১
এক মাসের ছুটিতে বাসায় এসেছি। প্রধান উদ্দেশ্য বাবা মার সঙ্গে দেখা করা আর অপ্রধান উদ্দেশ্য বিয়ে করা। আগেই ইচ্ছেটা জানিয়ে দিয়েছিলাম। সম্ভব হলে মেয়ে পছন্দ করে রাখতেও বলেছি। ভেবেছিলাম বেশ কিছু সিলেক্টেড থাকবে, এর মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নিব।
এসে দেখি ঘটনা বেশ অন্যরকম।
ছেলে বিদেশে থাকে, কেমন চাকরী, ওখানে বিয়ে করেছে কি না এমন সব হাজারো প্রশ্নে অতিস্ট হয়ে ‘মেয়ে দেখা’ পর্ব প্রায় স্থগিত। একান্ত পরিচিত কিছু আত্মীয় কিছু ছবি জোগাড় করে এনে দিয়ে গেছেন। একটারও খোঁজ না দিলে কেমন দেখায়? আমাকেই বা কিভাবে আর অনুরোধ করবে বিদেশ থেকে কিছু নিয়ে আসার। বিদেশটা লন্ডন আমেরিকা হলে যত সুবিধা, মিডল ইস্ট ততটা না।
আসলে কি করে? লেবার শ্রেনী কি না, বউ নিয়ে যেতে পারবে কি না, সারাক্ষণ বোরখা পরে থাকতে হবে কি না? এই ব্যাপারগুলো মুখ্য হয়ে উঠেছে।
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে না এ যাত্রা কিছু হবে। ঘোরাঘুরি আর পেপার পরে দিন কাটছে। পত্রিকার পাতায় পাত্র চাই কলামেও চোখ বুলাচ্ছি মাঝে মাঝে। এমন সময় চোখ পড়ল মজার একটা বিজ্ঞাপনে, ‘ইম্পসিবল ম্যাট্রিমনি এন্ড ড্রিম প্রজেক্ট’।
নামের মানি কি? বিয়ে হওয়া সম্ভব না এমন মানুষেরও বিয়ে দিতে পারে এরা? নাকি হাতে এমন সব পাত্র পাত্রী আছে যে যে কোন ধরনের জুটি গড়ে দিতে পারে। আর ড্রিম প্রজেক্ট মানেই বা কি? যেমন পাত্রী চাই তেমন পাত্রীই হাজির করে দিবে? আর সেই পাত্রী বিয়েতে মত ও দিয়ে দিবে?
ঠিকানা টুকে নিলাম। গুলশান এলাকায়। মনে হচ্ছে না একেবারে ফালতু। চটকদার একটা নাম দিয়ে লোক ভোলানো।
কেমন যেন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। সাক্ষাতের সময় রাত আট টা পর্যন্ত। আজই যাই না কেন? যদি সত্যিই কিছু করতে পারে। বিয়েটা করে যেতে পারলে খারাপ হয় না। ওখানে একা খুব কষ্ট হচ্ছে।
একজন বাঙ্গালীর একটা দোকানের পুরো দ্বায়িত্ব আমার। পুরো ব্যাবসা আমিই করছি। উনি দেখতেও আসে না। আমাকে ম্যানেজার ভাবলে ম্যানেজার। আবার না ভাবলে লেবার।
সেই বাঙ্গালী ভদ্রলোক কোন কারণে আমাকে বের করে দিলে, আবার তো সেই লেবারি করতে হবে। কিন্তু শো তো ভবিষ্যতের কথা এবং সম্ভাবনা খুবই কম।
আজকেই যাব ঠিক করে ফেললাম। এখনই বেড়িয়ে পড়ি। রাস্তায় কেমন জ্যাম থাকে ঠিক নাই।
যদি সত্যিই ভাল মেয়ে দেখাতে পারে, বিয়ে ঠিকঠাক হয়েই যায়, সব কিছু আরেঞ্জ করার সময় ও তো চাই। মাকে ডেকে দরজা লাগতে বললাম। ‘একটু আসছি’ বলে বেরলাম। আগে থেকে কিছু বলার দরকার নেই। যদি দেখি খুব কাজের কোন ঘটক না, তখন আবার সমস্যা হয়ে যাবে।
আগে দেখেই আসি না কেমন কি বৃত্তান্ত।
২
আপনাদের ড্রীম প্রজেক্ট টা কি?
