আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এফএম রেডিওর অনুষ্ঠান ও তরুণ প্রজন্ম

অন্যায়ভাবে সংঘটিত সকল বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাই । ।
আমাদের গণমাধ্যমের সর্বশেষ সংযোজন এফএম রেডিও। বলা যায় অল্প সময়ের মধ্যেই এই মাধ্যমটি মোটামুটি একটি ভালো অবস্থানে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। দেশে এখন বেসরকারি এফএম রেডিওর সংখ্যা চার।

অনুমোদনের দিক থেকে এবিসি রেডিও সবার আগে হলেও সম্প্রচারে সবার আগে এসেছে রেডিও টুডে। এই রেডিওটির পরপরই আসে রেডিও ফূর্তি। শুরুতে শুধু ঢাকার মধ্যে প্রচার সীমাবদ্ধ থাকে এগুলো। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম এবং সিলেটেও সম্প্রচার শুরু হয় যা এখনও চলছে। ফূর্তির পরেই আসে রেডিও আমার এবং সর্বশেষ আসে সবার আগে অনুমোদন নেওয়া এবিসি রেডিও।

তরুণদের ‘টার্গেট’ করে রেডিওগুলো সাজিয়ে নেয় তাদের অনুষ্ঠানমালা। তরুণদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় খুব দ্রুতই। হারিয়ে যাওয়া রেডিও সংস্কৃতি আবার ফিরে আসে। নতুনরূপে আসা রেডিওগুলোর মাধ্যমে আমরা পরিচিত হয়ে উঠি নতুন কিছু শব্দের সঙ্গে। ‘জনপ্রিয়’ হয়ে ওঠে বেশকিছু শব্দ।

যেমন- আরজে (রেডিও জকি), ফ্যান, জোস, জটিল, ব্যাপক, লিসেনার ইত্যাদিসহ বাংলা-ইংরেজির মিশেলে অন্যরকম এক টোনের অনেক শব্দ। এই রেডিওগুলো তাদের টার্গেট শ্রোতা হিসেবে ধরেছে একবারেই শহরকেন্দ্রিক তরুণদের। রেডিওগুলোর কর্মকর্তাদের মতে, এই শ্রোতাদের বয়স ১৫ থেকে ৩২ বছর। অর্থাৎ যে বয়সটা শেখা, ভাবা এবং কিছু করার চেষ্টার। আমাদের এ বেসরকারি রেডিওগুলোর শুরুটা হয় শুধু গান দিয়ে।

পরবর্তীতে যুক্ত হয় সংবাদ, ট্রাফিক আপডেট এবং বিভিন্ন তাৎক্ষণিক (স্পট) সংবাদ। তা অবশ্য রেডিও ফুর্তি বাদে। ফুর্তি দাবি করে তারা দেশের একমাত্র মিউজিক সঙ্গীতনির্ভর। তবে গান নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই রেডিওগুলো এমন সব গান নির্বাচন করে যা বেশিরভাগ সময় তাদের টার্গেট শ্রোতদের আকর্ষণ করে বা ভালো লাগে। তবে এই ভালো লাগার স্থায়িত্ব হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না আরেকটি গান বাজতে শুরু করে।

অর্থাৎ এই গানগুলোর ভালো লাগার স্থায়িত্বকাল শুধু যতক্ষণ শোনা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত। অতএব স্পষ্টতই টের পাওয়া যায় এ রেডিওগুলো তাদের টার্গেট শ্রোতাদের, আগেই বলেছি যাদের এখন শেখা, ভাবা এবং কিছু করার চেষ্টার সময় তাদের কি গান শোনাচ্ছে কিংবা শুনতে বাধ্য করছে। বাধ্য করছে বলার কারণ হচ্ছে, রেডিওগুলো এসব গানের বাইরে অন্য কোনো গান তেমন একটা বাজায় না বলে। কখনো কখনো যদি কোনো রেডিও দুয়েকটি মৌলিক তথা আমাদের শেকড়ের গান বাজায়ও তা আর কয়েক সপ্তাহে বাজে না ওই রেডিওতে। আর এই কারণেই এসব গানকে তরুণেরা লালন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, হচ্ছে প্রতিনিয়তই।

