আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৯)

অন্য রকম একটা জীবনের স্বপ্ন আমার আজও গেল না..............

এ.এস.এ. কলেজের প্রথম ক্লাসে পরিচয় হলো মনসুর ভাইয়ের সাথে। ক্লাসে ঢুকেই দেখি মাত্র একজন বসে আছে। আমি একটু তাড়াতাড়িই গিয়েছিলাম ঐদিন। টুপি পরা, মুখে দাড়ি। আমাকে দেখেই বললেন "ভাই কি বাংলাদেশী?" ব্যাস আর লাগে কি? শুরু হলো আড্ডা।

এর একটু পরেই আসলেন এজাজ ভাই। উনি আমাদের চেয়ে বেশ সিনিয়র। বিয়ে করেছেন। বাচ্চা আছে। কয়েকদিন পরে আসলেন সরোয়ার ভাই।

উনারা তিনজনই আমেরিকার সিটিজেন। আমরা ছিলাম চারজন চার বয়সের। কিন্তু বন্ধুত্ব হতে দেরী হয়নি। এটা সম্ভবত একমাত্র দেশের বাইরেই সম্ভব। তিনজনই কাজ করেন ফুল টাইম।

উইক-এন্ড এ কলেজ। সিটিজেন হওয়ার কারণে সবাই গ্র্যান্ট পান সরকারের কাছ থেকে। তাই টিউশন ফিস এর জন্য এক টাকাও পকেট থেকে যায় না। আমি কানেকটিকাট থেকে সেই ভোরবেলা রওয়ানা দিয়ে আসি শোনার পর থেকে এজাজ ভাই প্রতিদিনই ভাবির রান্না করা কিছু না কিছু নিয়ে আসতেন আমার জন্য। সবাই মিলে তা খেতাম।

যেই দিন আনতে না পারতেন ঐদিন সবাই মিলে বাইরে খেতাম। আমি কি অবস্থায় থাকি তা উনারা সবাই জানেন। তাই বাইরে খেয়ে বিল শেয়ার করতে রীতিমত কুস্তি করতে হত আমার। বলাই বাহুল্য তিনজনের ট্যাগ টিমের সাথে সেই কুস্তীতে আমি খুব কম সময়ই জিততে পেরেছিলাম। আরো কিছুদিন পর পরিচয় হলো মাসুদ ভাইয়ের সাথে।

শাহজালাল ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স করা। এসেছিলেন মাস্টার্স করতে, ভাগ্যের ফেরে আজ এখানে। একসময়ে ছাত্রদলের হয়ে সক্রিয় রাজনীতি করা হাসি খুশি মাসুদ ভাইয়ের হাসি আজ যেন অনেকটাই মলিন। এ.এস.এ কলেজ, কলেজ হিসাবে তেমন ভালো না। আমাদের মত ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট যারা এখানে পড়ে সবাই পড়ছে টিউশন ফিস একটু কম হওয়ায় আর রেগুলেশন অন্যান্য কলেজের তুলনায় একটু শিথিল হওয়ার কারণে।

কোরিয়ান, জাপানিজ, চাইনিজ, রাশিয়ান, তাজিক, কাজাক, টার্কিশ, নেপালি, ইন্ডিয়ান কত জাতির ছেলে-মেয়েদের সাথে পরিচয় হলো। শুধু মুখের আদল আর গায়ের রং টা আলাদা। অবস্থা, কাহিনী সবার একই। প্রত্যেকেই ভালো কোনো ইউনিভার্সিটিতে এসেছিল। পরে খরচ পোষাতে না পেরে এখানে এসেছে।

মোটামুটি সবারই স্বপ্ন টাকা-পয়সা জমিয়ে একটু গুছিয়ে উঠতে পারলেই ভালো কোনো কলেজ অথবা ইউনিভার্সিটিতে চলে যাবে। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, কেউই আর গুছিয়ে উঠতে পারে না । সবার অবস্থা একই হওয়ার কারণে এখানে ইন্টিমেসিটা ভালো হয়। এদের মধ্যে তুরস্কের উমুত, উমা আর কাজাক্স্থানের কামোলার সাথে আমার দারুন বন্ধুত্ব হয়েছিল। প্রথম সেমিস্টারের শেষের দিন আমরা ছোটো খাটো একটা মজার পার্টি করেছিলাম।

সুমি আপুও আমার সাথে একই সেমিস্টারে এডমিশন নিয়েছিলেন কিন্তু রেজিস্ট্রেশন পরে করায় আর একসাথে ক্লাস নিতে পারেননি। মাঝে মাঝে দেখা হত ওনার সাথে। ফোনে কথা হয় সব সময়ই। চৈতী এডমিশন নিল লাগার্ডিয়া কম্যুনিটি কলেজে। কাজ যোগাড় করতে না পারায় রাজীব কলেজের টিউশন ফিস দিতে পারল না এক সেমিস্টারের।

আউট অফ স্ট্যাটাস হয়ে গেল আমেরিকায় আসার এক বছরের মধ্যেই। রাজিবের সাথে আজকাল দেখা হয় খুব কম। কেন যেন ও নিজেই দেখা করতে চায় না। একটু দুরে দুরে থাকে। আমি বুঝি কেন।