ওটা আমাদের ক্লায়েন্টদের জন্য অনলি।
আমিও তো ক্লায়েন্ট।
আই মিন, পেইড ক্লায়েন্ট। আপনি তো এসেছেন আমাদের কাজের ধরণ জানতে।
আমাদের ক্লায়েন্ট যদি হতে রাজী হন দেন আমরা আপনার বায়োডাটা রাখবো। অন্য কোন ক্লায়েন্ট যদি আপনার বায়োডাটা দেখে পছন্দ করে, আমরা উনাকে আপনার ঠিকানা দিব। অফ কোর্স যদি আপনি সেরকম পারমিশান দেন। আর না দিলে আপনার সঙ্গে আমরাই যোগাযোগ করে আপনার মতামত নিব।
আপনাদের ক্লায়েন্ট হওয়ার জন্য ফি দিতে হবে।
জ্বী।
সেই ফি তে কি ড্রিম প্রজেক্ট ও ইনক্লুডেড?
না, ওটা আলাদা। ওটা একটু কনফিডেনসিয়াল ক্লায়েন্ট দের জন্য অ্যান্ড অবভিয়াসলি কষ্টলী।
একটু ডিটেলস জানতে পারি?
একটু সিক্রেট ব্যাপার তো, সবার সঙ্গে শেয়ার করি না।
কস্টলি কথাটা বলে একটু ঝামেলায় ফেলেছে।
শুধু বায়োডাটা রাখার জন্যই বিশ হাজার। আর ঐ প্রোজেক্টের চার্জ যে কত হবে? হাব ভাবে মনে হচ্ছে দারুণ ইন্টারেস্টিং কিছু। চার্জ বেশী হয়েও যদি ভালো কোন মেয়ে পাওয়া যায়, দেন বিয়েটায় খরচ কমাতে হবে। অনলি সিলেক্টেড লোক ডেকে করতে হবে, এই যা। রাজী হয়ে যাব নাকি? কতই আর চার্জ করবে? লাখ?
চার্জটা ও কি সিক্রেট?
এবার ভদ্রলোক হাসলেন।
বুঝে গেছেন মাছ টোপ গিলেছে। এবার খেলাতে হবে। বেশ গম্ভীর হয়ে শুরু করলেন, দেখুন এই প্রজেক্ট শুধুমাত্র আমাদের ই আছে। এটা আমার নিজস্ব ইনভেনশান। হান্ড্রেড পারসেন্ট সাকসেস।
আর সেজন্য রেটও বেশী। যদি একবার ট্রাই করেন সেক্ষেত্রে চার্জ হবে দুই লাখ। যদি বিয়ে দিতে না পারি দেন টাকা রিটার্ন। পুরো ব্যাপারটাই ডিড করা থাকবে।
লোকটার কথায় কেমন যেন একটা কনফিডেন্স ঝরে পড়ছে।
মনে হচ্ছে যেকোনো মেয়ের সঙ্গেই বিয়ে করিয়ে দিতে পারবে। আমার কাজ শুধু মেয়ে পছন্দ করা। এই মুহূর্তে আমার অনেকটা সেরকম সমাধানই চাই। চারদিকে তাকালাম। বেশ সুন্দর গোছানো অফিস।
বেশ একটা আভিজাত্যের ছাপ আছে। পেছনের বুক সেলফে বাংলা সাহিত্যের সব নামী দামী লেখকের বই। সব কিছু কেমন যেন ধাঁধার মত লাগছে। বোধহয় এটাই চাচ্ছে। রহস্য ঘেরা একটা পরিস্থিতি।
একটা দোদুল্যমানতা। ক্ল্যায়েন্ট যেন দ্বিধায় পরে যায় কি করবে। আমি নিজেও হিসেব কষছি।
৩
কাল ছেলেপক্ষ আসবে।
তো?
তো, দয়া করে বিকেলে বাসায় থাকবি।
তোমার এই ছেলে পক্ষগুলোর আর কাজ নাই? একগাদা মিথ্যা কথা শুনতে আসে। আমি এই রাঁধতে পারি, সেই রাঁধতে পারি, সেলাই পারি, ঘোর গোছাতে পারি।
আমার ওপর কি তোর একটু মায়াও হয় না?