রেডিওগুলো শ্রোতাপ্রিয়তা হারাবে এমন ধারণা থেকেই হয়তো আমাদের কালজয়ী শেকড়ের গানগুলো থেকে তরুণ পজন্মকে প্রতিনিয়তই বঞ্চিত করছে। এটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য সুখকর সংবাদ হতে পারে না। এ তরুণরা অবশ্যই দেশকে ভালোবাসে, তাই তারা দেশের সংস্কৃতিকেও ভালোবাসে অবশ্যই। কিন্তু আমাদের এফএম রেডিওগুলো ভুলে যায় এজন্য অভ্যাস সৃষ্টি করাও একটা দায়িত্ব। এর বাইরে এটাও ভয়ংকর রকমের সত্য, আমাদের শেকড়ের গানগুলো এফএম রেডিওতে না বাজলেও বিদেশী গান বিশেষ করে হিন্দী গান বাজে প্রতিনিয়তই।

তবে একটি স্টেশন সপ্তাহের একটি বিশেষ অনুষ্ঠানেই শুধু বিদেশী গান বাজায়। তাহলে বলাই যায় সপ্তাহের অন্তত একটি অনুষ্ঠানে আমাদের মাটি, শেকড়, ইতিহাস-ঐতিহ্যের গানগুলো বাজানো যেতেই পারে। যদিও ওই গানগুলোর জন্য এভাবে বলতে হচ্ছে এটাই দুঃখজনক বিষয়। দুঃখজনক এজন্যই যে, আমাদের গণমাধ্যমে আমাদের গান বাজবে সেজন্য আবার বিদেশী গানের সঙ্গে তুলনা করতে হয় বলে। অবশ্য এ বিষয়ে কিছু সঙ্গীত বোদ্ধাকে বলতে দেখা যায়, ‘ গানের কোনো দেশ নেই।

’ এটা কেমন কথা! গান কি আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয়? যদি তা হয়ে থাকে তাহলে সেসব বোদ্ধার তো জানার কথা একটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রাম এবং জীবন ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়েই নির্মাণ হয় সেদেশের সংস্কৃতি। আর এই সংস্কৃতির দেশ নেই একথা কিভাবে বলা সম্ভব। অন্যভাবেও যদি বলি, তাহলে বলতে হয় গানকে যদি কেউ ভাষার আদলেই মূল্যায়ন করতে চান তবে তাকে এটা মনে রাখতে হবে যে, ভাষার জন্য সংগ্রামের দৃষ্টান্ত আমাদেরই আছে। তাই বলা প্রয়োজন বিদেশী গান আমরা শুনবো তবে দেশের গানকে উপেক্ষা করে নয়। এসব কথার পরেও বলতে হচ্ছে, রেডিওগুলো এসব বিদেশী গানকে প্রতিনিয়ত আমাদের তরুণদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলছে দেশের গানকে উপেক্ষার মধ্য দিয়েই।

তাদের কাছে বিষয়টি অপরাধ বোধের নাও হতে পারে। কারণ, এসব রেডিওর ‘আরজে’রা যেভাবে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে অশুদ্ধভাবে কথা বলে তাতে তাদের কাছে ভাষার জন্য ভালোবাসা বা ভাষার মৌলিকত্বের জায়গাটি অসম্পূর্ণ বলা যেতেই পারে। এখানেও একশ্রেণীর ‘প্রগতিশীল ও আধুনিক’ ব্যক্তি রয়েছেন যারা বলেন, আধুনিকতাকে স্বাগত জানাতে পারে না এমন ব্যক্তিরাই এসবের বিরোধিতা করে। তাদের উদ্দেশ্যে বেশি কিছু বলার মানেই হয় না। তাদের শুধু এটুকুই বলব- কোনো জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে বেমালুম ভুলে থেকে কি আধুনিক হওয়া যায়? যদি হওয়া যায় তবে সেটা আপনারাই হোন।

