আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়- ০১

বেঁচে থাকার মহত্তম উদ্দেশ্যটা খুজে ফিরছি এই শিরোনামে ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে একটা বই প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র। বইটির প্রচ্ছদ একেছিলেন কামরুল হাসান। সম্প্রতি নীলক্ষেতের ফুটপাথের দোকান থেকে এই বইয়ের একটা কপি আমি কিনেছি। এই বইটি সম্ভাবত অনেকের কাছেই নেই কিন্তু বইটি পড়ে এর কিছু কিছু অংশ সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে পড়তে ইচ্ছা হল। মুখবন্ধ মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র দেশ ও জাতির এমন এক সংকট পরিস্থিতিতে গঠন করা হয়েছিল, স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি, একাত্তরের ঘাতক ও পাক হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসররা, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেই শুধু প্রতিষ্ঠিত নয়, সরকার ও প্রশাসনের সর্বত্র তাদের অশুভ উপস্থিতি প্রকটভাবে প্রতীয়মান।

যার ফলে মুক্তিযুদ্ধের সমুদয় চেতনাকে সম্পুর্ণভাবে নস্যাত করে দিয়ে জাতীয় অরর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি জীবনে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপদ নীতি ও ধ্যান ধারণা প্রতিষ্ঠা ও প্রচার করা হচ্ছে। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজতন্ত্রকে আনুষ্ঠানিক ভাবে খারিজ করে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংক, শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমালিকানায় ফিরিয়ে দিয়ে, দুর্নীতি চোরাচালান ও ফড়িয়াগিরির ব্যপক প্রসার ঘটিয়ে তা মুষ্টিমেয় ব্যক্তিকে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বানিয়ে, দেশের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষকে দারিদ্র্য সীমার নীচে ঠেলে দিয়ে দেশে এক ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য জীবনদান যদি সর্বোচ্চ মূল্য হয় বাঙ্গালী জাতির মত এত বেশী মূল্য অন্য কোন জাতিকে দিতে হয় নি। অথচ স্বাধীনতার ষোল বছর অতিক্রান্ত না হতেই স্বাধীনতার ইতিহাস ও চেতনা নতুন প্রজন্মের নাগরিকরা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছে। এই বিস্মরণ অস্বাভাবিক নয় একারণে যে, স্বাধীনতার পর যে কয়টি সরকার আমরা পেয়েছি তারা কেউই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চায় নি।

বরং চেয়েছে এই চেতনা গোটা জাতির স্মৃতি থেকে দ্রুত অবলুপ্ত হোক। যে কারণে গোলাম আজম, আব্বাস আলী খান বা মওলানা মান্নানের মতো একাত্তরের ঘাতকদের এদেশের রাজনীতিতে বা সরকারের মন্ত্রীসভায় স্থান করে নিতে দেখেও আমরা নিন্দা করি না, প্রতিরোধ গড়ে তুলি না। একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা যখন সরকার প্রশাসন, রাজনীতি কিম্বা শিল্প সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রে বসে ছুরি শানাচ্ছে আরেকটি গণহত্যার জন্য, সরকার তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য। এ কথা আমরা বহুবার বলেছি, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুষ্টিমেয় লোক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে স্বধীনতার পক্ষের শক্তির উপর ইতিহাসের নৃশংতম গণহত্যা চালিয়েছিল। আমরা চিনি তারা কারা।

একাত্তর বাহাত্তরের সংবাদপত্রে তাদের ততপরতার খবর প্রকাশিত হয়েছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে তাদের ধরিয়েদেয়ার জন্য প্রতিদিন সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছে। অথচ আমাদের দুর্ভাগ্য সরকারী তত্বাবধানে রচিত মুক্তিযুদ্ধের ১৫ খন্ডের বিশাল ইতিহাসে তাদের নাম ছাপা হয় নি। আরো বিস্মিত হই তখন—যখন এইসব ঘাতকদের দেখি পত্রিকায় সদম্ভে ঘোষণা করে – একাত্তরে আমরা ভুল করি নি। কিম্বা যখন বলে ......কিসের বিতর্কিত আমি? অথচ এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ হয় না।

আমরা আগেও বহুবার বলেছি, এখনও বলছি, তালিকা প্রস্তুত করা দরকার মুক্তিযোদ্ধাদের নয়; মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত সম্ভব নয়, কারণ দেশের তখনকার সাত কোটি মানুষই ছিলেন মনে প্রাণে মুক্তিযোদ্ধা। তালিকা প্রস্তুত করা দরকার একাত্তরের গণহত্যার জন্য যারা দায়ী সেই মুষ্টিমেয় ঘাতক ও দালালদের, যাতে দেশবাসী তাদের সম্পর্কে সজাগ থাকতে পারেন – তাদের পুনর্বাসন প্রয়াসকে প্রতিহত করতে পারেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারের নাজী বাহিনী জার্মানী সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিল সেই সব ঘাতকদের তালিকা প্রস্তুত এবং অনুসন্ধানের কাজ ৪৫ বছর অতিক্রম করার পরও অব্যাহত রয়েছে। এখনও তাদের কাঠগড়ায় দাড়াতে হচ্ছে তাদের অপরাধের জন্য। সেই সব অপরাধী এখনো তাদের দেশে ভোটাধিকার পর্যন্ত ফিরে পায় নি।

অথচ আমরা তাদের মন্ত্রী সভায় স্থান দিচ্ছি, সংসদে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছি; পাকিস্তানের নাগরিক কুখ্যাত ঘাতক গোলাম আজমকে বাংলাদেরশর মাটিতে বসে গণ হত্যার রাজনীতি করার সুযোগ দিচ্ছি। জাতিকে এই সংকট পরিস্থিতিতে সতর্ক করার প্রয়োজনে আমাদের এই প্রয়াস। এই গ্রন্থটিতে একাত্তরের ঘাতক ও দালালদের সম্পর্কে যে সব তথ্য দেয়া হয়েছে প্রায় সবই সেই সময়ে সংবাদপত্র থেকে নেয়া। এই সব তথ্য যেহেতু যথাযথভাবে গ্রন্থকারে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ১৫ খন্ডের কোথাও ছাপা হয় নি সেহেতু এই গ্রন্থটিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ১৬তম খন্ড হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে এটিও নির্দিষ্ট বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ নয়।

সীমিত ক্ষমতা ও সময়ের ভেতর এটি আমাদের প্রথম প্রয়াস। ভবিষ্যতে আরো কটি খন্ডে ইতিহাসের এ বিশেষ পর্বটিকে পূর্ণাঙ্গরূপে বিবৃত করবার পরিকল্পনা রয়েছে। আমাদের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য গোটা দেশবাসীর সহযোগিতা প্রয়োজন। আপনারা আপনাদের এলাকার ঘাতক ও দালালদের তথ্য আমাদের কেন্দ্রে প্রেরণ করুন। কোন বিদ্বেষের বশবর্তী নয়, স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস যথাযথভাব লিপিবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনেই এই সব তথ্য সংরক্ষণও প্রকাশ করা দরকার।

কেন্দ্রীয় কমিটি মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র ১০ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৭ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।