অনেক মায়া। সেজন্যই তো তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না।
প্লিজ, এবার একটু ভালমত কথা বলিস ছেলেটার সঙ্গে।
যদি পছন্দ হয়।
ছেলেটা খুব ভালো। আমি বায়োডাটা দেখেছি। দেখতেও খারাপ না। বেশ অনেস্ট বলে এক বাঙ্গালী ভদ্রলোক তাঁর একটা সুপারস্টোর পুরোটাই ওর হাতে ছেড়ে দিয়েছে।
টুয়েন্টি পারসেন্ট শেয়ার ও দিয়েছে। থাকে সৌদিতে। বিয়ের পরে সঙ্গে নিয়েও যেতে পারবে।
এতগুলো পয়েন্টের ভেতর সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট হল, এখানে বিয়ে হলে বিয়ের পরে মেয়ে বিদেশে থাকবে, সবাইকে বড় গলায় বলবে জামাই বাইরে সেটেল।
খারাপ কি? ভালো বেতন পায়, উন্নতির সুযোগ আছে।
তুই ভালো থাকবি, আমাদের আর কি চাওয়া?
তোমাদের চাওয়া হওয়া উচিৎ ছেলেটাকে যেন আমার পছন্দ হয়।
তোর অমতে তো আর বিয়ে হবে না। আগের কোন ছেলের ব্যাপারে কি তোকে জোর করেছি?
তোমার সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। তোমার জন্য শুধু শাড়ী পড়ব। ব্যাস।
আর কিছু বলতে পারবা না।
আর একটু কাজ আছে। একবার একটু ওদের অফিসে যেতে হবে।
আমাকে?
হ্যাঁ। দুজনকেই ডেকেছে।
বলেছিলাম তোর কাজ আছে। তারপরও বলল তোকেও লাগবে।
বিকেলে অবশ্য ওদিকে আমার একটা কাজ আছে। আমি এখন ঘুমাব। বিকেলে ডেকে দিও।
৪
আমি এক্সট্রিমলী সরি, আপনাদেরকে এই কষ্ট দেয়ার জন্য।
না না। নিশ্চয়ই খুব জরুরী ছিল বলেই ডেকেছেন।
জ্বী। একটু জরুরী।
সেটা হচ্ছে, ছেলেটার ছুটি আর বেশিদিন নেই। যদি পছন্দ হয়, আমি মিন দুদিকেই পছন্দের ব্যাপার আছে, যদি সেটা হয় তবে সব আরাঞ্জমেন্ট খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে।
জ্বী, আমরা অবশ্যই চেষ্টা করব। ওর গয়না তো বানানোই আছে। টুকটাক কিছু কেনাকাটা, আর ছেলে পক্ষের জন্য কেনাকাটা।
মার হ্যাংলামি দেখে মেজাজ গরম হচ্ছিল। ঠিক করে ফেললাম, এই ছেলে যতই রাজপুত্র হোক, আমি বেঁকে বসব।
আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে।
চমকে উঠলাম। এই বেটা আবার আমার সঙ্গে কি কথা বলবে? আমার রাগ মা জানে।
তাই মা আমার হাত চেপে ধরল। চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলল।
বলুন।
আমি একটু একা কথা বলতে চাচ্ছি। ঐ ঘরে একটু আসতে হবে।
বেটার সাহস কত? মার দিকে তাকালাম। মার অবস্থা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মত। আমার তখন জেদ চেপে গেছে। উল্টা পাল্টা কিছু বললে কসে একটা চড় লাগাব। বললাম, চলুন।
পাশের ঘরটা টিপিক্যাল একটা ফটো স্টুডিওর ছবি তোলার ঘরের মতই। একটা মাত্র সিট। ওখানে বসতে বলল। উনি চলে গেলেন ক্যামেরার পেছনে। এখন আবার ছবি তুলবে নাকি? বেশ কয়েকটা লাইট জ্বলল।
আলোর ছটার কারণে ঘটক বেটাকে আর দেখতে পারছি না। শুধু আওয়াজ শুনলাম, আপনি খুব ভালো মত ভেবে বলেন, একজন প্রবাসীকে বিয়ে করে একেবারে দেশ ছেড়ে যেতে আপনার আপত্তি আছে কি না?
ডিপেন্ডস, মানুষটা কেমন।
আমি যতটা বুঝেছি, মানুষ খারাপ না।
আপনার বোঝা দিয়ে তো হবে না।
আপনার বিশেষ কোন আপত্তি আছে? মানে কোন বিশেষ ব্যাপার থাকলে বিয়ে করবেন না, এমন কিছু?
