তো জুতসই কোন অজুহাত খুঁজছিল।
আমি আবার বললাম, “কই তোমার সিনিয়র লিডাররা কই? তাদের সঙ্গে না মিটিং করছিলে, তারা কোথায়?”
এরশাদ আমতা আমতা করতে থাকলো।
বললো, “এই একটু আগে মিটিং হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল। ”
আমি আর নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না। এমনিতে আমার রাগ একটু বেশি। হাতে কাছে ছিল একটি দামী ফুলদানী।
তুলে সজোরে মেঝেতে ছুড়ে মারলাম। বিকট আওয়াজ করে ভেঙ্গে গেল।
ত্রস্ত পায়ে বের হয়ে গেল সে। একটু পরে আমিও।
একজন বললো, “স্যার গাড়ি নিয়ে বাসার দিকে চলে গেছে।
”
আমি আবার ঢুকলাম এরশাদের ঘরে। ওর টেবিলের ড্রয়ার খুললাম। দেখি ওই টাকার বান্ডিলগুলো তখনও সেখানে। সেই সঙ্গে ড্রয়ারে নানা ধরনের মেয়েলী উপহার সামগ্রী।
আমার মাথা তখন ঘুরছে।
এসব কী? লোকটিকে আমি কী মনে করেছিলাম, আর এখন কী দেখছি?
আমার মধ্যে তখন রীতিমত ্যাপামি পেয়ে বসেছে। পুরো অফিস আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করেছি।
কানের দুল, গলার হাড়, চুড়ি, ব্রেসলেট, পারফিউম, নেইল পলিশসহ নানা ধরণের মেয়েলী উপহার সামগ্রী পেলাম প্রচুর। আর একটি ড্রয়ারে পেলাম- সেই যৌন উদ্দীপক নীল ট্যাবলেট, ভায়াগ্রা!
তাহলে সে এখনও ছাড়েনি ভায়াগ্রা খাওয়া!
বাসায় না খেলেও এখানে বাজারের মেয়েদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগে ঠিকই খেয়ে নেয়।
আরও পেলাম কিছু হারবাল ওষুধ, কিছু লোশন, আর ¯েপ্র জাতীয় একটা শিশি।
বুক সেলফের মত একটা ছিল সেখানে। বইয়ের ফাঁকে পেলাম প্রচুর থ্রি এক্স রেটেড ছবি।
আর সেই বিছানার চাদর আর বালিশ!
ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে আমি বাসায় চলে এলাম। এসে দেখি ঠিকই সে বাসায় আছে।
তাকে নিয়ে বেডরুমে এলাম।
শান্তভাবে সে এল, বসলো।
এবং আশ্চর্য অসম্ভব শান্তভাবে সে আমার প্রশ্নে জবাব দিল।
বললো- উপহার সামগ্রীগুলো সে আমার জন্যই কিনেছিল। ওখানে জমিয়ে রেখেছে সব একবারে দেবে বলে।
ভায়াগ্রা সম্পর্কে বললো, আমাকে কথা দেয়ার পরে এখন আর সে খায় না।
“তাহলে এখানে এল কী করে?”
“আগের অফিসে ছিল, শিফট করার সময় চলে এসেছে। ”
“আর চাদর বালিশ? এই বালিশ তো তোমার আগের অফিসে দেখেছি। সেদিন বলেছিলে আমার জন্য আনিয়েছো। আজ তা’হলে কার জন্য আনানো হয়েছে?”
এরশাদের জবাব, “অফিস শিফট করার সময় অন্য মালামালের সঙ্গে চলে এসেছে। কর্মচারীরা এনেছে।
ওরা তো আর সব কিছু বুঝে না। ”
আমি চুপ করে থাকলাম। যুক্তিগুলো আমার কাছে খুব একটা অযৌক্তিক বলে মনে হলো না। আসলে তখনো আমি এরশাদকেই বিশ্বাস করতে চেয়েছি। মনে হলো- এরকম হতেই পারে।
আমার এই চুপ করে থাকা দেখে এরশাদ বুঝতে পারলো- আমার মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে।
হঠাৎ করেই তার গলার স্বরে জোর ফিরে এল। বললো, “এত সন্দেহ থাকলে তো আর সংসার করা চলে না। অথচ তোমার জন্য কত কিছু আমি করেছি। কত কষ্ট করে তোমাকে বিয়ে করেছি।
এই বিয়েতে কেউই রাজী ছিল না। কেউ তোমাকে পছন্দ করে না। তুমি আর দশজন বাঙালী মেয়ের মত নও। তুমি গাড়ি চালিয়ে বেড়াও, প্যান্ট শার্ট পর, তোমার অনেক বন্ধুবান্ধব- এসব কেউ পছন্দ করে না। সবার মতের বিরুদ্ধে তোমাকে বিয়ে করেছি।
আর এই তার প্রতিদান? তুমি আমাকে সন্দেহ করছো?”
আমার নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হলো। তাই তো আমি সন্দেহ করছি কেন? সন্দেহ তো আমার চরিত্রে থাকার কথা নয়।
পিটার আমাকে কখনো সন্দেহ করা শেখায়নি। তার বক্তব্য ছিল, ‘সন্দেহ করার কী দরকার। কিছু জানতে ইচ্ছা হলে সরাসরি প্রশ্ন করো।
আমি জবাব দেব। কখনো হঠাৎ কাউকে ভাল লাগলে আমার যেমন সম্পর্ক হতে পারে, তেমনি তোমারও পারে। এ নিয়ে লুকোছাপার কিছু নেই। এটাই মানবজীবন। জীবনে যা কিছুই ঘটুক স্বীকার করার সৎ সাহস থাকা চাই।
’
আমি নিজেকে উদার করতে চাইলাম।
(চলবে?)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।