আজ আমি একটা ছোট্ট গল্প বলবো। আমার ভাইয়ের গল্প। সে এস.এস.সি পাস করে ঢাকায় নটেরডোম কলেজে ভর্তি হয়। সে সাধারনত চিঠি লেখে না। কদাচিৎ লেখে।
আজ তারই একটা চিঠি মাকে লিখেছে তাই হুবহু-
মা,
আজ শবে বরাত। আজকের এই দিনে আমাদের বাসায় হালুয়া, রুটি সহ কত কিছু তৈরী হয়। আমরা পাঁচ ভাই আর আব্বা-তুমি মিলে মজা করে খাই। গত বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু কালের বিবর্তনে আর সময়ের দাবিতে আজ আমি পরিবার থেকে দূরে।
গতকাল থেকেই আমার রুমের সবাই হালুয়া রুটির গল্প করছে, কে কোথায় খাবে, কে কোথায় যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তাদের গল্প শুনছি আর বারবার অতীতে হারিয়ে যাচ্ছি। যদি আমি বাসায় থাকতাম তবে আমিও এসব খেতে পারতাম, আমিও অনেকের বাসায় যেতাম, এসব ভাবতে ভাবতে কখনযে ঘুমিয়ে পড়েছি সে মনে নেই।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি রুমে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। খুব খারাপ লাগছে, বাসার কথা, আব্ব-তুমি, রাশেদ ভাই, রাছেল ভাই, রেজা ভাই, রনি, লেলিন, মেসবা সহ আরও অনেকের কথা মনে পড়ছে।
আমার সব রুমমেট তাদের পরিচিত বিভিন্ন বাসায় দাওয়াত খেতে গেছে। আমাকেও বলেছিল যেতে কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে ওরা আগেই চলে গেছে। হয়তো ব্যাস্ত ছিল তাই আমার কথা ভূলে গেছে। সকালের নাস্তা করলাম শান্তিবাগ বাজারের একটি দোকানে। দুপুরে শবেবরাত উপলক্ষে বুয়া আসেনি।
শবে বরাত উপলক্ষ্যে ছুটি নিয়েছে। মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। দুপুরে আর কিছু খেলাম না। নিজের উপরেই রাগ লাগছিল, ওদের করো সাথে গেলে হয়তো উপোস থাকতে হতো না। বিকেলে বের হয়ে নাস্তা করে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভবঘুরের মত ঘুরলাম মালিবাগ মোড়, মৌচাক মার্কেট, আনারকলি মার্কেটে।
হাজার রকমের হাজার রঙ্গের মানুষ। আমার একটু খারাপ লাগলে আমি এই স্থান গুলোতে ঘুরে বেড়াই। রাত্রে হলে ফিরে দেখি স্বপন ওর খালা বাড়ী থেকে ফিরেছে। তার সাথে গল্প করতে করতে রাত ৯টা বাজলো। আমি ওকে বললাম খেতে যাবি না।
সে বললো না। আমি বললাম চল খেয়ে আসি দোকান থেকে। সে একটা বক্স বের করে বললো হাত ধুয়ে আয় আজ রাত্রে এই দিয়ে কাজ চালাবো। সত্যি বললে আমারও ইচ্ছে করছিল না বাইরে খেতে যেতে। পকেটে যে কয়টি টাকা আছে তাদিয়ে মাস শেষ হয় কিনা সন্দেহে আছি।
স্বপন ওর খালা বাসা থেকে হালুয়া-রুটি এনেছে। আনন্দে আমার খুব কান্না পাচ্ছিল, অবশেষে হালুয়া-রুটি খেতে পারছি বলে। মনের চাপা কষ্টগুলো স্বপনের কাছে গোপন করে তাই দুজনে মিলে খেয়ে নিলাম। রাতেও কপালে ভাত জুটলো না।
মাগো খুব বলতে ইচ্ছে করেÑ মাগো আমাকে তোমরা এ কোথায় পড়াশুনা করতে পাঠালে।
যেখানে একজন সারাদিন না খেয়ে থাকলেও কেউ খোঁজ নেয় না। বিশেষ বিশেষ আনন্দের দিনও কেউ একটু ডাকে না। কেউ বলেনা বাবা আয় তোর জন্য হালুয়া-রুটি তৈরী করেছি, খেয়ে যা।
তোমরা থেকেও যেন নেই। আমাকে এত অল্প বয়সে একা করে দিলে।
পরিবার থেকে দূরে ঠেলে দিলে। যেদিন আমি প্রথম তোমাদের ছেড়ে ঢাকা এসেছিলাম সেদিন বুঝিনি আমি তোমাদের স্নেহ, মায়া, মমতা হারিয়ে নতুন কোন জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। আর কোন দিন তোমাদের সাথে আগের মত একসাথে থাকতে পারবো না, ভাইদের সাথে অকারনে ঝগড়া, জমিয়ে আড্ডা, গল্প, মজা করতে পারবো না। কিংবা ছোট ছোট আনন্দের দিন গুলো সবাই মিলে একত্রে উপভোগ করতে পারবো না। অনেক দিন পরপর বাড়ী গেলে নিজ গৃহে অতিথী হয়ে থাকতে হবে।
মাগো, আগে যদি বুঝতাম এখানে পড়তে এসে এত কিছু হারাতে হবে তবে আমি কোনদিন তোমাদের ছেড়ে আসতাম না। ওখানেই কোন কলেজে ভর্তি হয়ে যেতাম।
ইতি
তোমাদের স্নেহের রানা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।