যেতে চাও যাবে, আকাশও দিগন্তে বাঁধা, কোথায় পালাবে!
২০০৬ সালের আগষ্ট মাসে ফুলবাড়ীর সাধারণ মানুষ যখন অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে বিদেশী বেনিয়া এশিয়া এনার্জির মুখোমুখি দাড়িয়েছিল, তখন অনেকেই ভাবেননি যে এই মানুষগুলি দেশের সুবিধাভোগী প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির সমর্থন ছাড়াই বিজয় অর্জন করে ঘরে ফিরবে । সেই সংগ্রামে ৭ জন সংগ্রামী মানুষের রক্তে রক্তাক্ত হয়েছিল ফুলবাড়ী আর জনমানুষের সেই আন্দোলনের সূত্র ধরে এশিয়া এনার্জি একরকম বিতারিত হয় ফুলবাড়ী থেকে। সরকারও বাধ্য হন এশিয়া এনার্জির সাথে ওপেন পিট পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের চুক্তি বাতিল করতে ।
সম্ভবত: অনেকেই জানেন তারপরও প্রাসঙ্গিক হওয়াতে উল্লেখ করছি যে ওপেন পিট পদ্ধতিতে খনির মোট মজুদ ২.৫৫ বিলিয়ন টনের প্রায় পুরোটাই উত্তোলন করা সম্ভব হলেও এর ফলে পরিবেশ এবং প্রতিবেশের যে ক্ষতি হবে তা অপূরণীয় । পরিবেশের স্থায়ী ক্ষতি ছাড়াও ফুলবাড়ী জনপদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই হারিয়ে যাবে কয়লা খনির জন্য প্রয়োজনীয় খননের ফলে ।
তার মানে দাড়াচ্ছে স্থানীয় অধিবাসীরা উৎখাত হবেন তাদের শেষ আশ্রয়স্থল থেকে । আর এই অস্তিত্ব রক্ষার বোধ থেকেই দানা বেধেছিল ২০০৬ সালের ফুলবাড়ী আন্দোলন।
সময়ের পালাবদলে আর রাজনৈতিক সরকারের ব্যর্থতায় দেশে চলছে সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় জরুরী অবস্থার মধ্যে তত্বাবধায়ক সরকারের শাসন । এই সময়কালে এশিয়া এনার্জি নীরবে তাদের প্রজেক্টের সপক্ষে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক লবিং করে এখন সুবিধামত সময়ে তারা একটি ভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আবার প্রকাশ্যে এসেছে ।
২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে এশিয়া এনার্জি প্রস্তাব দেয় ফুলবাড়ীর কয়লা ব্যবহার করে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের ।
প্রতি বছর ১৫ মিলিয়ন টন করে কয়লা উত্তোলন করে ৩০ বছর ধরে চলা এ প্রকল্পে বাংলাদেশের মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৭.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার । বাংলাদেশের বিদ্যুত ঘাটতি জনিত সমস্যা মোকাবেলায় একটি লোভনীয় প্রস্তাব সন্দেহ নেই । কিন্তু এই লোভনীয় প্রস্তাবের আড়ালে একটি ব্যাপার থেকে চোখ এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই । আর সেটি হলো এশিয়া এনার্জি ৩০ বছর ধরে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায় ওপেন পীট পদ্ধিতে উন্মুক্ত খননের মাধ্যমেই । ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রস্তাবটি একটি নতুন ব্যাপারকে সামনে নিয়ে আসে ।
