ক্ষমতার আধিপত্য, বন্টনের বিবর্তন
ফকির ইলিয়াস
----------------------------------------------------
ক্ষমতার আধিপত্য কার কাছে থাকবে? শাসক শ্রেণীর কাছে, নাকি জনগণের হাতে? এ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শীতল স্নায়ুযুদ্ধ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই যে টানাপড়েন, তা কিন্তু নতুন নয়। অতীতেও হয়েছে। তখন রাজনীতিকরা ক্ষমতায় ছিলেন। এখন অরাজনৈতিক নেতৃত্ব রাষ্ট্রক্ষমতায়।
তারপরও অনেকে মনে করছেন প্রবাহিত হচ্ছে একই ধারাবাহিকতা।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার চাইছে। নিবন চাইছে। প্রতীক বন্টনেও তাদের নিজস্ব মতামত চাপাতে চাইছে। সর্বোপরি রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্র বিষয়েও নানা কথা বলতে চাইছে।
এরই নাম পরিশুদ্ধ সংস্কার কি না তা স্পষ্ট নয় এখনও। তবে ক্ষমতায় দীর্ঘমেয়াদি আধিপত্য ঘটানোর একটা চেষ্টা পরিলক্ষণ করছে জনগণ। তা সার্বিক কল্যাণে হলে কোন কথা ছিল না। কিন্তু এর কোন লক্ষণ এ পর্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি সরকারপক্ষ। বরং তাদের নানা দ্বিধাগ্রস্ত সিদ্ধান্ত জনগণকে আবারও ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারের দিকে।
একটি সিদ্ধান্তে দেশের সবকটি রাজনৈতিক দলই ঐক্য পোষণ শুরু করেছে। জামায়াতের সঙ্গে তারা কোন জাতীয় সংলাপে পাশাপাশি বসবে না। কিন্তু বর্তমান সরকারের একটি মহল জামায়াতিদের সঙ্গে তাদের দহরম মহরম প্রায় প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। এটা তারা না করলেও পারতেন। কিন্তু তাদের স্বরূপ প্রকাশ করে তারা জাতিকে জানিয়ে দিয়েছেন, এখনও রাজাকারদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে এক শ্রেণীর পোশাকি সুশীল দেশে তৎপর।
বাংলাদেশে অতি সম্প্রতি আবার নরঘাতকদের বিচারের দাবি সোচ্চার হওয়ার পর নানাভাবে গণমানুষের চোখে ধুলো দেয়ার জন্য একটি শ্রেণী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এরা এই সুযোগে একাত্তরের কায়দায় বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র হননে নেমেছে এবং দেশের কিছু পত্রপত্রিকা এদের লেখাকে প্রশ্রয় দিয়ে ছাপাচ্ছে নির্দ্বিধায়।
সম্প্রতি একটি চক্র বিশিষ্ট লেখক, শাবি’র প্রফেসর ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের চরিত্র হননে নেমেছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ড. জাফর ইকবাল নাকি তার স্ত্রী, প্রফেসর ইয়াসমীন হকের জন্য অবৈধ তদবির করেছেন। কতটা মিথ্যাচারী হলে এমনটি বলা যেতে পারে? জাফর-ইয়াসমীন দম্পতি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন।
তারা চাইলে ইউরোপ-আমেরিকার যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করতে পারতেন খুব সহজে। একজন প্রবাস ফেরত শিক্ষক হিসেবে ড. জাফর ইকবাল বাংলাদেশে নজির সৃষ্টি করেছেন। তার অপরাধ তিনি রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে কথা বলেন।
এই চক্র ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক মুনতাসির মামুনসহ দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটনা অতীতেও করেছে, এখনও করছে। পরিতাপের কথা, বর্তমান অরাজনৈতিক সরকারের একটি মহলের প্রচ্ছন্ন সমর্থন এদের এ সময়েও কিছুটা বেপরোয়া হতে সাহায্য করছে।
এটাও কি তবে ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তারের একটি মতলবি কৌশল?
দুই.
একটি জাতীয় সাপ্তাহিকের একটি রিপোর্ট পড়ে আমার রীতিমতো হাসি পেয়েছে। ‘পলাতক রাজনীতিক-ব্যবসায়ীরা কে কোথায়’ শিরোনামে এ রিপোর্টে বেশ ক’জন পরিচিত ব্যক্তির বর্তমান অবস্খান তুলে ধরা হয়েছে।
এর মধ্যে ভারতে অবস্খান নিয়েছেন বেশ কিছু রাজনীতিক। যারা এক সময় ভারতবিরোধী নানা কৌশলী, বানোয়াট, মিথ্যা কথা বলে মাঠ গরম রাখতেন। হারিছ চৌধুরী, শাজাহান সিরাজ, রাশিদুজ্জামান মিল্লাত, বরকতউল্লা বুলু, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবীর খোকন, শাহরিন ইসলাম তুহিন, হাওয়া ভবনের দুই রত্ন রফিকুল ইসলাম বকুল ও নুরউদ্দিন অপু, ডা. ফিরোজ মাহমুদ ইকবালসহ বিএনপির বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত নেতা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, যারা রাজনৈতিক জীবনের প্রায় পুরো সময়ই ভারতবিরোধী প্রপাগান্ডা করে সময় কাটালেন তাদেরকেই এখন ভারতে গিয়ে আশ্রয় চাইতে হবে কেন? তাহলে তাদের পুরো রাজনৈতিক জীবনটাই ছিল ভাঁওতায় ভরা? তাহলে কি তারা কেবল রাজনৈতিক প্রতারণাই করেছেন জনগণের সঙ্গে?
