মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
কত মজা করলাম আমরা!কিন্তু মজার দিনগুলো এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো। আমরা প্রায় ২০জন বাংলাদেশী ছাত্র একসাথে ঈদ করলাম পেশোয়ারে। ১১তারিখ রাতে পেশোয়ার ইন্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি পৌঁছলাম আমি,তৌহিদ আর আরিফ। গিয়ে দেখি লাহোর আর করাচীর লোকজন পৌছে গেছে আর পেশোয়ারের ছেলেরা তো আছেই। কতদিন পরে সবার সাথে দেখা!!
পেশোয়ারের প্রধান সমস্যা খাবার দাবার নিয়ে।
পেশোয়ারী পাঠানদের খাদ্যভ্যাস আমাদের থেকে অনেক ভিন্ন। কিন্তু রাতের বেলায় ক্যান্টিনে খাবার ছাড়া আর কোন ব্যবস্থা ছিলোনা। রাতের খাবার খায়ে শুরু হলো আড্ডা,গান,তাস। সেহেরীর সময় আমরা আবার ভাত-মাংস খেয়েছি পুরা-পুরি আমাদের দেশি রান্না না হলেও একেবারে খারাপ ছিলোনা। এরপর ভোর বেলায় ঘুমুতে গেলাম।
উঠলাম একেবারে ৩টার সময়। কিছুক্ষণ ফুটবল খেললাম সবাই। ইফতারির সময় প্রায় হয়ে এলো,তাই ইফতারির কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। সবাই মিলে প্ল্যান করলাম বাইরে গিয়ে ইফতারি করবো। ইফতারি করেই চলে যাবো আন্টির বাসায় তাই সবাই নিজের নিজের ব্যাগ সাথে নিয়ে নিলাম।
খাসির কড়াই খেলাম আমরা। কিন্তু ওটাতে কোন স্বাদই পেলাম না -মসল্লা ছাড়া কি খাবারে স্বাদ হয়?পেটে অনেক খিদে ছিলো তাই খেয়ে ফেলেছি। কিন্তু আমাদের ইমন ভাই খেতে পারলনা। আপাতত আর কোন অল্টারনেটিভ খাবারের ব্যবস্থা নেই তাই ইমন ভাই কে অভুক্তই থাকতে হল। সুজন আর তার দলকে পাঠিয়ে দেয়া হল বাজার করতে আর আমরা বাকীরা চলে গেলাম আন্টির বাসায়।
আন্টির বাসা বিশাল বড়। আন্টি-আংকেলের বেডরুমটা ছাড়া বাকি সবগুলো রুমই আমাদের জন্য উন্মুক্ত। এখানেও আমরা নিজের নিজের মত জিনিস নিয়ে বসে গেলাম। নিচের রুম হচ্ছে তাসের রুম। চার জন চার জন করে দুই পার্টি বসে গেল ২৯ খেলতে।
আরো কিছু লোক চলে গেলে লনে ব্যাডমিন্টন খেলতে। আর আমি তৌহিদ আরিফ আরো কয়েকজন চলে গেলাম উপরের রুমে টিভি দেখতে। কতদিন পরে বাংলা টিভি চ্যানেল গুলো দেখছি!টিভি থেকে জানতে পারলাম যে কাল ঈদ হচ্ছে না। তাই আমাদের আরেকটা রোজা রাখতে হবে। কি আর করা-সেহেরীর আয়োজন করতে হবে ।
একটু পরে সুজন এল বাজার থেকে। আমরা রাত ১টার দিকে রান্না-বান্না শুরু করব। এর মধ্যে ইমন ভাই পিজা আনাল ,আমরা সবাই পিজা খেলাম। এর মধ্যে নাসির ভাই খবর দিল ফ্রিজে চিংড়ি আছে,কিন্তু মাত্র ৮-১০টা চিংড়ি সবার ভাগে পড়বেনা। আমি একটা ষড়যন্ত্র করলাম।
পেশোয়ারে আমাদের এক ছোট ভাই আছে রাসেল-সে আবার ভাল রান্না করতে পারে। তাকে বললাম চিংড়ি রান্না করতে আমি আর রাসেল খেয়ে ফেলবো। প্রথমে রাসেল বলল সে পারবেনা,কিন্তু একটু পরে এসে বলে “পরাগ ভাই আসেন চিংড়ি রান্না করি। ” আমারে আর পায় কে! পেঁয়াজ-রসুন কেটে দিলাম আর রাসেল রান্না করল। সেই রকম রঙ হয়েছে চিংড়ির (আমার তো প্রায় জিভ দিয়ে লালা বেরুচ্ছে!)।
হঠাৎ করে রান্নাঘরে রফিক ভাই এসে হাজির। চিংড়ি দেখে তার চোখও ছানাবড়া। অগত্যা তাকেও ভাগ দিতে হল;সে সবার কাছে ফাঁস করে দিবে। আমরা তিনজন চিংড়ি দিয়ে খেয়ে ফেললাম;তবে লিও ও আবার ২টা চিংড়ি খেয়েছে। সেহেরীর সময় খাবার রান্না হল।
