আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তোরা সব বোকার দল, মরবি না তো কে মরবে

ছায়া ছায়ায় পথ হেটে চলি--ছায়া আমার সামনে ও পিছে।

[সঞ্জিব চৌধুরী মরেনি, কোমায় আছেন। তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে এ্যাপোলোতে। ] কথা ছিল অনেক কিছুই! তবে কখনো কথা ছিল না সংবাদপত্রের কনিষ্ঠ কেরানি হয়ে জীবন যুদ্ধ শুরু করবো। কথা ছিল না এত এত মৃত্যুর খবর নিয়ে হাসি মুখে বলে উঠি ‘তোরা সব বোকার দল, মরবি না তো কে মরবে’।

আশ্চার্য্য নিজের মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই না, এতোটাআবেগহীন এই আমি- ভাবতে অবাক লাগে। “গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়া। পটুয়াখালীর আফজাল স্ত্রী, পুত্র নিয়ে তখনো ঘরেই। নিরাপদে যাওয়া তখনো তার হয়নি। জোরদার হচ্ছে ঝড়ের এর বেগ।

ভাবলেন- ঘরে থাকা আর নিরাপদ নয়। ছুটলেন আশ্রয়ের খোঁজে। আফজালের কোলে ১২ বছরের কন্যা মুক্তা আর মা জাহানুরের সাত বছরের ছেলে মিরাজ। শো শো শব্দে ধেয়ে আসছে ঝড়। সঙ্গে পায়রা নদীর বেড়িবাধ উপচে বানের পানি ঢুকে পড়েছে।

মুহূর্তেই সর্বগ্রাসী ঢলের পানি গ্রাস করলো ওদের। আফজাল শুধু স্ত্রী জাহানুরের আর্তচিৎকার শুনলেন। চোখের সামনে দিয়ে ভেসে গেল স্ত্রী-সন্তান। বাঁচলেন নিজে। ” তোরা সব বোকার দল, তোরাই তো মরবি।

আধুনিক এই বিশ্বে তোদের গালি দেবে ‘বোকার দল’ বলেই। অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে হাতরিয়ে বেড়াবি কিছু ত। কথা ছিল অনেক কিছুই! কাস ফাইভে যখন পড়ি তখন স্বপ্নগুলো ডানা মেলে উড়ে বেড়াতো আকাশে। পাইলট হবো এমনই খায়েস ছিল তখন। তারপর নাইনে রাজনীতিক, টেনে ডাক্তার, কলেজে ভর্তি হয়ে সেটা ঘুরে গেল প্রকৌশলমুখী।

হতে পারিনি। হয়েছি সংবাদপত্রের কনিষ্ঠ এক কর্মী। এক স্টেশনের টিকিট কেটে অন্য স্টেশনে নেমে গেছি বহুবার। বহুমাত্রিক গমনে একমাত্রিক ভাবনা কখনোই ছিল না নিজের মধ্যে। তাই ঠকেছি বারবার।

ঠকিয়েছে নিজের স্বত্ত্বাকে। আধুনিকতাকে সাঙ্গ করে ছেটেছি আদর্শ। ছেটেছি স্বপ্নগুলো। কলেজ শেষ করে ভার্সিটি ভর্তির আগে হঠাৎ খায়েস ‘ক্রিকেটার হবো’। তখন ফার্স্ট ডিভিশনে খেলতাম কুমিল্লায়।

উইকেট কিপার। জীবনে হাজারো বল আটকিয়েছি বাউন্ডারি হওয়ার হাত থেকে, অথচ এখন নিজেই বাউন্ডারির বাইরে। বাউণ্ডুলে। প্রেমিকা বলেন আর বউ বলেন সবাই বলে ‘তুই আস্ত একটা বাউণ্ডুলে’। সংবাদপত্রের আধুনিক বার্তা সম্পাদকরা বলেন- ‘তুমি বড্ড অস্থির, তোমার দ্বারা কিছু হবে না’।

একটু প্রতিবাদ করলেই তাদের কড়া দৃষ্টি। বলেন- ‘ছেলেটা বড্ড বেয়াদব’। আমি আমার বিশেষণগুলো এক এক করে জুড়ে দেই নিজের নামের সঙ্গে। এক একটা সংবাদ প্রস্তুত করে দিই ওদের মনের মতো করে, দু’একটা বানান হয়তো ভুল হয়ে যায় মাঝে মাঝে। আমি ধরিয়ে দিলেই কেবল ধরা পড়ে তাদের চোখে, নইলে না।

মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে- মরেছে ওমুক, মরেছে তমুক। শুধু মরি না আমি। আমি বড্ড বেহায়া। এই পৃথিবীর মায়া আমি ছাড়তে পারিনি। বেঁচে থাকি সংবাদপত্রের কোনো কনিষ্ঠ কেরানি হয়ে।

ডেস্ক ভরে উঠে মৃতের খবরে। আমি হাঁসি মুখে বলে উঠি- ‘তোরা সব বোকার দল’। ওপার থেকে শব্দ করে কেউ একজন বলে উঠে- ‘বরগুনায় আরও সাত জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে- সাতীরায় ছয়, ওদের সংখ্যাটা যোগ করে দাও তো’। আমি ভাবি- ‘ওরা এখন সংখ্যা, ওরা এখন অঙ্ক। ” বলি নামটা দিলে হয় না- ওপার থেকে আবারো বলে উঠে - ‘কি দরকার, স্পেস বেশি খাবে’।

আমি ভাবি- ছোট্ট দুটো অরের ওদের নামগুলো এতটাই বর্জ্য। পৃথিবীর কত বড় স্পেস ছেড়ে দিল, অথচ পেল না সংবাদপত্রের ছোট্ট দু অরের স্পেস। এই আমাদের আধুনিকতা। এই আমাদের মতবাদ। ‘তুমি কি মরেছ, মরোনি এখনও, সঞ্জিব চৌধুরী।

বার্তা সম্পাদক জিজ্ঞেস করেন পারলে এমন করেই। এই মাত্র মরেছে সঞ্জিব, পত্রিকার লিডটা চেঞ্জ করে দাও- ‘সঞ্জিব আর নেই’। সঞ্জিব তুমি এখন কোনো ওয়েবের ব্যানার হেডিং। তুমিও তো স্পেস। কত মানুষ এতটুকু জায়গাও পায়নি কখনো।

দু অরের স্পেস। লাল দাগে বড় বড় অর তুমি নেই। তুমি মৃত। তুমি এখন ব্যানার স্পেস। তবে সঞ্জিব মরেনি।

সঞ্জিব মরেনি, কারণ সঞ্জিব বুঝে গেছে সাংবাদিকের কি খায়েস। সঞ্জিব তোমাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। এ্যাপোলোর বেডে শুয়ে শুয়ে হয়তো তুমি কোনো গানের কথা ভাবছো। বেঁচে উঠলেই লিখবে- ‘আমি জীবন বাজি রেখে বলছি, আমি মরিনি তখনো/ লাল লাল দাগ হয়ে জ্বলছে আমার নাম/ আমি মরিনি তখনো’। এহেছান লেনিন, সহ-সম্পাদক, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.