আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাতজাগা সাথীরা,আঁধারের গানে এসো



[উৎসর্গ : রাতজাগা সাথীদের,আর নিশাচর ব্লগারদের] রাত জাগা টা ঠিক কবে কখন শুরু হয়েছিল মনে পড়েনা,তবে এটা জানি যে ঠিক অনভ্যস্ত নই ব্যাপারটাতে। বাসার লোকজন,লোকজন বলতে অবশ্য খালি বাবা আর মা,দেরিতেই ঘুমাত,ঘুমায় এখনো। একদম ছোটবেলায়,মানে একদমই ছোটবেলায়,বাবার কোলে বসে অনেক রাত পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফুটবল দেখেছি,যদিও খেলাটা বোঝার বয়স তখনো হয়নি। যখন হয়েছে,তখনো ছোট,কিন্তু দল বেঁধে খেলা দেখার মজা নেয়ার জন্য মানুষের বাসায় গিয়েও রাত জেগেছি বিশ্বকাপের এক মাস,মায়ের আপত্তি থাকলেও এখানে বাবার নীরব সম্মতি ছিল,আমার অজুহাতে নিজেরও খেলা দেখা হয় বলে। বাবার আপত্তি শুরু হলো খানিকটা বড় হবার পর, যখন থেকে গল্পের বই নিয়ে রাত জাগা শুরু করলাম,একটা বই ধরলে সেটা শেষ না করে ওঠা বেশ কঠিন কিন্তু বাবাকে সেটা বোঝায় কে? ১২টা বাজলেই চেঁচামেচি,মা কিছু বলে না দেখে হয়তো আরো আধা ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়া যায় কিন্তু তাতেও বই শেষ হয়না।

কি করা যায়? সমাধান দিলো বড় বোন,তার কেনা ১টা বই পড়ার ল্যাম্প,ঐ যে,বইয়ের সাথে আটকে পড়া যায়,আমাকে ধার দিলো। কিছুদিন ভালোই চললো,বাতি নিভিয়ে বাচ্চা ল্যাম্প দিয়ে বই পড়া, কিন্তু একদিন বাবার হাতে ধরা পড়লাম,২-৪ ঘা দিয়ে সেই ল্যাম্প আলমারিতে তুলে রেখে দিলো কিন্তু স্বভাব যাবে কই?স্কুল তো ডে-শিফট,ভোরবেলা উঠতে হয়না,কাজেই আমার রাত ২টার আগে ঘুমানোও হয়না,মাঝে মাঝেই ২-১ ঘা খাই কিন্তু সেটাও অভ্যাস হয়ে গেছে,গায়ে লাগাই না। ঝামেলা হলো কলেজে গিয়ে,ভোরবেলা ক্লাস,একি মহাযন্ত্রণা! বারে বারে লেট প্রেজেন্ট,ক্লাসে ঝিমানো,ঝাড়ি,অভ্যাস একটু বদলালো। আবার সেকেন্ড ইয়ারে দুপুরে ক্লাস,পুরানো অভ্যাসে ফেরত,ততদিনে অজুহাত বের হয়ে গেছে,অনেক পড়া কলেজে,শেষ করতে হবে না?(পড়া না কচু,কলেজ জীবনে অনেক কিছুই করেছি খালি পড়াশোনাটাই বাকি ছিলো ) রাতে না ঘুমানোর অভ্যাসটা চরমে উঠলো বুয়েটে এসে,আর চূড়ান্ত রূপ নিলো ইন্টারনেট নামের এই ভয়াবহ জিনিসটা যেদিন থেকে জীবনের সাথে জড়িয়ে গেলো। নতুন নতুন নেট নেবার পরে সবাই যা করে,কাজ থাক বা নাই থাক দুনিয়ার সব সাইটে গিয়ে ঘুরতে থাকি,কাজ না থাকলে বসে বসে মেইল আইডি খুলি,সব সাইটেই রেজিস্ট্রেশন করি,দুনিয়ার সব গ্রুপে ফালতু মেইল করি,আমার মেইলের যন্ত্রণায় ব্যাচের গ্রুপমেম্বাররা বিরক্ত হয়ে গেলো।

আর চ্যাট? এই নেশা নিয়ে বলার কিছু নেই,সেসময় বাংলাদেশে বিডিচ্যাট আর এমআইআরসি'র জমজমাট অবস্থা,সারারাত চ্যানেলগুলিতে ঘুরি,চেনা না চেনা সবাইকে নক করি আর কেউ সাড়া দিলে মহাখুশি হয়ে বাকি রাত খাজুরে আলাপে পার করে দিই। (আমার এক বন্ধু,বাংলাদেশের সব চ্যানেলে বেশি ঘুরে বিরক্ত হয়ে এরপরে পর্তুগাল,জাপান,হল্যান্ডের মত চ্যানেলগুলিতেও ঢুঁ দিতো,মনে আছে) ইয়াহু আর এমএসএন তো আছেই,বন্ধুবান্ধব যারা নেটে থাকে সবাইকে বিরক্ত করে ফেলি,গল্প আর শেষ হয়না,আমি একাই যে রাতজাগা পাগল না সেটা নেট দেখে বুঝলাম,ম্যালা লোকজন সারারাতই জেগে থাকে। শুধু জেগেই থাকেনা,মাঝে মাঝে "বাজ" দিয়ে জানানও দেয় যে আমরা আছি। তাতে আমার টাইপের গতি হয়ে গেলো পেশাদার টাইপিস্টের মত কিন্তু পড়াশোনা শিকেয় উঠে গেলো,অবশ্য সেটা কখনো মাটিতে ছিলো কিনা সেই প্রশ্নও মাঝে মাঝে গুরুজনরা করে থাকেন। এমন কত দিন গেছে যে বন্ধুদের সাথে সারারাত চ্যাট করে সকালে একবারে উঠে ক্লাসে চলে গেছি,গিয়ে শেষ বেন্ঞ্চিতে মাথা দিয়ে সোজা ঘুম,স্যার আসলে নাম ডাকার সময় বন্ধুরা একটু ঠেলা দিলে ইয়েস স্যার বলে আবার ঘুম।