এর মাঝে কিভাবে জানি ফাঁস হয়ে গেলো যে “পরাগ চিংড়ি খেয়ে ফেলেছে। ”তখন আমি বললাম আমি তো একা খাইনি। আমার সাথে রাসেল,রফিক ভাই আর লিও ও ছিল। কিন্তু কেউ মানতে নারাজ। আমাকে উপাধি দেয়া হল “চিংড়ি চোর”।
সবাই প্ল্যান করলো আগামীকাল চিংড়ি কিনে আনা হবে বাজার থেকে আর আমাকে না দিয়ে খাওয়া হবে। আমিও মেনে নিলাম। রাতের বেলা আমাকে গান ও বানানো হল,ইমন ভাই আবার গীটার দিয়ে গানে সুর ও তুললেন। এদিনও ভোর বেলায় ঘুমুতে গেলাম। উঠলাম সেই ২.৩০-৩.০০টার দিকে।
এবার ইফতারির ব্যবস্থা করতে হবে। আমি আর সুজন বাজারে গেলাম ইফতারি কিনতে। আচ্ছা একটা কথা বলা হয়নি যে-পেশোয়ারীরা একদিন আগেই ঈদ করে ফেলে। তাই বাজারে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া চলছে আর ইফতারির কোন নাম-নিশানা নাই। তাও কিছু ফল,সবজি আর সিগারেট কিনে বাসায় ফিরলাম।
কুক আরিফ,রাসেল আর নাসির ভাই ঠিক করলেন ইফতারির সাথে সাথেই আমরা ডিনারটা সেরে ফেলব;রাতের খাবারও রান্না হয়ে গেল। ইফতারি করলাম আর রাতের খাবার খেলাম। কাল ঈদ হবে কত মজা! গতদিনের মত সবাই নিজের কাজ নিয়ে বসে গেল। ঈদ-মোবারক ওয়ালা মেসেজ আসছে মোবাইলে। আমি চিন্তা করলাম আম্মুর সাথে কথা বলে ফেলি।
অনেকক্ষণ ট্রাই করলাম কিন্তু দেশে ফোন যায়না,পরে ল্যান্ড ফোনে করলাম,লাইন পেলাম কিন্তু একটুপরেই লাইন টা কেটে গেল। সেই সাথে মনটাও খারাপ হয়ে গেলো। টিভি থেকে আওয়াজ আসছে “রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ!”যাই হোক এভাবে টিভি দেখেই পার হয়ে গেলো সময়টা। সকাল বেলা নামাজ পড়লাম। রান্না-বান্না করতে হবে।
আমাদের জুনিয়র ছেলেরা ঘোষণা করেছে যে আজকে তারা কোন কাজ করবেনা। তাই আমরা যারা সিনিয়র আছি তাদেরই কাজ করতে হবে। তৌহিদ আর ইমন ভাই কে অনেক ভাবে রিকোয়েস্ট করা হল কাজ করতে কিন্তু ওরা কোন কাজ করলো না। আমিও রাগ করে বললাম তৌহিদ আর ইমন ভাই আজকে খাবার পাবেনা। আমি,লিও ,মুরাদ আর সুজন কাটাকুটি করলাম আর আরিফ আর আর নাসির ভাই রান্না করলো।
খাবার খেয়ে শুরু হলো আড্ডা। আমি, লিও আর রফিক ভাই জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করলাম। একটু পরে শুরু হল ড্যান্স পার্টি। ইচ্ছে মত উল্টা-পাল্টা নাচ। সন্ধ্যা বেলায় আমাদের এক বড় ভাই এলেন-আইজ্যাক ভাই- একজন ব্যারিস্টার আর এখানে এক নরওয়েজিয়ান কোম্পানিতে কাজ করছেন।
উনি আবার তাস খেলার উস্তাদ। এসেই লেগে গেলেন তাসে। একটু পরে এলেন আরেক বড়ভাই-জয় ভাই। উনি হচ্ছেন ডাক্তার আর এখানে এসেছেন তাবলীগের কাজে। জয় ভাই খুব ভাল রান্না করতে পারেন।
উনি রান্নাঘর গুছিয়ে রান্না শুরু করলেন। এখন আবার তৌহিদ ও কাজ করছে। সে বলল- সে দিনের বেলায় খাবার খায়নি- হাঙ্গার স্ট্রাইক করছে (অথচ আমরা কেউ জানিনা)। রাতের বেলায় জয় ভাই পোলাও-কোর্মা রান্না করলেন। সবাই খুব মজা করে খেলাম।
এরপর আড্ডা দিতে দিতেই শেষ হয়ে ঈদের দিনটা। এরপর চলে আসার পালা। কত মজা করলাম আমরা সবাই একসাথে। পরদিন গানের আসর হল এরপর এক এক করে আমরা সবাই বিদায় নিলাম। এভাবেই শেষ হয়ে গেল আমাদের ঈদ!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।