আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রেডিওর গুরুত্ব: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ



রেডিও একটি অতি সাধারণ গণমাধ্যম। বাংলাদেশের বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ১৯০১ সালে রেডিও আবিস্কার করেন। প্রায় সমসাময়িক সময়ে বিজ্ঞানী মার্কনী রেডিওর মাধ্যমে তথ্য প্রেরণ করতে সক্ষম হন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও রেডিও দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, স্বাধীনতা অর্জন, মন-মনন বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদেশে রেডিও প্রথমদিকে ব্রিটিশ সরকার এবং নবাব-জমিদারদের কাজে বেশী ব্যবহৃত হত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খবর জানার জন্য সারা পৃথিবীতেই সৈনিক এবং সাধারণ মানুষের জন্য রেডিও ছিল একমাত্র মাধ্যম। বাংলাদেশে রেডিওর গুরুত্ব যখন যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে তা নীচে উল্লেখ করা হলোঃ ১) ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পর। ২) ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময়। এসময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ জনগণকে উজ্জীবীত করতে রেডিও মারফত ভাষণ দেন। ৩) বিশ্বকাপ ফুটবল ও পাক-ভারতসহ ক্রিকেট খেলার ধারাভাষ্য শোনা।

এসময় পর্যন্ত অভিজাত ও উচ্চবিত্তরাই রেডিও শুনতেন। ৪) ১৯৬৯ সালের গনঅভ্যুত্থান। ৫) ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন। এসময় সাধারণ মানুষ রেডিও শোনায় বেশী মাত্রায় আগ্রহান্বিত হয়ে উঠেন। কারণ ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালের আন্দোলন, সংগ্রাম ও নির্বাচনে ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করে।

৬) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ। মূলত রেডিওর ব্যবহারে এ বছরই ব্যাপক বিপ্লব সৃষ্টি হয়। ক) ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, খ) কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে আওয়ামীলীগ নেতা হান্নান ও মেজর জিয়ার উপর্যুপরি স্বাধীনতার ঘোষণা জাতীয় ও আন্তুর্জাতিক পর্যায়ে রেডিওর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। গ) তাছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত অনুষ্ঠান, ঘ) আকাশবানীর খবর এবং বিবিসির বাংলা সার্ভিস শোনার জন্য শত শত মানুষের জড়ো হয়ে শোনার দৃশ্য অনেকেই মনে করতে পারেন। এ সময়ে রেডিওর সংখ্যা অল্প হলেও গ্রামের সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক সকলেই মুক্তিযুদ্ধের খবর শোনার জন্য যার বাড়িতে রেডিও থাকত সেখানে জড়ো হতো।

আমার মায়ের কাছ থেকে শুনেছি- বড় মামা মামা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং ঐ গ্রামে নানার বাড়িতেই একটি রেডিও ছিল। ফলে সকলে ছুটে আসতেন খবর শোনার জন্য। পাকিস্তানী হানাদাররা খবর পেয়ে রেডিওর খোজঁ করতে আসলে সেটা খড়ের গাদায় লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ও বিবিসির সংবাদকে এমনই ভয় পেত। একটি জাতি গঠনে রেডিওর এ প্রভাব ও ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

৭) মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ বেতার-এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান। ক) জন্মনিয়ন্ত্রণের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রেডিওর মাধ্যমেই সহজে বোঝানো গিয়েছিল। খ) কৃষকদের জন্য অনুষ্ঠান গ) শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ঘ)রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীত ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ঙ) ধর্মীয় আলোচনা চ) বিভিন্ন সময়ের ক্রিকেট ও ফুটবল খেলা ছ) নাটক, যাত্রা পালা জ) সিনেমার গান ইত্যাদি। রেডিওর এই গুরুত্বপূর্ণ অবদানের ক্ষেত্রে নাটক, কৃষিশিক্ষাসহ অন্যান্য শিক্ষামুলক অনুষ্ঠান উল্লেখযোগ্য। আমার মনে আছে ছোট বেলায় আমাদের বাসার রেডিওতে নাটক শোনার জন্য দুপুরের খাবার পর আশে পাশের আত্মীয়-স্বজনেরা ভিড় করতেন।

রেডিও থাকার জন্য এভাবে সামাজিক গুরুত্ব বেড়ে যেত বলে এক সময় গ্রামাঞ্চলে যৌতুক হিসেবে রেডিওর দাবী করা হতো। ৮) ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং নভেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। ৯) ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যা, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক শাসন জারি। ১০) বিবিসির সংবাদ- ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে বিবিসির সংবাদ শোনার জন্য সারা বাংলাদেশে মানুষ রেডিওর উপর নির্ভর করে। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ বা ২০০১ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলনেও বিবিসির সংবাদ শোনার উপর মানুষের আগ্রহ বেশী ছিল।

অনেক সময় দেখা গেছে মফস্বল শহরে ঢাকা থেকে কোন সংবাদ না পৌঁছানোর কারণে বিবিসির সংবাদ শুনেই রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল বেরিয়ে যেত। ৯) ১৯৯৯ সালের এসিসি কাপ ক্রিকেট ফাইনালের খবর শোনার জন্য রেকর্ড পরিমান একব্যান্ডের ছোট রেডিও বিক্রি হয়েছিল। ১০) তাছাড়া ১৯৮৫, ১৯৯১, ২০০৭ সালের ঘূর্নিঝড় এবং ১৯৮৭, ১৯৮৮ ও ১৯৯৮-এর বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে এটা মানুষের অনেক প্রয়োজনে লাগে। ধীরে ধীরে রেডিওর বদলে আসে টু-ইন-ওয়ান, ত্রি-ইন-ওয়ান, টেলিভিশন, ভিসিআর, ডিশ এন্টেনা, টিভি চ্যানেল ইত্যাদি। বহু পূর্বে রেডিওর জন্য লাইসেন্স নেয়ার প্রয়োজন হলেও এখন আর তার দরকার নেই।

এতকিছুর পরেও এখনও রেডিওর ভূমিকা একেবারেই কমে যায়নি। এখনও হলে বা হোষ্টেলে অলস দুপুরে ছাত্রদেরকে একব্যান্ড রেডিও কানে নিয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। মেট্রোপলিটান শহরে এফ এম ব্যান্ড এখনও প্রায় সব গাড়িতেই বাজে। গ্রামে যার টেলিভিশন নেই তার রেডিওই ভরসা। উপকূলে মাঝিদের একঘেয়ে সমুদ্রজীবন চালিয়ে নেয় রেডিও।

নাইটকোচে বা ট্রাকের ড্রাইভার, হেলপারদের কাছে রেডিও এখনও বিনোদনের অপরিহার্য মাধ্যম। যদি আবারও ১৯৯০ এর মত স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের উদ্ভব হয় তবে রাস্তার মোড়ে মোড়ে রেডিওর খবর শোনার জটলা যে আবারও শাসকদের ভাবিয়ে তুলবে তা যে কেউ বুঝতে পারে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.