কত অজানারে!
তিতুমীর হলের পার্থ ভাই। আমাদের চেয়ে তিন বছরের সিনিয়র। 'পার্থ' শব্দটার সাথে 'ভাই' কেন যেন যায় না। তাই আমরা তাকে ডাকি পার্থ দা। পার্থ দা দীর্ঘ দেহি মানুষ।
বাস করেন সিগারেটের প্যাকেটের স্তুপ আর সিগারেট ধোয়ার কুন্ডলীর মধ্যে। তার এহেন বর্ননা শুনে তাকে বাউন্ডুলে ভাবার কোন কারণ নেই। সে রীতিমত আতেল টাইপ ভাল ছাত্র। আর খুব আমুদে একজন মানুষ। পড়ছেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং।
ফোর্থ ইয়ারে উঠার পর তার মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা গেল। তার বসবাসের স্থানে সিগারেট প্যাকেটের সাথে আরো যোগ হল বই এর স্তুপ। ইয়া মোটা মোটা সব বই! সেসব নিয়ে সে সারা দিন বসে থাকে। বাইরে তার সাথে দেখা হলে ভাল করে কথা পর্যন্ত বলে না। সারাক্ষন তার মেজাজ খারাপ।
আমরা ভাবলাম ব্যপার কি? পার্থ দার মত এরকম মজার একজন লোকের এই অবস্থা কেন। প্রেমে-ট্রেমে পড়ল নাকি ব্যটা?
সাহস করে একদিন তার রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলি। "পার্থ দা, কি করেন?" পার্থ দা তার বই এর স্তুপের মধ্যে থেকে মাথা তুলে বলেন। "হাগু পড়ি!!"
লক্ষন সুবিধের মনে হচ্ছে না! কোন সন্দেহ থাকে না দাদার মাথা আসলেই গেছে। রাম ছ্যাকা খেয়েছে মনে হয় একটা।
আমাদের ভার্সিটিতে(বুয়েটে) ছ্যাকা খেয়ে পাগল হবার ব্যপারটা নতুন কিছু না। ফিবছরই দুয়েক জন হচ্ছে। আবারও সেই কেইস! পার্থ দার বাড়ি আমাদের পাশের গ্রামে। নিজের এলাকার এরকম একজন মেধাবী ছেলের এই অবস্থা দেখে মনটাই খারাপ হয়ে যায়।
এর মধ্যে পার্থ দার 'হাগু পড়ার' কাহিনী বুয়েটে চাউর হয়ে গেছে।
সবাই এখন তার রুমের সামনে দিয়ে যাবার সময় উকি মেরে জিজ্ঞেস করে। "পার্থ দা কি করেন?" পার্থদাও হাসি মুখে বলে "হাগু পড়ি"। যেন ব্যপারটা খুবি নরমাল একটা বিষয়। সবাই বুঝি এসব পড়ে! 'হাগু পড়া' জিনিসটা 'চাল পড়া', 'পানি পড়া' বা 'কলা পড়া'র মত কোন ব্যপার কিনা কে জানে? সেরকম হলে ওই জিনিস ঠিক কি ভবে কি কাজে ব্যবহার হবে-সেটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলে আমাদের মধ্যে। এর মধ্যে শেরেবাংলা হলের দুই বড় ভাই।
যারা পার্থদার জুনিয়র কিন্তু আমাদের সিনিয়র। বের করে ফেলল আসল ঘটনা। সব জল্পনা কল্পনার অবশান! ছ্যাকা ট্যাকা নাকি কিছুই না। মুল ঘটনা হল 'থিসিস'! পার্থদার ফোর্থ ইয়ারের থিসিস নাকি 'সুয়ারেজ সিস্টেম অ্যান্ড স্যানিটেশন' এর উপর। মানে স্যুয়ারেজ লাইন গুলো ঠিক কেমন ব্যসার্ধের হলে এই সব তরল অনায়াসে তার মধ্যে দিয়ে পার হয়ে যাবে সেই জিনিস ক্যালকুলেশন করা হল তার কাজ! এই নিয়ে দুই বড় ভাই এর মুখে হাসি আর ধরে না।
আমাদের অবস্থাও তাথাস্তু।
কিন্তু তাদের মুখের এই হাসি বেশিদিন স্থায়ী হয় না। কারণ পার্থ দার পরের বছরই তাদের থিসিসের পালা। তারাও পড়েছে একই স্যারের খপ্পরে। একই বিষয় নিয়ে।
