কিছু দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে এই জীবনে। ভ্রমণ আমার ভাল লাগে্ তাই সবার মাঝে তা জানাতে চাই। সবার উপরে ভালোবাসি বাংলাদেশ । ধন্যবাদ বাংলাদেশ থেকে সিংগাপুর যেতে ১৯৯৭ সালের ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত কোন ভিসাই লাগত না । সিংগাপুর পোর্ট এন্টি ভিসা দিত ।
ঢাকা থেকে সিংগাপুর চাংগি বিমান বন্দর ৩ ঘন্টার মত পথ। পথে ব্যাংককে ১ ঘন্টার যাত্রা বিরতী ছিল। ব্যাংকক থেকে উড়ার পর ১ ঘন্টার মধ্যে বিমান সিংগাপুরের চাংগি এয়ার পোর্টে ল্যান্ড করে । সিংগাপুরে নামার পর সবচেয়ে যে জিনিষ আমাকে আকৃষ্ট করে তা হলো এদের ডিসিপ্লিন । সব কিছু যেন সাজানো এবং নিয়ম মাফিক সব চলছে ।
যাত্রীদের সাথে আমিও ইমিগ্রেশনের লাইনে দাড়ালাম এবং দেখলাম সুশৃংখল ভাবে সবাই অপেক্ষায় আছে। ইমিগ্রেশন থেকে ভিসা নিয়ে এয়ারপোর্টের ভেতর গেলাম লাগেজ নিতে । পথেই সিংগাপুর পর্যটন কর্তৃপক্ষ অনেক আকর্ষণীয় বুকলেট সাজিয়ে রেখেছে ভ্রমন কারীদের বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয়তার দিকে লক্ষ্য রেখে । কয়েকটা বুকলেট/ম্যাপ সংগ্রহ করলাম । এগুলো তথ্যবহুল চিত্তাকর্ষক এবং সহজ পাঠ্য ।
যে কেউ এগুলো পড়ে সিংগাপুরে নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারে ।
এয়ারপোর্ট থেকে শহরে সবার জন্য বাস এবং টেক্সির ব্যবস্থা আছে । বাসগুলো বিভিন্ন হোটেলে যাত্রীদের নামীয়ে দেয় । হোটেলের তালিকা দেখে জায়গা চিনে আশে পাশের এলাকায় যাওয়া সম্ভব । হোটেলের লিষ্টও এয়ার পোর্টে বুকলেট আকারে আছে।
এছাড়া টেক্সি আছে । টেক্সিকে গন্তব্যের ঠিকানা বললে নিয়ে যাবে । যাত্রীরা লাইন দিয়ে আছে । টেক্সিও লাইনে দাড়াচ্ছে এবং সিরিয়াল অনুযায়ী যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে । এয়ার পোর্ট থেকে টেক্সি নিলে দুই সিংগাপুর ডলার বেশী ফি দিতে হয়।
এছাড়া টেক্সিতে পিক বা ব্যস্ত আওয়ার এর অতিরিক্ত ভাড়ার তালিকা রয়েছে । বিল মিটারে উঠে এবং এ ব্যাপারে তেমন কোন সমস্যা হয়না । টেক্সিতে বা বাসে গেলে প্রথমে কথা বুঝতে একটু কষ্ট হয় । মনোযোগ দিলে তা বোঝা যায় । একটু চাইনিজ টান আছে তাদের ইংরেজী উচ্চারণে ।
বিমান বন্দরেই টাকা ভাংগানোর ব্যবস্থা আছে এবং যাত্রীদের সেবা প্রদানের জন্য সব সময় তা খোলা থাকে । এছাড়াও পর্যটনের কাউন্টার আছে বেশ কটি । তারা বিভিন্ন ধরনের হোটেল , ট্র্যাভেল এজেন্ট ও ভ্রমন বৃত্তান্ত সম্বন্ধে উপদেশ বা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে । সব মিলিয়ে সুন্দর ব্যবস্থা ।
১৯১৯ সালে স্যার ষ্টামফোর্ড র্যাফেলস যখন ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর জন্য এই দ্বীপ ক্লেইম করে তখন সিংগাপুর জলমগ্ন জলাভূমি ও ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ একটা দ্বীপ ছিল যাতে হাতে গোনা কিছু জেলে ও সাগরের বেদেরা বাস করত ।
