পৃথিবী যুদ্ধক্ষেত্র, আমরা সবাই যোদ্ধা
মূর্খতা উগ্রবাদীতা প্রসব করে। পৃথিবীর সব অঞ্চল এবং সব যুগের জন্যে কথাটি প্রযোজ্য। পৃথিবীর যে অঞ্চলে যখনই উগ্রবাদীতা আর উশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে তার অন্তরালে কাজ করেছে মূর্খতা। অন্ধভাবে পথ চলা মূর্খ আর মৃতের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। এরা উভয়ে কোনভাবেই মানবজাতির কোন কল্যানে আসে না।
রাসুলুলাহ্ সালালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রয়াণের দিনে হযরত উমর আবেগের বশে বলে ফেলেছিলেন, মুহাম্মদ মারা যেতে পারেনা। তখন হযরত আবু বকর তাকে ক্কুরআনের সেই আয়াতটি পাঠ করে শুনালেন যেখানে বলা হয়েছে যে, "মুহাম্মদ তোমাদের মতোই মানুষ..." এই আয়াতটি শোনার পরে উমর শান্ত হন। আবেগ মানুষের বিচার বুদ্ধিকে প্রবলভাবে অকেজো করে দিতে সক্ষম। আবেগের কারনে অনেক জ্ঞানী, বুদ্ধিমান মানুষও অনেক সময় নিতান্ত বুদ্ধিহীনের মতো আচরন করে ফেলে।
৬০০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে পারস্যের (বর্তমান ইরানের) লোকেরা ছিলো অগ্নি উপাসক।
সাহাবাদের কর্তৃক যখন পারস্য বিজিত হয় তখন সেখানের অধিকাংশ লোকেরা ইসলাম গ্রহন করে। ইসলাম গ্রহন করলেও ঐতিহ্যবাহী অহমিকা তারা ত্যাগ করতে পারেনি। পারসিকরা অহমিকাবশতঃ বিভিন্ন আরবী শব্দসমূহ (যেগুলো ইসলামের বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত) নিজেদের ভাষায় (ফার্সীতে) অনুবাদ করে ব্যবহার করা শুরু করলো। তারা আলাহ্ বলার পরিবর্তে বলতে শুরু করলো খোদা, সালাত-কে বানালো নামায, সিয়াম-কে রোযা, মালাইকা-কে ফেরেশতা, রাসুল-কে পয়্গম্বর, বাইতুলাহ্-কে কাবা শরীফ, এভাবে বহু আরবী মূল শব্দকে স্রেফ অহমিকাবশতঃ বিকৃত করলো। ফলে ইসলামের বানী সুদুর আরব থেকে এই অঞ্চলের সাধারন মানুষের কাছে পৌঁছানোর মাঝপথে বহু আরবী শব্দ ফার্সীতে রূপান্তরিত হয়ে গেল।
একই শব্দগুলো আরবীর ছদ্মাবরনে প্রবেশ করে উর্দুর মাঝে। উপমহাদেশে সে সময় ফার্সী এবং উর্দু ভাষার ব্যাপক প্রচলন থাকায় এবং মুল আরবী শব্দের ব্যপারে কোন ধারনা না থাকায় সাধারন মানুষ রূপান্তরিত শব্দগুলোকেই মুল আরবী শব্দ ভেবে গ্রহন করলো। আরবী, ফার্সী আর উর্দু বর্নমালায় কিছু অভিন্ন ধ্বনি থাকার কারনে আজও অধিকাংশ সাধারন মানুষ এই তিনটি ভাষার পার্থক্য বুঝতে পারেনা। মুহাম্মদ শব্দটি এই অঞ্চলে এসে উর্দু ভাষাভাষীদের বদৌলতে মোহাম্মদ হয়ে গেছে। এটা স্পষ্টতই মুল আরবী শব্দটির বিকৃত উচ্চারন।
উপমহাদেশে এক সময় নামের পূর্বে শ্রী শব্দটি যুক্ত করার ব্যাপক রেওয়াজ ছিলো। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা নামের পূর্বে শ্রী শব্দটি যুক্ত করতো। তখন সাধারন মুসলমানেরাও তাদের নামের পূর্বে শ্রী শব্দটি যুক্ত করতে শুরু করে। এর প্রতিরোধক হিসেবে সমসাময়িক আলেমগন মুসলমানদেরকে শ্রী শব্দটির পরিবর্তে নামের পূর্বে মুহাম্মদ শব্দটি যুক্ত করতে পরামর্শ দেয়। তখন থেকেই এই উপমহাদেশে মুসলিমদের নামের পূর্বে মুহাম্মদ শব্দটি যুক্ত করার একটি রেওয়াজ চলে আসছে।
উর্দু উচ্চারনের প্রভাবে মুহাম্মদ শব্দটিই মোহাম্মদ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।
আমি কোন সাহাবার নাম এমন পাইনি যে, মোহাম্মদ উমর, মোহাম্মদ আনাস, মোহাম্মদ আলী। বরং সাহাবাদের নামগুলো ছিলো তাদের নিজেদের পিতার নামের সাথে সম্পৃক্তভাবে। যেমন উমর ইবনুল খাততাব, আলী ইবনে আবি তালিব ইত্যাদি। অথচ মুহাম্মদ সালালহু আলাইহি ওয়াসালামকে ভালোবাসা আর অনুসরনের ক্ষেত্রে সাহাবাগন অদ্বিতীয়।
নামের আগে মুহাম্মদ শব্দটি যুক্ত করা ব্যক্তির একান্তই নিজস্ব¡ পছন্দের ব্যাপার। ক্কুরআন, হাদীস এবং ফিক্কাহশাস্ত্রের (ইসলামী আইনশাস্ত্রকে ফিক্কাহ্ বলা হয়) কোথাও একথা বলা নেই যে, নামের পূর্বে বাধ্যতামূলকভাবে মুহাম্মদ শব্দটি যুক্ত করতে হবে।
