প্রতি বৃহষ্পতিবার আমাদের নিয়ে আব্বা বাংলায় মিলাদ পড়তেন। মাগরিবের নামাজের পর মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বেলে মাঝের ঘরে বাতি বন্ধ করে আব্বার সঙ্গে সুর করে আমরা মিলাদ পরতাম। আমরা ক’জনই। আর তারপর খেতাম ঘোষের খাঁটি গাওয়া ঘি'তে তৈরি সর্ষে লাল রঙের আম্মার বানানো তোফা সিন্নি। ময়দা দিয়ে তৈরি সে হালুয়ার উষ্ণ মুঠোগোলা হাতে দিলে হাত মুঠ করে নিঃশ্বাস ভরে আগে কতন তার গন্ধ নিতাম।
বাসায় আম্মা মুঠো মোয়াও বানাতেন। বাড়িতে এসে মুড়ি দিয়ে যেতো মুড়িওলা। তবু স্কুল পালিয়ে দশ পয়সা দিয়ে স্টেশনরোডের বাস স্টপের সামনে প্লাস্টিকে ঢাকা টুকরীর ধূলো ময়লা পড়া ছোটখাটো মোয়ার পাহাড় কেটে কেটে খাওয়ার জন্য ছিলাম পাগল। লুকিয়ে খেতাম। কারণ বাইরের আইসক্রিম ও খোলা জায়গা থেকে খাবার খাওয়া ছিলো বারন।
আব্বার ধারণা সব আইসক্রিম ডোবার জলে তারা তৈরী করে তাই খেলেই কলেরা হবে। খেয়ে দেখেছি কলেরা হয়নি। তবে প্রায় পেট ব্যাথা হতো। একদিন আব্বা মুদি দোকানের কাগজে পেঁচিয়ে কতগুলো শুকনো চিকন ডাল আর পাতা এনে বল্লেন, ’কাল থেকে তোমরা চিরতার রস খাবে। ’ রক্ত পরিষ্কার হবে- ব্যাথা কমে যাবে।
ছোট চা’র কাপে আগের রাতে তা ভিজিয়ে রাখা হল। পরদিন সকালে আমরা চারজন রস খাবার জন্য মহা উত্তেজিত ও উদগ্রীব লাইনে দাডিয়ে পড়লাম,আব্বা একটি টেবিল চামুচে সে জল অত্যন্ত সর্তকতায় ঠোঁট জিব্বাহ এড়িয়ে সোজা হলকুমে ঢেলে দিলেন। ভাইয়া কপ্ করে গিলে চেহারাটা এত বিকৃত করলো যে আমি বুঝে গেলাম। কিন্তু আম্মা সহ সেনাপতির মত তার মুখটা টান মেরে ছোট হা করিয়ে চিনি তার মুখে পুড়ে দিলেন। তখনই বুঝলাম বেচারা ভাইয়া কেনো সবার আগে খেল।
আমার দেহে দৌড়ের ভাব জাগতেনা জাগতেই সহ সেনাপতির বেড়ি গেল আটকে। এখন রোজ সকালে সাংঘাতিক তিতা জল খাবার পর ফজরের নামাজ পরি আর ভাবি কখন পেস্তা বাটা খাবো। মগজ ভালো হবার জন্য পাঁচটি পেস্তা, দুটো কাঠ বাদাম, দশটি কিসমিস আর তিনটি গোল মরিচ বেটে চারটি ছোট ছোট ভাগ করে পিরিচ এনে ধরতো। এতে নাকি ব্রেনের মাত্রা বাড়ে। তারপর ঘি আলুভাতে বা ডিম ভাজি আর গরম গরম ডাল ভাত খেয়ে স্কুলের পথে হাঁটা দিতাম।
নাটকের সাত বছরের শরীফার চরিত্রে অভিনয় করে এবং চৌদ্দই আগষ্টে আব্বার তথ্যে শ্লেটে কায়দে আজম নিয়ে লিখে ফেল্লাম। তারপর স্কুলে চাঁদ তারা পতাকা ওঠানোর পর সবার সঙ্গে ” পাক সাদ বাদ” গাইতে গিয়ে ভাবতে লাগলাম অর্থটা কি? তারপর মুখস্ত বলে ফেল্লাম রচনা। এসব করে স্কুলে বলে যখন মোটামুটি স্টার হয়ে উঠছি তখনি একটি ছোট খাটো চুরি করে পূনরায় পিঠে পাখার বারি খাবার ব্যবস্থাদি করে ফেললাম। এটা আমার দ্বিতীয় চুরি। রাবারের ভেতরে বসানো মাটির মটকায় জলে ভাসা কুলফি খাবার জন্য প্রথম চার আনা পয়সা চুরি করি।