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রায় দশ সহস্রাধিক মিত্র বাহিনীর সদস্য, যারা প্রাণ দিয়েছিলেন, তাদের কথা বাঙালি জাতি কতটা মনে রেখেছে? এই নিউইয়র্কে আমি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী ভারতীয় সৈনিক গুরুজিৎ সিংয়ের ছেলে রণবীর সিংয়ের দেখা পেয়েছিলাম কয়েক বছর আগে। রণবীর পেশায় ডাক্তার। তার মা-ভাইবোনসহ যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। আমি অনুমতি নিয়ে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন, একাত্তর কীভাবে তার জীবন থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে তার প্রাণ প্রিয় স্বামীকে।
আজ যারা বাংলাদেশে নানাভাবে ক্ষমতার আধিপত্য খাটানোর চেষ্টা করছেন এবং করেন তারা যদি সত্যের নুন্যতম সাধনা করতেন তবে হয়তো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভিন্নতর হতো। এ বেদনার সমন্বয় আমরা, বাঙালি জাতি বহন করেই চলেছি।
তিন.
বর্তমানে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় তারা ক্ষমতার বিবর্তন ঘটাতে চাইছেন। ক্ষমতা জনগণের মাঝে বন্টনের প্রত্যয় শোনাচ্ছেন বারবার। বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হচ্ছে।
যদিও দেশে জরুরি অবস্খা তবুও মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক ‘বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। সংবাদগুলো সত্যিই আনন্দের। একটি স্বাধীন দেশে দল গঠিত হবে তা তো আশার সঞ্চার করছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, ক্ষমতা বন্টন বা বিবর্তনের যে ধ্বনি শোনা যাচ্ছে তা ঠিকমতো বন্টিত হয়ে জনগণের হাতে গিয়ে পৌঁছবে তো? বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মাধ্যমে দেশের সর্বস্তরের মানুষ সুবিচার পাবেন তো? যদি না পান, যদি কোন অদৃশ্য শক্তির হাতেই ক্ষমতা ঘুরপাক খায়, তাহলে তো আর কোন শেষ ভরসাই থাকছে না।
এখানে আরও একটি ঘটনা উদাহরণস্বরূপ দেয়া যেতে পারে।
শেখ হাসিনাকে বিশেষ আদালতে হাজির করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলার বাদি আজম জে. চৌধুরী এতদিন বলছিলেন তিনি আট কোটি টাকা ক্যাশ চাঁদা দিয়েছিলেন সুটকেসে করে। এখন তিনি বলছেন, তা তিনি চেকে দিয়েছিলেন। সুটকেস রহস্য নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে পত্রপত্রিকায়। তাহলে কি কোন অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে আজম জে. চৌধুরী ক্যাশ থেকে চেকের হাওলা নিলেন?
আমরা দেখছি বিভিন্ন ভিআইপিদের মামলার জামিন হচ্ছে।
কিন্তু উচ্চ আদালতে রায় বহাল থাকছে না। জামিন হচ্ছে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সুফল প্রতিটি নাগরিক পাবেন। এটাই হচ্ছে সামগ্রিক প্রত্যাশা।
একটি দেশে প্রকাশ্যে খুনিরা ঘুরে বেড়ায় আর জাঁতাকলের নিষ্পেষণে জনগণ তাড়িত হয় তা কাম্য নয় কোনভাবেই।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম বলেছে, তারা প্রয়োজনে জাতিসংঘে এসে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা করবে। দেশে জনমত পঁচানব্বই শতাংশই এই বিচারের পক্ষে। তারপরও সরকার এ বিষয়ে নির্বিকার। প্রধান উপদেষ্টা বলেই দিয়েছেন, তারা বিচার করবেন না।
এই মানসিকতা নিয়ে জনগণের ক্ষমতায়ন সম্ভব কি না তা মহাকালই বলে দেবে।
তবে কথা হচ্ছে, এ রকম সুযোগ হয়তো আর কোনদিনই আসবে না। কারণ রাষ্ট্রপক্ষ চাইলেই এসব ঘাতকদের বিচার করতে পারে এবং পারবে রাষ্ট্রীয় আইনে।
জামায়াতকে ডাকলে নির্বাচন কমিশনের যৌথ বৈঠক বর্জন করবে সবকটি রাজনৈতিক দল। এ ঘোষণা একটি প্রতীক মাত্র। কারণ চাপিয়ে দেয়া ক্ষমতা বন্টন পদ্ধতি, বাংলাদেশের মানুষ অতীতে মেনে নেয়নি, ভবিষ্যতেও নেবে না।
নিউইয়র্ক, ০৪ ডিসেম্বর ২০০৭
------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ঢাকা। ৭ ডিসেম্বর ২০০৭ , শুক্রবার ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।