আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ার গল্প

সত্য অথবা মিথ্যা দুটোই হতে পারে। বিশ্বাস করা আর না করা আপনার ব্যপার। আমি যখন অনেক ছোট তখন আমরা ডেমরার দিকে থাকতাম। সেখানে গিয়ে আমাকে চতুর্থ শ্রেনীতে ভর্তি করানো হয়। সেই এলাকার তখনকার একটা খুব খারাপ বৈশিষ্ট হচ্ছে সেখানে প্রায়ই গন্ডগোল লেগে থাকতো।

কখনো এই এলাকার সাথে অন্য এলাকার অথবা রাজনৈতিক কারনে। আমাদের বাসাটা ছিল একেবারে মেইন রোডের সাথে। ৫তলায় থাকতাম আমরা। তাই উপর থেকে প্রায়ই ওদের মারামারি চোখে পরত। ছুরি, চাপাতি, রামদা ইত্যাদি আরও অনেক কিছু নিয়ে মারামারি চলত।

সন্ধা হলেই সব বাসার গেট বন্ধ করে দেয়া হত। সাথে সাথে আম্মার টেনশন শুরু হত কখন ভাইয়ারা আসবে। এখন অনেক পাল্টে গেছে। দেখলে মনেই হয় না আগে এমন ছিল অবস্থা। যেহেতু ছোট ছিলাম আর মোস্ট বান্দর টাইপের ছিলাম তাই এগুলোতে আমার ছিল ব্যপক আগ্রহ।

মারামারি শুরু হলেই জানালার কাছে গিয়ে বসতাম। কিছুটা ভয়ও লাগতো। ঠিক এমন একটা এলাকায় এমন এক সময়ে আমার সেই ভাইয়াটার সাথে পরিচয় হয়। একদিন বিকালে পাশের বাসার ২টা পিচ্চির সাথে খেলা করছিলাম বাসার সামনে একটা ছোট মাঠ ছিল সেখানে। সন্ধার আগে পর্যন্ত খেলার অনুমতি ছিল বাসা থেকে।

নিজের মতো খেলছিলাম। আশে পাশের দিন দুনিয়ার কোন খবর ছিল না। হঠাৎ দারোয়ান কাকা তারাতারি এসে বললেন, বাসায় যাও। এখনো বাইরে কেনো? গেটের ভিতরে গিয়ে জানতে চাইলাম কি হইছে? কাকা বললেন এখন বাইরে মারামারি হতে পারে। বাসায় চলে যাও।

আমি তো মহাখুশি। ভাবছি এটাই সুযোগ। আজ মারামারি দেখবো। যা ভাবা তাই। উপরে না উঠে গেটের ফাকা দিয়ে তাকায় আছি।

কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিছুটা শব্দ শুনা যাচ্ছিলো। মাগরিবের আযান দেয়া হয়ে গেছে। এখন তো বাসায় যেতেই হবে। এতক্ষনে কিছু মাইর পাওনা হয়ে গেছে।

ঠিক এমন সময় কে যেন গেটে আওয়াজ করে ওঠে। কাকা জানতে চায় কে? একটা ছেলে বলে আমি। কাকা জলদি করে গেট খুলে ছেলেটাকে ভিতরে নিয়ে আসে। ছেলেটার হাতে বেশ অনেক খানি কেটে গেছে। রুমাল বাধা।

তারপরও রক্ত পরছে। কাকা ছেলেটাকে নিয়ে নিজের রুমে বসালেন। আমি ও অতিশয় আগ্রহের কারনে সেই রুমে যাই। ছেলেটা আমার থেকে অনেক বড়। তখন অনার্সে পড়ত।

আমি পাশে দাড়িয়ে দেখতে থাকি। কাকা ছেলেটার হাত পরিষ্কার করে বেধে দিচ্ছিলেন। ছেলেটা কোনও আওয়াজ করছিলো না কিন্তু তার মুখ দেখে বোঝা যায় যে অনেক কষ্ট হচ্ছে। ছেলেটা তখন আমাকে খেয়াল করে। জানতে চায়, তোমার নাম কি?বললাম আমার নাম।

তারপর আমিও জানতে চাইলাম, আপনার নাম কি?বলল তার নামটা। তারপর আমাকে বলল, তুমি বাসায় যাও নয়তো ভয় পাবা। কথাটা আমার খুব প্রেস্টিজে লাগল। আমি কেন ভয় পাবো?আমি কি ভীতু?সাথে সাথে বললাম,আমি কাওকে ভয় পাই না। তারপর বাসায় চলে আসলাম।

দেরি করার অপরাধে আম্মার হাতের একটা মাইরও মিছ হয় নাই। সেটার বিস্তারিত নাইবা বলি বুঝে নেন সবাই। তারপর থেকে দেখা হলে কথা হত ভাইয়াটার সাথে। ভাইয়াটাই কথা বলত আমার সাথে। আমারও ভাল লাগত।

কারন রাফ এন্ড টাফ চলাফেরা করত সেটা ভাল লাগত। সুন্দর করে কথা বলতে পারতো। আমার সাথে কথা বলতো যেভাবে একটা ছোট মেয়ের সাথে বলে। অনেকটা বড়দের মতো কথা বলত। রেগুলার কথা হত।

অন্যদের সাথে কথা বলার সময় আমাকে বলত, বল ঠিক বলছি কিনা অথবা এটা করলে কেমন হয় বলতো?মানে এমন ভাবে কথা বলত যেন আমার মতামতটা জরুরী। আমিও ডিসিশন দিতাম। কিছু না বুঝলে বুঝায় বলত। সত্যি বলতে কি ভাইয়াটাকে পেয়ে আমার মনে হত আমি বড় হয়ে গেছি। খেলাধুলা করা অনেক কমে গেল।

