নাম শুনেই যার প্রেমে পড়ি
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা
শ্রদ্ধেয় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা,
আপনার সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি, কথাও হয়নি। কিন্তু তারপরেও আপনাকে খুব করে মনে পড়ছে। না, এটা কোনো ভণিতা নয়, বা কথার কোনো চাতুর্য্যতাও নয়, আমার হৃদয়ের খুব গভীরের এক উপলব্ধি। আপনার চোখ জোড়ার দিকে তাকালে কখনোই মনে হয় না আপনি আমার অপরিচিত কেউ। কেমন যেন আমাকে টেনে নেয় অনেক অনেক কাছে, হয়ত আরো অনেককেই।
আচ্ছা আপনার চাহনিটা এরকম কেন? ঐ চাহনীতে আপনি একসাথে এতকথা কীভাবে বলেন? এত প্রেম কেন ঐ চাহনিতে? এত আগুনের উত্তাপ কেন? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা, ৬২'তে কাপ্তাই বাঁধে লাখো মানুষের চোখের জলে এত সুন্দর(!?), দৃষ্টি নন্দন(!?) হ্রদের সৃষ্টি হওয়ার সময় আপনার চাহনিটাতে কী আরো অন্যরকম কিছু ছিল? সেই চাহনির উত্তাপ সইতে না পেরেই কি ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নিবর্তন মূলক আইনে শাসক-শোষকেরা আপনাকে কারাবন্দী করেছিল? কিন্তু, দুই দুইটি বছর কারাগারের ঘোর অন্ধকারও কেন সেই উত্তাপকে ঠান্ডা করতে পারেনি? সেই উত্তাপ কেমন করে কারাগারের শক্ত প্রাচীর ভেদ করে পাহাড় থেকে পাহাড়ে, আদাম থেকে আদামে, জুম থেকে জুমে চোখের জলে কাতর মানুষের বুকে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল? আপনার চোখে কী এমন প্রেম ছিল, যার কারণে সহায়-সম্বল হারানো, নির্যাতিত-নিপীড়িত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, খুমী, ম্রো, লুসাই, বম, পাঙ্খো, চাক, রাখাইন, খিয়াং প্রভৃতি জাতির লোকজন নতুন করে স্বপ্ন দেখার সাহস পেয়েছিল? আচ্ছা, ঘাতকেরা যখন আপনাকে নির্মমভাবে হত্যা করছিল তখনও নিশ্চয়ই আপনার চাহনিতে ঐ নির্ভীকতা আর প্রেমের আহ্বান ছিল। সেই আহ্বানকে উপেক্ষা করেই ঘাতকের বুলেট কিভাবে আপনার বুকে বিঁধল তা আমার ভাবতেই অবাক লাগে।
বাবু লারমা,
আমি একজন বাঙালি। এই বাঙালি বলে পরিচয় দেওয়ার মধ্যে এক ধরনের গর্বও কাজ করে, এটা হয়ত দোষের কিছু নয় তা আপনিও মানবেন।
ভিনজাতির শোষণের জাল ছিড়ে ৭১'এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের জাতিগত অহংবোধ এমন টগবগ করে ফুটতে ছিল যে আমরা বুঝতেই পারিনি আমাদের এই গগণচুন্বী অহংবোধের মাঝেও কতটা জাতান্ধতা মিশে থাকতে পারে। ৭১'এর ১৫ নভেম্বর পর্যন্তওতো আমরা জাতিগত শোষণকে অস্বীকার করেই অস্ত্র চালিয়েছি, বুকে বুলেট বরণ করেছি, সম্ভ্রম হারিয়েছি। অথচ শাসন ক্ষমতা নিজেদের হাতে আসা মাত্রই আমরা স্বার্থপরের ন্যায় সব কিছুই আমাদের নিজের জাতির করে নিলাম। সংবিধান রচনার সময় আমাদের চোখে পড়ল কেবল বাঙালি জাতির মানুষজনকেই। আমাদের জাতান্ধ অহংবোধে আমাদের চোখে এমন ছানি পড়েছিল যে এই ভূখণ্ডে বাঙালি ভিন্ন আর কোনো জাতির অস্তিত্বই খুঁজে পেলাম না।
