গল্পের শুরুটা ঠিক এরকমই। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে জীবন যখন অস্থির, চারদিক যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন ঠিক তখনি কোন এক কাক ডাকা ভোরে বাবু ভাই দিলেন শুভ সংবাদটি। প্রথমবারের মত কালীগঞ্জ থেকে বের হতে যাচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ সাপ্তাহিক পত্রিকা! কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। অনুরোধ কিংবা আদেশ যাই ধরি না কেন; বললেন লিখতে হবে স্বপ্নের কথা, আশার কথা। বড্ড দুঃসময়ে আশা!
দুই
আসুন এবার এই উপজেলার একজন চাষীর স্বপ্নের বীজ বোনার গল্প শোনা যাক।
রজব আলী। প্রান্তিক চাষী। এক ছেলে উৎস, আর এক মেয়ে প্রাপ্তি। সীমান্তের কোল ঘেষে দুটো কুড়েঘড়েই তাদের আবাস। নিত্য আয় নিত্য ব্যয়েই রজব আলীর সংসার।
অন্যের ৪ বিঘা জমিতে আধি করার পাশাপাশি নিজের ১.৫ বিঘা জমির তার সম্বল। অন্য দশজনের মতো রজব আলীর ভাবনার আকাশটাও খন্ডিত চির ধরা জমির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেখানে অন্য কিছু অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু তারপরও রজব আলী বিশ্বাস করতে থাকে বীজ বোনার সময় পরিমাপিত স্বপ্নটি উৎসের মধ্যে অনেক বেশি এবং অর্জিত ফসলের থেকে প্রাপ্তির নির্ভরতা অনেক নিশ্চিত ও স্থিতিপূর্ণ।
রজব আলী হাসে, আবার স্থবির হয়ে যায় শুধুমাত্র যে পরিবর্তন কিংবা সম্পূর্ণতার স্বপ্ন বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার ভারে।
আর দশটা চাষীর মত রজব আলীর আপাত কোন অমিল খুঁজে পাওয়া না গেলেও একটা মৌলিক পার্থক্য তাকে করেছে স্বতন্ত্র। সে স্বপ্ন দ্যাখে পরিবর্তনের, ভালো থাকবার, ভালো রাখবার বৃহৎ জীবনের লক্ষ্যে কিছু। এই তথ্যটুকু সে তার সন্তানের মাঝে বিলিয়ে দেয় দৃষ্টির আদ্রতায়।
উতস বড় হতে থাকে এলাকার নিজস্ব গ্রন্থ এবং কলোকাকলিতে। উতস নিয়মিত স্কুলে যায়।
তার ভালো ফলাফলে রজব আলীর পরিমাপিত স্বপ্নের পরিমান প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। উতস শান্ত এবং ভাবুক। স্বপ্নের দৃষ্টি মেলার সাথে সাথে হঠাত অতৃপ্তির এক আগুন যেন নিয়মিত জ্বালাতে থাকে তাকে। বাবাকে আশ্বস্ত করার যথেষ্ট রসদ যেন খুঁজে পায়না সে।
প্রাপ্তি চঞ্চল কিন্তু রজব আলী তাকে একটা নির্ভরতার আঁচল মনে করে।
যেন সব সমস্যার সমাধান প্রাপ্তির কাছে আছে। যখন প্রকৃতির নিষ্ঠুর আঘাত ফসলে আছড়ে পড়ে রজব আলীর ভয় হয় তখন। এ ভয় যেন অন্যরকম, শুধু ফসল হারাবার ভয় নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। সময় বয়ে চলে। টিকে থাকে সংগ্রাম, টিকে থাকে মানুষ এবং বেঁচে থাকা...
এখন রজব আলী নেই।
তার সমসাময়িক অনেকেই আছে, ছিল এবং থাকবে হয়ত আরও কিছুদিন, কিছু বছর, তবে অপুষ্পিত অস্তিত্বের অংশ হিসেবে শুধু- যার সুবাস নেই, যেন প্রাণহীন স্থবির জড়। কিন্তু রজব আলী বেঁচে আছেন বুনে যাওয়া তার স্বপ্নের মাঝে। প্রচন্ড সুবাসে আলোড়িত হবে সেই স্বপ্নের ক্ষিপ্রতায়- প্রজন্মেও পর প্রজন্ম; মহাকালের পথে...
তিন
দুঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দুঃখ কী ? কথাটা কতটুকু সত্য কিংবা মিথ্যা এ নিয়ে কখনো ভাবা হয়নি। তবে এতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি যে বঞ্চিতরা চিরদিনই বঞ্চিত-ই থেকেছে এবং থাকছে। বাংলাদেশের এমন একটি জায়গায় আমরা বসবাস করি যেখানকার অধিকাংশ মানুষ প্রায়ই না খেয়ে, শীতের কষ্টে কিংবা তার চেয়েও বড় কষ্ট বন্যার জলে ভেসে বেড়াই।
শুধুমাত্র ক্ষুধা নিবারণের জন্য ছুটে চলি দিগ থেকে দিগন্তে। কতটা অভাবগ্রস্থ হলে ২০ কিংবা ৫০ টাকায় জীবনের ঝুকি নিয়ে বাসের ছাদে কিংবা দাড়িয়ে ৫০০ কি.মি. পথ পাড়ি দেওয়া যায়! আবার এ জন্যেই আমাদের নাম হয়ে যায় ‘মফিজ’! তথাকথিত ভদ্রজনরা মাঝে মধ্যেই একথা শুনিয়ে দেন! যখন জীবনের সমস্ত সম্বলটুকু দিয়ে স্বপ্নগুলো রঙ্গিন ক্যানভাসে আঁকতে বসি, চেষ্টা করি সঞ্চিত অর্থটুকু দিয়ে সোনালী ফসল ফলাতে তখন কোন এক প্রলয়ঙ্কারী ঝড়, বন্যা কিংবা মঙ্গার মত নীরব ঘাতক ধুলোয় মিশে দিয়ে ভেসে নিয়ে বেড়ায় আমাদেরকে। আমরা হয়ে যাই নিঃস্ব, সহায় সম্বলহীন। তারপরও আমরা বেঁচে থাকি এবং বাঁচতে চাই ঠিক রজব আলীর মত।
পুনশ্চঃ আসুন স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখাতে শেখাই।
বেঁচে থাকি সঞ্চারিত স্বপ্নের মধ্যে। এটকুই আমাদের সম্বল। এটা কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। এটা কেউ কোনদিন কেড়ে নিতে পারেনি, পারবেও না।
বিদ্র. লেখাটি আমার এক বন্ধুর লেখা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।