এদেশের গ্রামাঞ্চলে একদল লোক দেখা যায় যারা ইসলামের বিভিন্ন আদেশ-নিষেধের ব্যাপারগুলো নিয়ে অজ্ঞতাবশতঃ মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে। প্রকৃতপে ইসলামের আদেশ-নিষেধের সীমারেখার ব্যাপারে কোন আরিক শিক্ষা না থাকায় এরা ইসলামের নির্দেশ আর কুসংস্কারকে এমনভাবে মিলিয়ে ফেলে যে সেটা এক কিম্ভুতকিমাকার ককটেলে পরিনত হয়। বেশীরভাগ সময়ে ধর্ম বিষয়ে এদের জ্ঞানের উত্স হয়ে থাকে বিভিন্ন পীরের দরবার এবং মাজার।
এখানে না সত্যিকারের ইসলামের কোন শিক্ষা দেয়া হয় আর না ইসলামের ব্যাপারে স্বচ্ছ কোন ধারনা পাওয়া যায়। কুসংস্কারের কারখানা এইসব পীর আর দরবেশ খ্যাতদের আখড়া থেকে প্রশিতি এইসব লোকেরা অত্যন্ত দতার সাথে কুসংস্কার ছড়ায় নিজ নিজ এলাকায়। এই শ্রেনীর লোকেরা অধিকাংশই যথেষ্ট প্রবীন হয়ে থাকেন, ফলে গ্রাম্য সমাজে সচারচর তাদের কথার বিপরীতে কেউ কোন কথা বলেনা। ফলে অজ্ঞতাবশতঃ কুসংস্কারকেই প্রচার করা হয় ধর্মের সিদ্ধান্ত হিসেবে। এভাবে একসময় সত্যিকার ধর্মীয় নির্দেশ ঢাকা পড়ে যায় কুসংস্কারের আড়ালে।
আলপিনের কার্টুনটির প্রকাশভঙ্গি স্পষ্ট। গ্রাম্য সমাজের মাতবর টাইপের লোকদের অতি মাতবারীর চিত্রটি ফুটে উঠেছে আরিফুর রহমানের "নাম" শীর্ষক কার্টুনটিতে। আমি অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছি যখন শুনেছি যে, কার্টুনটি দ্বারা নাকি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অপমান করা হয়েছে। এখানে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অপমানের কথা বলা হচ্ছে সম্ভবত দুটি কারনে। উদ্দেশ্যপ্রনোদিতভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির লক্ষ্যে অথবা মাত্রাতিরিক্ত আবেগতাড়িত অজ্ঞতার কারনে।
মুহাম্মদ শব্দটির অর্থ হচ্ছে প্রশংসিত। মুহাম্মদ বিড়াল বললে তার মানে দাঁড়ায় "প্রশংসিত বিড়াল"। এটা ভাবা খুবই হাস্যকর যে, মুহাম্মদ বিড়াল বললে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিড়াল বলা হয় বা তাকে অপমান করা হয়। আরবীর ব্যাপারে যাদের ন্যূনতম জ্ঞান আছে তারাই বিষয়টি বুঝতে পারবে। যারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন তাদের মৌনতায় উশৃঙ্খলতা বেড়েছে।
একটি অন্যায়ের প্রতিবাদে কেউ এগিয়ে আসেনি। ফলে একটি অন্যায় ন্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত আবেগ মানুষের চিন্তাশক্তি সীমিত করে দেয়, আর চিন্তার সীমাবদ্ধতা মানুষকে নির্বোধ করে তোলে। আবেগের বশে দু'একজন ব্যক্তি নির্বোধ হতে পারে, কিন্তু সকলের একসাথে নির্বোধ হয়ে যাওয়াটা বিস্ময়কর।
আলাহ তা'য়ালা ক্কুরআনের আয়াতগুলো পবিত্র হিসেবে ঘোষনা করে এর যথাযথ সম্মান এবং সংরনের নির্দেশ দিয়েছেন।
অনেক ব্যক্তি আছে কোথাও আরবী লেখা কোন কাগজ দেখলেই উঠিয়ে চুমু খায়, কপালে ছোঁয়ায়। অথচ কাগজটিতে মন্দ কোন কথা লেখা থাকা অসম্ভব কিছু নয়। আরবী মানেই যে পবিত্র এমন ভাবাটাই মূর্খতা। পবিত্র তো শুধু ক্কুরআনের আয়াতসমূহ। অথচ এরূপ সাধারন মানের মূর্খতাসুলভ কান্ড অনেক সময় অনেক অসাধারন ব্যক্তিদেরকেও করতে দেখা যায়।
মূর্খতা যখন পুরো উপমহাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে তখন সামান্য একটা কার্টুন নিয়ে দেশে উশৃঙ্খলতার সৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক।
লেখাটি শেষ করছি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিখ্যাত একটি হাদিস দিয়ে, যেটি তিনশ'র বেশী সাহাবী প্রচার করেছেন। এটিই সর্বাধিক সাহাবী কর্তৃক প্রচারিত একমাত্র হাদীস। হাদীসটির অনুবাদ হচ্ছেঃ
"প্রত্যেকটি কাজের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল"।
কোন ব্যাক্তির কাজের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত না হয়ে অথবা তাকে নিজ উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার সুযোগ না দিয়ে সরাসরি তার ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসা ইহুদী সুলভ উগ্রতা।
ঢাকা থেকে
০৪.১০.০৭
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।