দয়া করে জনগোষ্ঠীর সম্ভাবনাময় একটি বিশাল অংশকে বিপথগামী করবেন না। আমাদের এই রেডিওগুলো রাতেও থেমে থাকে না। মধ্যরাত/সারারাত পর্যন্ত চলতে থাকে এগুলোর অনুষ্ঠান আর এসএমএস বাণিজ্য। অনুষ্ঠান মাঝে মধ্যে হয়ে ওঠে যৌন সুড়সুড়ানিময়ও। সম্প্রতি একটি রেডিওর রাতের একটি অনুষ্ঠানে একজন ‘আরজে’ একটি তথ্য তুলে ধরেন এভাবে, ‘বন্ধুরা তোমাদের জানিয়ে দেই একটি বিশেষ সংবাদ।

বলিউডের নায়িকা........একটি অপারেশন হয়েছে। নাহ! মোটেও টেনশনের কারণ নেই সে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। এই নায়িকার ব্রেস্টে ডাক্তাররা একটি জটিল সার্জারি করেছেন। আর ডাক্তাররা এই কাজ শেষ করেছেন মাত্র ১৪ মিনিটে। বন্ধুরা আমি ভাবছি ডাক্তাররা এই অপারেশনটি কিভাবে এত দ্রুত শেষ করলো, আমি হলে তো ১৪ ঘন্টাতেও শেষ হতো না।

’ এই হচ্ছে রাতের অনুষ্ঠানের একজন আরজের বক্তব্য। অন্য একটি রেডিওর একটি অনুষ্ঠান একজন শ্রোতা সরাসরি টেলিফোনে যোগ দেয় ওই অনুষ্ঠানের ‘আরজে’র সঙ্গে। আর ‘আরজে’ তাকে জিজ্ঞেস করে, প্রিয় নায়িকা কে? এই প্রশ্নের উত্তর থেকে কারণ জানতে গিয়ে শ্রোতাকে এমন এক উত্তরে নিয়ে পৌঁছানো হয়েছে যেসব কথা আমাদের দেশের কোনো মেয়েই এখনো তার সম্পর্কে এবং কোনো মেয়ের সম্পর্কে তার সামনে কেউ বলবে আর সে শুনতে মোটেও প্রস্তুত নয়। এই একই রেডিওতে মধ্য রাতে ভালোবাসাকেন্দ্রিক একটি অনুষ্ঠান হয় যেটাকে তারা ভালোবাসার প্রোপোজ প্রোগাম হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এ অনুষ্ঠানের দুই ‘আরজে’র পাশাপাশি থাকেন একজন ভালোবাসার গুরু।

এই গুরুই সমাধা দেন ভালোবাসা সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যার। ‘আরজে’রা থাকেন ‘ভালোবাসার ডাক পিয়ন হয়ে। ’ স্টুডিওতে এসে হাজির হন একজন তরুণ-তরুণী যে তার ভালোবাসার গল্প বলে। যদিও এই গল্প বলার সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সে যাই হোক গল্প তো বলে।

আর গল্প যখন জীবন ঘনিষ্ঠ, তখন সত্য অসত্য নিয়ে কথা না বলাই ভালো। আর আমাদের অসচেতন তরুণরা এই গল্প শুনেই বুদ হয় প্রতিনিয়ত। এ অনুষ্ঠানটি নিয়ে ইতোমধ্যে অভিভাবক মহল থেকে নেতিবাচক বক্তব্য আসতে শুরু করেছে। কিন্তু কি লাভ! অভিভাবকরা তো আধুনিক নয়! তারা বললেও কি না বললেও কি। এরকম বহু কর্মযজ্ঞই পার পেয়ে যাচ্ছে আধুনিকতার দোহাই দিয়ে।

হায়! আধুনিকতা। রাতের অনুষ্ঠানের এই ‘আরজে’দের এমন বক্তব্যের কারণ সবার কাছেই স্পষ্ট। কিন্তু আমাদের কাছে স্পষ্ট নয় একটি শ্রেণীকে এভাবে পথভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্য কি। লেখক: আহম্মদ ফয়েজ সূত্র/সংগ্রহ: সাপ্তাহিক বুধবার(সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিকাশের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ)-২১তম সংখ্যা;৩ ফেব্রুয়ারী ২০০৯ বি:দ্র: আমি পিসিতে সাধারনত ছবি আঁকি না বা পারি না। তাও, লেখার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ওয়ার্ডে একটা ছবি একে ইমেজে দিয়ে দিলাম।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।