পার্থ দার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে হবে এখন তাদেরই! পার্থদা নাকি তার অই 'হাগুর' লিকুইডীটি আর স্যুয়ারেজ লাইনের অপটিমাম ব্যসার্ধ এর মধ্যে একটা সূত্র বের করেছেন। কিন্তু আসল বস্তুটার লিকুইডিটির ইনফোর্মেশন না থাকার কারণে পাইপের কার্জ়কর ব্যসার্ধ বের করা যাচ্ছেনা। এই ইনফরমেশন খুবি দরকার। ঢাকার আসে পাশের কোন এক যায়গার সুয়ারেজ সিস্টেম ডিজাইন করা হবে বুয়েট থেকে। কিন্তু ওই এলাকার মানুষের 'হাগুর' লিকুইডিটি না জানা থাকার কারণে ডিজাইন ইনকম্পলিট! আমাদের এই নতুন ভাই দের কাজ হল সেই ইনফরমেশন বের করা।
কিন্তু প্রাকটিক্যাল স্যাম্পল টেস্ট করে লিকুইডিটি বের করাতে ভাইদের মহা আপত্তি। তাই তারা অনেক ভেবে চিন্তে ক্লিন এক পদ্ধতি বের করেছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাকি জিজ্ঞেস করবে। কে কতটা পানি ঢালে তাদের বাথরুমে।
এই পদ্ধতিতে অবশ্য তাদের হাগু ঘাটা ঘাটি করা লাগছে না।
কিন্তু আরো বিপদ আছে! কোন বাসায় নক্ করার পর ভদ্র ভাবে সালাম টালাম দিয়ে, নিজেদের 'বুয়েট' পরিচয় দিয়ে বাসার লোককে কিছুটা আসস্ত করার পর- যখন বিনয়ের অবতার সেজে একজন জিজ্ঞেস করে, "আন্টি কয় বদনা?" আর আরেক জন ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার ট্যালি খাতা নিয়ে। বদনা সংখ্যায় টিক মারবে! তখন মাঝে মাঝেই ঝাটা-পেটা খাবার উপক্রম হয় তাদের। অবশ্য শেষের দিকে নাকি তাদের অবস্থার একটু উন্নতি হয়েছিল। ট্যালি খাতার বদলে ল্যাপ্টপ নিয়ে যাবার পর! ল্যাপটপ হাতের দুই বুয়েট ছাত্রকে ঝাটা পেটা করার মত এমন পাশান দিল অল্প লোকেরই আছে। এখানে একটা কথা বলে রাখি- এমনিতেও 'বুয়েট' ছাত্রদের প্রতি সবাই কেন যেন একটু দুর্বল(!!)।
অবশ্য বুয়েটের ছাত্ররা নিজেরা নিজেদের প্রতি মোটেও দুর্বল না। তাই ওই ভাইদের নাম হয়ে যায় 'বদনা ভাই'। তাদের দেখলেই সবাই বেশ জোরে বলে উঠে "ঐ কয় বদনা?"!!!
এসব ঘটনা শুনে সব চেয়ে জোরে অট্টহাস্য দেয় আমার পাশের রুমের সবুর। সে বেচারাও সিভিলের। আমাদেরই ব্যাচ।
তার অবস্থা হয় আরেক কাঠি সরেস। আমরা ফোর্থ ইয়ারে ওঠার পর তারও থিসিসের পালা আসে। এবং যথারীতি তার থিসিস হয় 'মাতোয়াইল' এ। ঢাকা শহরের অদুরেই এক স্থান। সারা শহরের বর্জ্য ফেলা হয় ওই খানে নিয়ে।
তার কাজ এক গাদা টেস্ট টিউব নিয়ে প্রতি সপ্তাহে মাতোয়াইল যাওয়া। এই বর্জ্য স্তুপের মধ্যে নাকি যায়গায় যায়গায় পানি জমে থাকে? সেসব পানির রান্ডম স্যাম্পল সংগ্রহ করা! আর বাকি সপ্তাহ ল্যাবে বসে বসে সেসব দুর্গন্ধ স্যাম্পলের আর্সেনিক, জিঙ্ক, আর সীসার পরিমান বের করা। প্রতিদিন রাতে ল্যাব থেকে ফিরে ডাইনিং এর খাবার সময় সে করুণ চোখে যেভাবে তার নিজের দুই হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখলে মায়াই লাগে!
পারিপার্শিক বিষয়ে আমার লার্নিং রেট এমনিতে কম হলেও এবার আমি সাবধান হয়ে যাই। তাই সবুরের থিসিসের কথা শুনে আর কোন অট্ট হাস্য দেই না! বরং সে যে দেশ ও জাতির কত বড় উপকার করছে, তার উপর একটা বিসদ লেকচার দিয়ে দিই।
আর ভয়ে ভয়ে থাকি পার্থদার 'হাগু পড়া'র অভিশাপ আবার না আমাকেও ধরে বসে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।