এদিকে দুই স্টেটে চলতে থাকলো আমার সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই রকম জীবন। নিউ ইয়র্কের দুইদিন যায় চরম ব্যস্ততায়। সকালে উঠে বাস ধরা, তারপর ক্লাস করা সারাদিন, থাকার জায়গা কনফার্ম করা, সন্ধায় অর্ণব আর শিবলীর সাথে ঘোরাঘুরি, কোনমতে রাত্রে ঘুমিয়ে আবার সকাল থেকে সারাদিন ক্লাস। অত:পর বাস ধরিয়া মর্দের কানেকটিকাটে প্রত্যাবর্তন। কানেক্টিকাটের জীবন অনেকটাই শান্ত।

আমি আর ইমেল ভাই দুই জন এটাচড দুই রুমে থাকি। শনি, রবি আমার ক্লাস আর সোম, মঙ্গল, বুধ ইমেল ভাইয়ের ক্লাস। এই তিন দিন উনি থাকেন নিউ হ্যাভেন সিটিতে। দুই দিন একসাথে পাওয়া যায়। আড্ডা, রান্না, সব এই দুই দিনেই।

কিছু দিন পর কানেকটিকাটে বোর হয়ে গেলাম। গাড়ি না থাকায় আমরা তেমন কোথাও যেতে পারতাম না। মাঝে মধ্যে ম্যানেজারের সাথে আশে-পাশে যেতাম উনি ফ্রি থাকলে, এতটুকুই। এছাড়া ইমেল ভাই, মানু কাকার সাথে আড্ডা দিয়েই দিন পার হত। একদিন বিকাল বেলা হটাত মানু কাকা ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে ফোন দিলেন আমাদের রুমে।

বললেন বাইরে এস একটু। তোমাদের মতই এক স্টুডেন্ট এসেছে। কয়েক মাস থাকবে এখানে। ওর সাথে অনেক জিনিস পত্র। ওকে একটু হেল্প কর।

আমি আর ইমেল ভাই ভাবলাম আরি বাপরে কি জানি বড়লোক। মোটেলে থেকে পড়াশুনা করবে !!!!! গেলাম বাইরে। ইন্ডিয়ান এক ছেলে। ৬ ফুট লম্বা। নিজের গাড়ি নিয়ে এসেছে।

গাড়ি ভর্তি রাজ্যের জিনিস পত্র। কি নেই তাতে.....টয়লেট পেপার থেকে শুরু করে ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, ওভেন, চেয়ার সব। আমরা ভাবি এ কি অবস্থা !!!!! ও একটা ডাবল বেডের রুম নিয়েছিল। সব জিনিস রাখার পরে একটা বেড ছাড়া আর পা ফালানোর জায়গা পর্যন্ত ছিল না। একটু গুছিয়ে নিয়ে আমাদের অনেক থ্যান্কস দিল হেল্প করার জন্য।

বলল কোনো দরকার হলে ওকে বলতে। ওর রুম ছিল আমাদের একদম পাশেরটাই। এইভাবেই পরিচয় হলো হারদিক পাটেলের সাথে। ইউ.এস.এ তে ইমেল ভাইয়ের পরে যদি কাউকে ভালো ফ্রেন্ড বলতে পারি তাহলে হারদিককে বলতে হবে। মানু কাকা একটু ভুল বলেছিলেন।

হারদিক আমাদের মতই ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ছিল দেড় বছর আগেও। এখন এইচ১বি ভিসায় আছে। সফটওয়ার প্রোগ্রামার। জব করছে কগনিজেন্ট নামে একটা কোম্পানিতে। মাত্র টেনেসি থেকে এখানে ট্রান্সফার হয়ে এসেছে।

থাকার কোনো জায়গা ঠিক করতে পারেনি তাই আপাতত মোটেলে উঠেছে। ইন্ডিয়ানরা সাধারনত একটু সেলফিশ আর কিপ্টা টাইপ হয়। ও একদম বিপরীত। পাশাপাশি রুমে থাকার কারণে আর হারদিকের নিজের বৈশিষ্ঠের কারণে আমাদের সাথে গলায় গলায় পিরিত হতে বেশি দেরী হলো না। কানেকটিকাটে আসার প্রায় চার মাস পর শুরু হলো আমাদের ঘোরাঘুরি।

ও জব থেকে আসার পর সন্ধায় অথবা সামারের ছুটিতে শনি, রবিবার। স্টুডেন্ট ভিসার কিছু গলি ঘুপচিও ওর কাছ থেকে জানলাম। হারদিক আসার পর আমার আর ইমেল ভাইয়ের লাইফ অনেকটাই সহজ আর রঙিন হয়ে উঠলো। হারদিক তিন মাস আমাদের মোটেলে ছিল। এখন এপার্টমেন্ট শেয়ার করে থাকে।

এখনো প্রায় রাত্রেই দেখা যায় ও আমাদের সাথে থাকতে আসে। হারদিকের নতুন জব হয়েছে। আর কয়েকদিন পরেই চলে যাবে নর্থ ক্যারোলিনা। আমার আর ইমেল ভাইয়ের জন্য কানেকটিকাট হয়ে যাবে আবার ফাঁকা আর রসকষহীন। কিছুই করার নেই।

এটাই জীবন.....আমেরিকার জীবন। (চলবে) অন্যান্য পর্ব: আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৩) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৪) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৫) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৬) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৭) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৮) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৯) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১০) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১১) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১২) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৩) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৪) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৫) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৬) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৭) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৮) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৯) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২০) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২১) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২২) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৩) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৪) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৫) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৬) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৭) আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৮)


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।