বিকাল হলেই বাসার কাছে কিছু কমন জায়গা ছিল যেখানে ভাইয়াকে পাউয়া যাবে। চলে যেতাম সেখানে। সেখানে ভাইয়া আর তার ফ্রেন্ডদের সাথে ক্যারাম খেলতাম। কার্ড খেলছি। ভাইয়া আমাকে জিতায় দিত খেলায়।

বাসায় কখনও ভয়েও বলি নাই ভাইয়াটার কথা। জানতাম বকা দিবে। মাঝে মাঝে আমাদের বাসার ছাদে আড্ডা দিত ওরা সবাই। আমিও ওদের সাথে ছাদে বসে থাকতাম। পানির টাংকির উপরে উঠতাম।

একদিন ভাইয়া সিগারেট খাচ্ছিলো। আমি বললাম আমিও খাব। ব্যস দিল ভীষন বকা। আমরতো অনেক খারাপ লাগলো। রেগে চলে আসলাম বাসায়।

আসার আগে অবশ্য তার সিগারেটের প্যাকেট সোজা সাত তলার ছাদ থেকে নীচে ফেলে দিলাম। ২দিন বের হলাম না বাসা থেকে। আম্মাতো অবাক। আমার মেয়ে এত ভদ্র হইলো কেমনে?আসল খবর তো আর জানেনা। ২দিন পর বের হয়ে ছাদে গেলাম।

দেখি কেউ নাই। বাসায় যাব তখন দেখি ভাইয়াটা ফ্রেন্ডদের সাথে ছাদে উঠতেছে। আমাকে দেখে দিল আবার বকা, পিচ্চি মেয়ে। এত রাগ তোমার?কি একটু বলছি ২দিন কোনও খবর নাই? আমিও রেগে কতখন বকাঝকা করলাম। ভাইয়া পরে সরি বলল।

পরদিন থেকে আবার আগের রুটিন। এই ভাইয়াটাই তখন আমার একমাত্র ফ্রেন্ড ছিল। নামেই ভাইয়া। মাঝে মাঝে ২/৪ দিন কোনো খবর নাই। পরে আসলে বলত, যখন বড় হবা, রাজনীতি বুঝতে পারবা তখন বুঝবা।

এখনতো তুমি পিচ্চি। তখনও বুঝি নাই। এখনও বুঝি না। অষ্টম শ্রেনীর পর আমাদের বাসা পাল্টানো হয়। বেশ দুরে চলে যাই।

যেহেতু সেই এলাকায় আমাদের রিলেটিভ থাকতো তাই প্রায়ই যাউয়া হতো। যোগাযোগ ঠিকই রাখতাম। গেলে দেখা হত। ভাইয়া বলত, পিচ্চি আপু তুমি চলে গেলা কেন?আমি এখন কার সাথে গল্প করবো বল? এভাবে চলতে থাকে। নতুন জায়গায় নতুন ফ্রেন্ড,নতুন ভাবে মানিয়ে নেই।

একসময় ভার্সিটিতে ভর্তি হই। তখন ফোনে কথা হত। নিয়মিত কথা হত। ততদিনে ভাইয়া চাকরিতে জয়েন করে। ২বছর আগে একদিন বলে বিদেশে একটা জবের অফার আছে।

আমি বললাম তাহলে চলে যান। ভাল সুযোগ পেলে এখানে থাকার দরকার কি?ভাইয়া তখনও হেসে বলেছিল,তুমি এখনও পিচ্চি তাই বুঝতে পারছ না। বুঝবা বলে মনেও হয় না। তারপর সোমবার ভাইয়া আমাকে সন্ধার সময় আমাকে কল করে। বলে,আমি তোমাকে না বলে একটা কাজ করে ফেলেছি।

জানতে চাইলাম। তারপর বলল,আমার বিয়ে হয়ে গেছে গতকাল। মেয়েটার নাম মারিয়া। আমার একটু খারাপ লাগলো। ভাইয়াটার বিয়ে হয়ে গেল আর আমাকে জনালো না একবার।

সেদিন সবচেয়ে বেশি সময় কথা হয় ভাইয়ার সাথে। অনেক কথা হল। কিন্তু মারিয়াকে নিয়ে কোন কথার উত্তর দিল না। জানাল ভাইয়া বিদেশে চলে যাবে। অনেকখন কথার পর রেখে দেই।

তখনও জানতাম না এটাই আমার শেষ কথা ভাইয়ার সাথে। এরপর আর কখনও সেই নাম্বারটা খোলা পাইনি। বাসার ঠিকানা জানতাম না। কিছুদিন পর তার এক ফ্রেন্ডের কাছে শুনলাম ভাইয়া বিদেশে চলে গেছে। খুব খারাপ লাগছিল ভাইয়াটার জন্য।

আমি আজও জানিনা কি হয়েছিল যার জন্য ভাইয়া এমন করলো। আমরা সবসময় সমস্যা থাকলে শেয়ার কর‌্তাম। কিন্তু হঠাৎ করেই আমার ভাইয়াটা হারিয়ে গেল। আশা করি যেখানেই থাকুক ভাইয়াটা খুব ভাল থাকুক। হয়তো কোনও একদিন ভাইয়া তার পিচ্চি আপুর সাথে আবার কথা বলবে।

কারন তার এই পিচ্চি আপুটা তাকে কখনও ভুলবে না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।