প্রথমে দেখা যাক কেন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত বলছি । ২০০৫ -০৬ তে যখন এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে ফুলবাড়ীতে প্রতিরোধের আন্দোলন শুরু হলো তখন বাংলাদেশের সাধারণ অবস্থান জ্বালানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশ হিসাবে । গ্যাস কোম্পানীগুলি দেশের গ্যাস মজুদ ৫০ টিসিএফ এর মত জানাচ্ছে এবং সেই মজুদ দেখিয়ে গ্যাস রপ্তানীর অনুমতির জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে । সর্বত্র প্রচার করা হলো আগামী ২৫-৩০ বছরের মজুদ রেখে তারপর গ্যাস রপ্তানি করা হবে । সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও গ্যাস মজুদজনিত এই ধারণা জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুবিধাজনক অবস্থান এবং এই ক্ষেত্রে কয়লার উপর নির্ভর না করার ক্ষেত্রে একটা শক্ত অবস্থান তৈরীতে সহায়তা করে ।
ফুলবাড়ীর সাহসী জনগণের পাশাপাশি এই ব্যাপারটিও ফুলবাড়ী আন্দোলনে একটা পজিটিভ ভুমিকা রাখে ।
গত বছরের শেষ দিকে এশিয়া এনার্জির নতুন প্রস্তাবের পর থেকেই হঠাত করে বাংলাদেশের জ্বালানী নিরাপত্তা নিয়ে সাধারণ ধারণা পাল্টানোর একটা চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে । অফশোর গ্যাস মজুদের একটা বড় ব্লক থেকে গ্যাস না পাবার কথা জানালো কেয়ার্ণ বছরের শেষ দিনে । হঠাত করেই গ্যাসের মজুদের পরিমাণ ৫০ টিসিএফ থেকে প্রমাণিত মজুদ ১৩.৪ টিসিএফ ধরে দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা কতটা হুমকির মুখে সেই ব্যাপারটি সামনে চলে আসলো । ২০১১ সালের মধ্যে গ্যাস মজুদ (কোথায় গেলো ২৫ বছরের হিসাব? )শেষ হয়ে গেলে আমরা কি করবো সেটাও একটা মুখ্য ব্যাপার হিসাবে আলোচনায় আসলো ।
এর মধ্যে এই আলোচনার কফিনে
শেষ পেরেক হিসাবে আসলো পেট্রোবাংলা কর্তৃক প্রস্তাবিত গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহে অপারগতার কথা এবং মিয়ানমার থেকে গ্যাস আমদানীর চিন্তাভাবনার কথা ।
পুরো ব্যাপারটিকে এক সুতোয় গাথলে এখন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতটা স্পষ্ট হয় । এখন প্রশ্ন হলো এই ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতটা কি প্রকৃত অবস্থাকে নির্দেশ করছে নাকি বহুজাতিক কোম্পানীর স্বার্থ রক্ষায় এটি তৈরী করা কোন পরিপ্রক্ষিত? এখানে কন্সপিরেসী থিওরীর মত শোনালেও একটি তথ্য প্রাসঙ্গিক যে এশিয়া এনার্জির মত কেয়ার্ণও যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানী ।
আর এইখানেই আমার আশংকা । জরুরী অবস্থার মধ্যে তত্বাবধায়ক সরকারের সময়কালীন একটি নিরাপত্তাহীন পরিপ্রেক্ষিত তৈরী করে এশিয়া এনার্জির এই প্রস্তাব কি দেশের এবং ফুলবাড়ীর জনগণের স্বার্থবিরোধী নীল নকশা বাস্তবায়নের কোন নতুন উদ্যোগ?
গত ২৬ শে জানুয়ারীর রয়টার্সের সংবাদ থেকে জানা যায় এশিয়া এনার্জির সাথে সরকারের আলোচনায় নাকি অনেক অগ্রগতি হয়েছে এবং এশিয়া এনার্জি গ্রীন সিগণ্যাল পাবার ব্যাপারে প্রচণ্ড আশাবাদী ।
আমি কেন জানি আশাবাদী হতে পারিনা বরং আশংকিত হই । আমি দেখি কাফকোর মত আরেকটি অঘটনের জন্ম নেবার অশনিসংকেত আর সেই সাথে ফুলবাড়ীর সংগ্রামী মানুষের রক্তে রক্তাক্ত কয়লার আর একবার রক্তাক্ত হবার দু:স্বপ্ন । নাকি এবার ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে সব কিছু সামাল দেয়া হবে পরিকল্পনামাফিক?
প্রশ্নের উত্তর খুজি কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর পাইনা ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।