আজ সিংগাপুর একটা অত্যাধুনিক নগর রাষ্ট্র এবং এতে ২.৮ মিলিয়ন লোক বাস করছে। এটা এশিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী একটা রাষ্ট্র এবং আঞ্চলিক ব্যবসা , যোগাযোগ,ব্যাংকিং ও পর্যটন কেন্দ্র । সিংগাপুর ব্যস্ততম সামুদ্রিক যোগাযোগ পথে অবস্থিত বলে এর গুরুত্ব এত এবং এর আজকের উন্নতি এই গুরুত্বকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করার কারণেই সম্ভব হয়েছে । ১৪শ শতকের দিকে এই জায়গাটা সী টাউন হিসেবে পরিচিত ছিল পরবর্তীতে এটাকে সিংগাপুরা বা লায়ন সিটি হিসেবে নামকরণ করা হয় । সিংগাপুর মাত্র ৬৪৬ বর্গ কিলোমিটারের ছোট একটা দ্বীপ ।
এর সী পোর্টটা পৃথিবীর একটা অন্যতম ব্যস্ত পোর্ট এবং এয়ারপোর্ট ও পৃথিবীর ভিতর অন্যতম ব্যস্ত একটা বিমান বন্দর । বছরে লক্ষ লক্ষ পর্যটক এই দেশ দেখতে আসে । অধিবাসীদের বাসস্থান কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এদেশ পর্যটকদের আকর্ষন করার জন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। অনেক হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র পার্ক, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম ভাবে যতœ ও রাক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে এদেশে । আমার থাকার ব্যবস্থা হলো এক ভাইয়ের বাসায় ।
টেক্সি নিয়ে ঠিকানা মিলিয়ে চলে গেলাম। পথ হারানোর কোন সুযোগ নেই এখানে । থাকা নিয়ে কোন সমস্যা না থাকায় দেশটাকে ঘুরে দেখার সখটা পুরণ করতে লেগে গেলাম । আবাসিক এলাকা থেকে রাস্তাগুলো বের হয়ে মুল রাস্তার সাথে মিলেছে । মূল রাস্তার কাছাকাছি আসলে টেক্সি পাওয়া যায় ।
টেক্সিতে মিটার আছে গন্তব্যে নিয়ে যায় । আবাসিক এলাকার এপার্টমেন্ট গুলো সব আকাশচুম্বী । অনেক নতুন নতুন আবাসিক ভবন এগুলোকে কনডো বলে স্থানীয়রা । সে সময় নতুন আবাসিক ভবন, অফিস ভবন ও মার্কেট নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছিল।
মানুষের স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য ট্রেন লাইন ও বাস স্টপ এমন ভাবে বানানো হয়েছে যে আবাসিক এলাকা থেকে ২০/২৫ মিনিট পথ হেঁটে সেখানে যেতে হবে এবং অফিসেও সেভাবে হেঁটে পৌঁছাতে হবে।
কাজেই সুস্থ্য থাকার ব্যবস্থা নগর পরিকল্পনার ভিতরই করা হয়েছে । সবাই হাতে সময় নিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে বের হয় । বেড়ানো ও কিছু কেনাকাটার জন্য সিংগাপুর আসা তাই দুটোকেই প্রাধান্যদিয়ে সময় ভাগ করে নিলাম । অনেক সুন্দর সুন্দর ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর আছে সিংগাপুরে । সব কিছুই পাওয়া যায় ।
তবে দাম মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড এর তুলনায় অনেক বেশী । ভাল হোটেলও বাংলাদেশীদের জন্য বেশ ব্যয়বহুল মনে হবে । ঘুরে বেড়ানো ও কেনাকাটার জন্য অনেক ফ্রি গাইড বই আছে । সেগুলো একটু ষ্ট্যাডি করে টেক্সি নিয়ে বের হয়ে পড়লাম । বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর গুলোতে সুন্দর সুন্দর জিনিসে পুর্ণ ।
এলাকা পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশ বান্ধব । যে যার মত ঘোরাফেরা ও কেনাকাটা করছে । কোলাহল মুক্ত শান্তিপুর্ণ পরিবেশ । সিংগাপুরে থাকাকালীন সান্তোষা আইল্যান্ড ও জুরং বার্ড পার্ক দেখার প্লান করলাম । এছাড়াও আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ড দেখার জন্য মনস্থির করলাম।
নাইট সাফারীও বেশ আকর্ষণীয় তবে সময়ের অভাবে তা দেখা হলো না ।
আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ড ঃ সাগরের বিচিত্র প্রাণী ও মাছদেরকে কখনো এতো কাছে থেকে দেখা হয়নি আগে । সিংগাপুরের এই সাগর প্রাণিকুলের মনে হয় অ্যাকুরিয়াম এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় । এখানে প্রায় ৬০০০ এর মত সামুদ্রিক প্রাণী ও ৩৫০ টা প্রজাতির জীবজন্তু আছে । আস্তে আস্তে সময় নিয়ে অপূর্ব এই সৃষ্টিকে শুধু কাঁচের দেয়ালের এপার থেকে দেখা যায় ।
ভিতরে গেলে এমন অনুভুতি হয় যে আমি নিজেই ওদের সাথে আছি । ইঞ্চি খানেক দুর দিয়ে হাংগর ও অন্যান্য প্রাণী সাঁতরে বেড়াচ্ছে । সুন্দর ভাবে রাস্তা করে দেয়া আছে এবং পর্যটকরা নিরাপদে এসব সাগরের প্রাণী দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতে পারে । ষ্টিংরে মাছ, ঈল মাছ, হাংগর ও অন্যান্য অচেনা চেহারার বিভিন্ন বর্ণের মাছ ও প্রাণী দেখে মনটা সাগরতলের অতল রহস্যের জগতে হারিয়ে যায়। ঘন্টাখানেক এখানে থেকে বাইরে এলাম ।
দেখার মত জিনিস বটে। মনটা ভরে গেল ।
সানতোসা আইল্যান্ড
সানতোসা আইল্যান্ডে কয়েক ঘন্টা ঃ সিংগাপুরে বেড়াতে গিয়েছিলাম নভেম্বর/ডিসেম্বর ৯৭ এর দিকে। সিংগাপুরের নিয়মানুবর্তিতা ও সময়জ্ঞান মুগ্ধ হওয়ার মত । এয়ারপোর্টে নামার সাথে সাথেই সবকিছু নিয়ম মোতাবেক হচ্ছে ।
অযথা কোন ঝামেলা, হয়রানি বা দুর্ভোগ নেই । এয়ার পোর্টে ঢুকেই দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমনের অজস্র লিফলেট। বেড়াতে এসেছি কাজেই ঘুরে দেখব ভেবে লিফলেটগুলো সংগ্রহ করলাম । সিংগাপুরে অবস্থানের দিনগুলোতে কখন কি দেখব সে রকম একটা পরিকল্পনা করে নিলাম । সে রকমই একটা বিকেলে সান্তোসা আইল্যান্ড দেখতে বের হলাম ।
টেক্সিতে করে ক্যাবল কার টাওয়ারে এলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে সান্তোসা আইল্যান্ডের কথা বললেই নিয়ে আসে । বিশাল টাওয়ারের উপর কেবল কার ষ্টেশন , নীচে সান্তোসা দ্বীপে যাওয়ার টিকেট কাউন্টার ও বেশ কিছু স্যুভেনির শপ আছে। টিকেট করে লিফ্টে চড়ে বসলাম । লিফ্্ট সময় মত ষ্টেশনে চলে এল।
লোকজন জড়ো হচ্ছে। ক্যাবল কারে সিট ক্যাপাসিটি অনুযায়ী মানুষ উঠছে ও ক্যাব ছেড়ে দিচ্ছে। আমরাও একটা ক্যাবে চড়ে সান্তোসার দিকে রওয়ানা হলাম । ক্যাবল কার,ফেরী ,বাস কিংবা টেক্সিতে সান্তোসা আইল্যান্ডে যাওয়া যায় । ফেরীর জন্য ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কাছে ফেরী টার্মিনাল আছে ।
সেখান থেকে টিকেট করে ফেরীতে চড়তে হয় । বাসেও সান্তোসা যাওয়ার ব্যবস্থা আছে । ট্যাক্সিতে করে সান্তোসায় থাকার হোটেলে যাওয়া যায় সেখান থেকে পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখা সম্ভব । ক্যাবল কারে করে শুন্যের উপর দিয়ে চলছি । প্রায় ৬০ মিটার উচু দিয়ে ক্যাবল কার এগিয়ে চলছে ।
নীচে সিংগাপুরের পোতাশ্রয় । অনেক অনেক জাহাজ নোঙ্গর করা । ফেরী চলছে নীল সাগরের বুকে । দুরে তেল শোধনাগার গুলোর চিমনি দেখা যাচ্ছে । অনেক তেল শোধনাগার রয়েছে সিংগাপুরে ।
খুবই মজা লাগল ক্যাবল কার ভ্রমন । এগুলো খুব নিরাপদ । বহু পর্যটক ক্যাবল কারে করে দ্বীপে যাচ্ছে ও ফেরত আসছে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।