এবার আব্বার এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে দেখি তার মেয়ের বিদেশী লাল নীল কাঠের কন্সট্রাকশন গেইম! দেখে আমি মুগ্ধ। মেয়েটি সরে যেতেই তিনটি নীল হলুদ আর লাল ব্লক ফ্রকের নিচে নিয়ে নিলাম। তারপর মুখটা যথা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে পেট চুলকানোর ভান করে সেমিজের নিচে কুচি দেয়া সূতি প্যান্টের ফিতায় কোমড়ে তা আটকে নিয়ে বাড়ি এলাম। এতগুলো কাঠের ব্লকে সে বুঝতেই পাবেনা যে তার তিনটি নেই। কিন্তু বাড়িতে এনেই বুঝে যাই চোরাই মালের প্রকাশ্য ব্যবহারের জটিলতা।
অতটুকু মেয়েরতো জীবনে কোনো প্রাইভেসি নেই। কোথায় সে তার চোরাই মাল রাখবে? এছাড়াও রঙিন ব্লকের পর ব্লক সাজিয়ে মসজিদ আর ইমারত করা সম্ভব হলেও শুধু মাত্র তিনটি ব্লকে কিছুই খেলার উপায় নেই। কোনো উপায় না পেয়ে আবার গোপনে একদিন তা ফেলে এলাম বাড়ির বাইরে। এমন এক স্থানে যেখানে সবাই সকালে উঠেই যায়। কিন্তু বর্জে পরেও তা ডোবেনা।
তার উজ্বল রঙ ঐ বর্জের মধ্যেও জেগে রইলো। ফলে আম্মার হাতে উঠে এল হাত পাখা। কিন্তু আমাকে কি আর নাগালে পাওয়া যায়!ফেনীর স্কুলের কাছে ছিলো জেলখানা। সেখানে মিজান সফি এরা প্রায়ই চোর দেখতে যেতো আর আমাদেরকে গল্প করতো। একদিন আমি রুবি বেলি সবাই গেলাম।
গিয়ে দেখি এরা বাগান করছে,টিউবওয়েল থেকে পানি নিয়ে আলু ক্ষেতে দিচ্ছে, বেড়া বানাচ্ছে একদম মানুষের মত। এসময় সেন্ট্রি বল্লো, ’চোর দেখবে?’ আর আমাদেরকে কালো কালো গুই সাপের খোসলের মত লোহার ভেতরে ঢুকিয়ে ফেল্লো। দুপাশে এত মোটা মোটা শিক যে আমার মুঠোতে ধরেনা। মনে হল যেন একটি দূর্গে ঢুকে গেছি। অন্য দিকের আধা গোটানো গেটটির নিচে বসে তাকিয়ে দেখি স্ট্রাইপ হাফপ্যান্ট পরা কালো কালো বেশ স্বাস্থবান অনেক গুলো পুরুষ।
কারো পায়ে লোহার বালা, কারো আবার সে সব বালায় কোমড় থেকে নেমে এসেছে চিকন লোহার শিক। ওরা হেঁটে বেড়াচ্ছে বেশ খুশি মনে। একজন দাড়িওলা, শিকওলা আমাদের দিকে ডিমের মত মুখ করে বলে ” কি খুকি চোর দেখতে আইছ? কিন্তু আমিতো ডাকাইত!” সে রাতে অসংখ্য কালো কালো ভূতেরা আমাদের রান্নাঘরের উঠানে ভীড় করে কাদা ও জলে হা-ডু-ডু খেলে গেল। কিন্তু আমি পাখার বারির ভয়ে সব গোপন করি। সত্যিকার চোর দেখি এক শীতের রাতে।
সে রাতে বারবার কুকুর ডাকছিলো। সারাদিন পুকুরে এত সাঁতার কেটেছি যে আমারতো পড়ে পড়ে ঘুমোবার কথা। কিন্তু আমি বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম। হঠাৎ মনে হল মরুভূমির ওপার থেকে যেনো ভেসে আসছে উঠ আর মানুষের সম্মিলিত চিৎকার। আমাদেরও টিনের দরজা যেন ভেঙ্গে ফেলছে সে শব্দ।
আমরা হ্যারিকেন নিয়ে বেরুতেই দেখি উত্তেজিত জনতা গন্ধরাজ গাছের দিক থেকে টেনে সেই ঊট। ” স্যার সিদ্দিক চোরেরে মালসহ ধরছি- হ্যাতে দাইছিল..। ” বড়দের ফোকড় গলিয়ে তাতেই চোর আমার দিকে তাকায়। চোর যে এমন র্ফসা ও সুপুরুষ হতে পারে জানা ছিলনা। কিন্তু তার চোখ ছিল রক্ত জবার মত লাল।