(ক্লাসনোটের খাতাটা এজন্য ৪ বছরই খালি থাকলো,কিন্তু সেটা আরেক গল্প)। যেদিন নেট ভালো লাগেনা,হলে চলে যাই,বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে,সারারাত বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেই,গানবাজনা খাওয়াদাওয়া হয়,আর হয় পলাশী টু মেডিক্যাল হাঁটা,কখনো একেবারে টিএসসি পর্যন্ত। গভীর রাতে ভাবের দুয়ার খুলে যায় একেকজনের,বেঁচে থাকার মানে থেকে শুরু করে পাশের বাড়ির মেয়েটার চাহনি নিয়েও জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয়,সকালে একেবারে নাস্তা করে ঘুম। শেষ বর্ষে এসে রাত জাগার সাম্প্রতিকতম অজুহাতটা বের হয়ে গেলো,ব্লগ। সারারাত জেগে ব্লগে বসে থাকি,লিখি কম,ঐ জিনিসটা হাতে আসেনা,কিন্তু পাঠক হিসেবে রাক্ষস শ্রেণীর,যা পাই সবই পড়ি,কাজেই সময়টা একদম কম লাগেনা।

মন্তব্য করা,তর্কে জড়ানো,আর কিছুই না থাকলে,৩-৪ মিনিট পরে পরে পাতাটা রিফ্রেশ করা,কি জানি কোন লেখা চোখ এড়িয়ে গেলো! পরদিন ক্লাস,বাসায় মায়ের জন্য ঘুমানো যায়না,ততদিনে হলে ১টা রুম পেয়ে গেছি,সকালে বাসা থেকে গিয়ে হলের রুমে আরাম করে কিছুক্ষণ ঘুম,মাঝে মাঝেই ১ ঘণ্টার কথা ভেবে একদম ক্লাসটাইমও পার করে উঠি,বিচিত্র কি যে সবাই আমাকে লাস্ট ইয়ারে তেমন একটা দেখতোই না এতদূর লিখে অবশ্য মনে হচ্ছে,শুধু কি বই,অথবা নেটই রাত জাগার জন্য দায়ী? প্রভাবক হতেই পারে,কিন্তু আমার নিজেকেই তো রাতের নিস্তব্ধতা টানে,রাতের ছোট ছোট শব্দগুলো,হিম হিম ভাবনাগুলো,ভাবনার ঢেউগুলো,আর তারচেয়েও বেশি টানে রাতজাগা মানুষগুলো, কোথাও,কোন এক বিন্দুতে মিলে গেছে যে সবাই। দুঃখী মানুষই নাকি শুধু রাত জাগে,কিন্তু যাদের আমি দেখেছি,তাদের হাসিমুখের আড়ালে কি দুঃখ আছে,নাকি শুধুই নেশা,নৈঃশব্দের ডাকে প্যাঁচার মত জেগে থাকে এত এত প্রাণ? আমার মতই কি তারা কোন অজুহাত বের করে নেয়,কখনো বই,কখনো কোন সফটওয়্যারের অপর পারের না দেখা কেউ,কখনো বা ব্লগিং নামের আপাত অর্থহীন কোন কাজ? নাকি শুধুই রাতের টান,অন্ধকারের গান? রাত জাগা সাথীরা চলে যাচ্ছে আজকাল একে একে,মেসেন্ঞ্জারের অপর পারের অনেক বন্ধুকেই এখন আর দেখি না,হয়তো ব্যস্ততাকে অবলম্বন করে নৈশপ্যাঁচার জীবন থেকে মুক্তি খুঁজে নিয়েছে,বুয়েটের বন্ধুরাও এখন রাত জাগেনা, একটু পরে পরে "বাজ" বা "কিরে কই গেলি" শুনিনা,সকালবেলায় বসের ধাতানির ভয় তাদের আঁধারের গান শোনা থেকে সরিয়ে নিয়েছে। তবে কি এখন কেউ রাত জাগেনা? নিশ্চয়ই জাগে,অন্য কেউ,অন্য কোনখানে,শান্ত নিথরতায় লক্ষ্মীপ্যাঁচার মত খুঁজে বেড়ায় নিশাচর কাউকে,যেমন আমি খুঁজি। আমি তো এখনো জেগে আছি,কয়েকটা মশা,একগ্লাস পানি,রাতজাগা ট্রাকের ভেঁপু,আর সামনে জ্বলে থাকা পিসির মনিটর নিয়ে,কীবোর্ডে খটখট করে কয়েকটা অক্ষর ফুটিয়ে তোলার জন্য। সহৃদয় কেউ কি আমাকে আজ রাতের বাহু থেকে বের করে নেবেন? মানুষ ভোরে ওঠেনা বলে সূর্যোদয় দেখেনা,আর আমি প্রতি ভোরে সূর্যোদয় দেখি বলে ব্যস্ত মানুষের সূর্যাস্ত দেখিনা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.