যে জাতি আপন ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে ইতিহাস রচনা করলাম তারাই কিনা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খিয়াং, আচিক, লালেং, সান্তালী, কুরুখ, মৈতৈ ভাষার প্রতি সামান্য মর্যাদাটুকুও দেখাতে পারলাম না আমাদের সংবিধানে। এমনকি ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গণপরিষদের অধিবেশনে-"বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙ্গালী বলিয়া পরিচিত হইবেন" আ: রাজ্জাক ভূঁইয়ার এমন অযৌক্তিক প্রস্তবনার অসাড়তা প্রমান করে আপনার যৌক্তিক বক্তব্য বা অধিবেশন থেকে ওয়াকআউটেও আমরা আমাদের চোখের ছানিটাকে অপসারণ করতে পারিনি। বরং আমাদের জাতান্ধতা এমন প্রকট হয়ে উঠেছিল যে, সেই পাকিস্তানিদের মতো করেই আমরা আপনাকে মন্ত্রীত্বের টোপ দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার সংগ্রামী চেতনার কাছে তা হার মানতে বাধ্য হয়েছিল।
প্রিয় লারমা বাবু,
শঙ্খ, মেওনী, কাসালং, কর্ণফুলীতে অনেক জোয়ার বয়েছে।
শাসকদের মুখোশও বদল হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু আপনাদের প্রতি আমাদের জাতিগত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। আপনার জীবিত থাকাকালীন ১৯৮০ সালে কাউখালী থানার কলমপতি এলাকায় প্রায় ৩০০ পাহাড়ী নারী-পুরুষকে নিবির্চারে হত্যা করার যে ন্যক্কারজনক, লোমহর্ষক ঘটনা ঘটিয়েছিল আমাদের জলপাইধারীরা সেটাই কিন্তু শেষ ছিল না। ধারাবাহিকতার শুরু মাত্র। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে অনেক ত্যাগ আর প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভকারীরা মাত্র ৯ বছরের মাথায়ই আপনাদের উপর সেই একই যজ্ঞ চালিয়েছি।
আর খেয়াল করে দেখুন পাকিস্তানী সেনারা বাঙালীদের উপর প্রথম গণহত্যার জন্য ২৫ মার্চের রাতটাকে বেছে নিলেও আমরা কিন্তু রাতের ধারও ধারিনি। ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ দিনেই প্রকাশ্যে ঘটিয়ে আমরা প্রমান করেছিলাম আমাদের ব্যাটাগিরি কতটা নির্মম হতে পারে। শুধু কি তাই, আপনার মৃত্যূর পরও এর চাইতেও নৃশংস, বর্বরোচিত একের পর এক গণহত্যা চালিয়েছি ঝরেইবেড়ি, বেলতলি, বেলছড়ি, গোলকপুদিমা ছড়া, টেরাবনছরি, মারামাইচ্যাছড়া, সুগুরিপাড়া, টারেঙাঘাট, ভূজনছড়া, মিরজিবিল, লংগদু, নানিয়ার চর, দীঘিনালা, মাইসছড়ির পাহাড়ি জনপদগুলোতে। শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ কেউই রক্ষা পায়নি আমাদের নির্মমতার হাত থেকে। কত নারীকে আমরা আমাদের পাশবিকতার শিকার বানিয়েছি বা এখনো বানিয়ে চলেছি।
শুধু কি পাহাড়েই আমরা আমাদের এই যজ্ঞ চালিয়েছি? না, আমরা সমতলের আদিবাসীদেরও শান্তিতে রাখিনি। একেকটি প্রতিবাদি কণ্ঠকে রোমশ হাতে টুটি চেপে ধরেছি, স্তব্ধ করে দিয়েছি আগুন কণ্ঠকে। আমরা প্রতিবাদী কল্পনাকে নেই করে দিয়েছি। আমরা আলফ্রেড সরেন, অবিনাশ মুড়া, বিহেন নকরেক, সেন্টু নকরেক, অধীর দফো, গীদিতা রেমা, পীরেন স্নাল ও সর্বশেষ চলেশ রিছিলকেও সরিয়ে দিয়েছি। প্রতিবাদ আমরা বৃহত্তর জাতির লোকজন বরদাশত করতে পারি না।
আমরা যে কোনো প্রকারেই তা স্তব্ধ করে দিতে জানি। ছলে, বলে, রণে বা কৌশলে। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে মোটামুটি নিয়ন্ত্রনে রাখতে পেরেছি কিছু চেয়ার সৃষ্টি করে দিয়ে, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতকে উস্কে দিয়ে বা জিঁইয়ে রেখে।
সুহৃদ লারমা বাবু,