ইয়েস।
আমার ওপর বস গিরি করা।
ওকে দেন। থ্যাংকস ফর ইওর টাইম। চলুন পাশের ঘরে।
৫
আসলে ‘ড্রিম প্রজেক্ট’ ব্যাপারটা সম্পর্কে কেউ জানতে না চাইলে কাউকে বলি না।
সবাই ভাবে ম্যাচ মেকিং ই বুঝি ড্রিম প্রজেক্ট। এটা আসলে আমার নিজস্ব ক্রিয়েশান। একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপারও বলতে পারেন।
এখানে কি করা হয়? মানে আপনি কি সাইকো আনালাইসিস করে ঠিক করেন কার সঙ্গে কার ম্যাচিং হবে?
সেটা কিছুটা তো করিই। তবে আসল ব্যাপার হচ্ছে একটা মেশিন দিয়ে আমি ম্যাচিং টা করি।
পাত্র এবং পাত্রী সম্পর্কে খুব সিওর হলেই আমি শুধু এই প্রোজেক্টে তাঁদের ইনভল্ভ করি। আদারওয়াইজ নট।
আমি কিন্তু এখনও খুব ভালো বুঝতে পারছি না।
একটা মেয়ে একটা ছেলেকে কেন পছন্দ করবে? কিংবা উল্টোটা। কিছু একটা পয়েন্ট তো থাকবে।
মানে কম বেশী আমাদের সবার ভেতরেই একটা পয়েন্ট থাকে যে ব্যাপারটা খুঁজে পেলে আমরা তাঁর ব্যাপারে আট্রাক্টেড হই। সে ব্যাপারটা খুঁজে বের করি। কিছুক্ষণ গল্প করলেই ধরতে পারি। ছেলেদের বেশীর ভাগই চায় সুন্দরী মেয়ে। ফলে একটা লাল টুকটুকে বউ জুটিয়ে দিলেই আমার কাজ শেষ।
ইভেন ড্রিম প্রজেক্ট ও লাগে না। সমস্যা হয় একটু স্মার্ট দের নিয়ে।
অনেক কিছু চাই?
হ্যাঁ। পার্টনার ও চাই স্মার্ট। ভালো কম্পানি হতে হবে, তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ভালো ভাবে কথা বলতে পারবে, সংসারও দেখবে কিন্তু অতি সংসারী না এটসেট্রা।
মেয়েদেরও চাই ওপেন মাইন্ডেড, বেশী বেশী গার্জেন সাজবে না, ওদিকে আবার সল্ভেন্ট লোক চাই, আলাদ থাকলে ভালো, এসব আরকি।
আপনি কি করেন?
যদি মনে করি প্রায় কাছাকাছি রিকোয়ারমেন্ট, দেন ঐ মেশিন দিয়ে বাকী কাজটা সারি।
মেশিনের কাজ কি?
মেশিন দিয়ে আমি মানুষের মাথায় ড্রিম ইমপ্ল্যান্ট করি।
কি ইমপ্ল্যান্ট?
ড্রিম। প্রত্যেক মানুষেরই মনে কোন না কোন ড্রিম বয় বা গার্ল থাকে।
মানে কিছু ক্রাইটেরিয়া থাকে যা আমরা মনে মনে এক্সপেক্ট করি। আমরা যখন কাউকে দেখি, নিজের অজান্তেই তাঁকে কম্পেয়ার করি সেই ড্রিম পারসনের সঙ্গে। এখন যদি সেই ড্রিম পারসন কেই বা সেই ক্রাইটেরিয়া গুলোকে ইমপ্ল্যান্ট করা যায়? যেমন ধরুন আপনার কিছু স্পেশালিটি কে যদি তাঁর এক্সপেক্টেড ক্রাইটেরিয়া হিসেবে ইমপ্ল্যান্ট করে দেয়া যায়?
দেন তাকেই সে তাঁর ড্রিম পারসন ভাববে।
এডজ্যাক্টলি। সেটাই আমার প্রোজেক্ট।
পাশের রুমটা হচ্ছে আমার ‘ড্রিম মেশিন’। ওখানেই আমি ড্রিম ইমপ্ল্যান্ট করি। এরপর যখন আপনি তাঁকে দেখতে যাবেন, আপনার সবকিছুই তাঁর পছন্দ হবে। তাঁর ড্রিম বয়ের সঙ্গে মিলে যাবে। দ্যা ইমপ্লান্টেড ড্রিম উইল ডু দ্যা ট্রিক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।