উত্তেজনায় একজন একটি পোটলা বারান্দায় ফেলতেই বেজে ওঠে কাসার গেলাস। একজন সেই মালামাল খুলতেই ভেতর থেকে ’শিবলী’ লেখা কাসার গেলাস বেরিয়ে যায়। ভাইয়া খপ করে সেটা তুলে নেয়। আব্বা বল্লেন, ” এ আপদ এখানে কেন? খবরদার মারবেনা আর। ওকে থানায় নিয়ে যাও।
” এবার সিদ্দিক চোর ঘষটে ঘষটে আব্বার পা ধরতে আসে আর আব্বা লাফিয়ে সরে যান। ওরা বেরিয়ে গেলে কিছুক্ষণ পর আব্বা আম্মা চুপ হয়ে থাকেন। আমরা বিছানায় ফিরে আসি। কিন্তু কানে এসে লাগে সেই ঊটের কান্না। শুনি রাত্রির গহন কেটে কেটে যাচ্ছে সিদ্দিক চোরের কান্নায়।
আমরা কানে বালিশ আর লেপ চেপে ধরি। আব্বা অস্বস্থিতে পায়চারি করেন, ” ইতারে কইলাম পুলিশো দিত- তানা তারা লাগিগেছে মাইরো। ” সে রাতে আমরা কেউ ঘুমোতে পারিনা। সকালে দেখি বারান্দায় পড়ে আছে চোর দ্যাখা হারিকেন আর পথে কিছু দলিত গন্ধরাজ। স্কুল শেষে আমি সফি, রুবি, শাহজাহান কিছুণ দৌঁড়াদৌঁড়ি খেলে তবে বাড়ি ফিরতাম।
সেদিন আমার পরা ছিলো আম্মার একটা পুরোনো শাড়ির আঁচল কেটে বানানো জামা। নীল আঁচলটার মধ্যে খুব উজ্জল বরফির প্যার্টান যেন চুলের বাবরি। ’বুড়ি’ টেনে ধরতে আমাকে কে যে এমন টান দিলো যে জামার ঘের গেল ছিঁড়ে। এখন এমন অবস্থা যে হাঁটতে গেলেই আমার পা আর প্যান্ট দুটোই দেখা যায়। আমি আম্মার ভয়ে কাঁদতে শুরু করলে যার টানে জামা ছিঁড়েছে তাকে সবাই মিলে মহা বকাবকি করতে শুরু করে।
বেচারা। এখন কি করে বাড়ি ফিরি?তারই বুদ্ধিতে আপরাধী সহ ওরা সবাই মিলে আমার গা ঘেষে দাঁড়ালো আর আমরা হাঁটতে লাগলাম এক সঙ্গে যুথবদ্ধ হয়ে। সেদিন হেঁটে হেঁটে আমার বন্ধুরা আমার জামার জীবন্ত ঝুল হয়ে আমার সম্মান রেখে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলো। আর আম্মা তাদের খাইয়ে বল্লেন, ”আহারে বাচ্চারা এটাতো পুরোনো শাড়ির আঁচল, এমনিই ছিডে যাবার কথা!”গোলাম হোসেন ছিলো দুষ্টমিতে সেরা। মিজানের হাতের লেখা ছিলো চমৎকার আর পড়াশোনায় ছিলো খুব ভালো।
র্দূদান্ত গোলাম হোসেন আমার জন্য এটা সেটা ফল পেরে আনতো গাছ থেকে। একদিন টিফিনের সময় গায়ে এসে পড়লো ছোট্ট চিরকুটের ঢিল। খুলে টান করতেই দেখি সুন্দর করে লেখা: ” নিলুপা তোমাকে ভালোবাসি। ” ব্যাপারটা আর যাইহোক আমাদের বয়সযোগ্য নয় বুঝতে পেরে কাঁদতে শুরু করে দিই। মালেক স্যারের চোখে পডে দুর্ঘটনাটি, স্যার তিনটি বেঞ্চ ডিঙিয়ে শুন্যে তুলে আনেন অংক কশার সেরা ছাত্র মিজানকে।
জেরা করলে বলে, এই কথাটা সে উত্তম কুমারকে বলতে শুনেছে সিনেমায়। স্বীকারোক্তির পরও স্যার তাকে পরের সারা ক্লাশ দেয়ালের দিকে মুখোমুখি করে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। আর আমি ছুটির সময় ওর দিকে তাকাতে তাকাতে কাঁদতে কাঁদতে সিদ্দিক চোরের মত চোখ লাল করে বাড়ি ফিরে এলাম। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।