আমরা শুধু রাজনৈতিক ভাবেই আপনাদের (আদিবাসীদের) কোণঠাসা করে রাখিনি, মনস্তাত্ত্বিকভাবেও আপনাদেরকে আমরা কব্জা করে রেখেছি। পার্বত্য শান্তি চুক্তির প্রথম শর্ত হিসেবে আমরা- "সকল ক্ষেত্রে উপজাতি শব্দটি বলবৎ থাকিবে" মেনে নিতে বাধ্য করেছি।
কর্পোরেট পূঁজির জরায়ুজাত দেশি-বিদিশি এনজিও বা দাতাসংস্থাদের দিয়ে আদিবাসীদেরকে উন্নয়ন আফিম খাইয়েছি উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই। উন্নয়ন নেশাতে আপনাদের এতটাই কাতর করেছি যে, আপনাদের আবার কোমড় সোজা করে দাঁড়াতে একটু সময় লাগবে বৈকি। ডানপন্থীদের কথা বাদই থাক, আমরা বাম দলের নেতাকর্মীরা এখনও পর্যন্ত আদিবাসীদের কোন ইস্যুতে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী না দিলেও প্রায় সারা বছরই আপনাদের আয়োজিত সভা-সেমিনার-দিবসে মঞ্চের শোভাবর্ধন করি, গলাবাজি করি। আমরা গবেষকরা ঝাঁকে ঝাঁকে পাহাড়-সমতলে ছুঁটেছি বা ছুঁটছি আপনাদের গিনিপিগ বানিয়ে নিজের ক্যারিয়ারকে আরো জ্বলমলে করে তুলতে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আপনাদের নিয়ে আন্দোলন(!?) করে যাচ্ছি নিজের পকেট ভরার ধান্দায়।
আমরা বড় বড় নাট্যকারেরা আদিবাসীদের নিয়ে নাটক করে বেড়াচ্ছি সাম্রাজ্যবাদী পূঁজির টাকায়; ভাববেন না এ আমাদের অকৃত্রিম দরদ আপনাদের প্রতি, এ আমাদের ধান্দা, শ্রেফ ধান্দা। আমরা নানান ভাবে আপনাদের নেতাদের সভা-সেমিনার-ফান্ড-বিদেশ সফরের টৌপ দিয়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে অনেক অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছি। আমরা তাদেরকে বুঝাতে পেরেছি কী দরকার রোদে পোড়ার- বৃষ্টিতে ভেজার বা অন্যান্য কষ্ট স্বীকার করে নিজেদের অধিকারের কথা বলার, তার চেয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে আয়েশ করে আপনাদের সমস্যার কথা আলাপচারি করেন; আমাদের স্যাটেলাইট চ্যানেল বা পত্রিকায় আমরা তা প্রচার করার ব্যবস্থা করব। আমরা লেখক-সাহিত্যিকেরাও আপনাদের নিয়ে কম উঠে পড়ে লাগিনি; আদিবাসীদের নিয়ে একখান গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা একখান দীর্ঘ উপন্যাস পয়দা করতে না পারলে যেন আর ইজ্জত থাকছে না। বর্তমানে আদিবাসীদের নিয়ে সাহিত্য চর্চা যেন একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানের পাহাড়-ঝরণা চষতে চষতে আদিবাসী নারীর খোলা বুকের ছবি তুলে এনে রাজধানীতে প্রদর্শণীর ব্যবস্থা করে নিজের ফটো তোলার ক্ষমতাকে জাহির করে বেড়াচ্ছি , তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি সুধীজনদের মনে একটু সুড়সুড়ির ব্যবস্থা করে দিতে পেরে ইত্যাদি ইত্যাদি আরো কত কি!
শ্রদ্ধেয় লারমা বাবু,
আপনার হৃদয়টা অনেক বিশাল, না হলে লাখো পাহাড়ী আপনার ডাকে সাড়া দিত না বা আপনি তাদেরকে বুক আগলে রাখতে পারতেন না। আপনার ঔদার্য্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বাঙালি জাতির একজন প্রতিনিধি হিসেবে লজ্জাবনত হয়ে আমি আপনাকে অনুরোধ করতে চাই, প্লিজ আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন না। কেননা আপনার কাছে, এই রাষ্ট্রের আদিবাসীদের কাছে ক্ষমা চাইবার মতন যে যোগ্যতাটুকু থাকার দরকার জাতিগতভাবে তা আমরা এখনও অর্জন করতে পারিনি।
আপনাকে আমার প্রাণের সেলাম। লাল সেলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।